নিয়ামুল ইসলাম।।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ার দেড় মাস পেরিয়ে গেছে। এ পর্যন্ত পাঁচ হাজারেরও অধিক আক্রান্ত এবং প্রায় দেড়শত'র মত মৃত্যু হয়েছে। লকডাউন ও যানচলাচল বন্ধে সারা দেশে প্রায় অচলাবস্থা। মানুষের রুটিরুজির পথ বন্ধ, মধ্যবিত্তদের ঘরে টানাপোড়েন আর নিম্নবিত্তদের তো মাথায় হাত।
সরকারের খাতায় কিংবা মিডিয়ার চোখে দেশে যে পরিমান হতদরিদ্র বাস্তবতা তার চেয়ে বহুগুণ বেশি। আমাদের আশপাশে তাকালে হয়ত প্রত্যেকেই এমন কাউকে দেখতে পাই যারা একবেলার খাবার দুইবেলা ভাগ করে খায়।
একে তো মহামারীর কারণে রোজগার নাই, অপর দিকে দেশের কিছু কর্তাদের মধ্যে মনুষ্যত্বের অভাব ত্রাণদূর্নীতি আর জালিয়াতির প্রকোপে না খাওয়া মানুষগুলো দারিদ্র্যের সাথে অসম লড়াই করে যাচ্ছে।
সমাজের এমন করুণ দশায় দুস্থ ও অসহায়ের পাশে দাঁড়ানো নিঃসন্দেহে মহৎ কাজ। ইসলামে দান-সদকার গুরুত্ব ও ফযীলত অনেক বেশি, বিশেষ করে এহেন পরিস্থিতিতে এর গুরুত্ব কতটা তা বলাই বাহুল্য।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, مَّن ذَا الَّذِي يُقْرِضُ اللَّهَ قَرْضًا حَسَنًا فَيُضَاعِفَهُ لَهُ أَضْعَافًا كَثِيرَةً
(কে আছে, যে আল্লাহকে উত্তম ঋণ দিবে? বিনিময়ে তিনি তাকে সেটা বহুগুণে বাড়িয়ে দিবেন। সুরা বাকারা- ২৪৫
অর্থাৎ, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোন কিছু দান করলে তিনি সেটা বহুগুণ বাড়িয়ে বিনিময় প্রদান করেন। সেই বিনিময় আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াতেও দিতে পারেন অথবা আখেরাতেও দিতে পারেন।
আল্লাহ পাক অন্যত্র এরশাদ করেন, مَّثَلُ الَّذِينَ يُنفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ كَمَثَلِ حَبَّةٍ أَنبَتَتْ سَبْعَ سَنَابِلَ فِي كُلِّ سُنبُلَةٍ مِّائَةُ حَبَّةٍ ۗ
وَاللَّهُ يُضَاعِفُ لِمَن يَشَاءُ ۗ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ
(যারা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে তাদের দৃষ্টান্ত সেই শস্যদানার মত যা সাতটি শীষ উৎপন্ন করেছে, প্রতিটি শীষের মধ্যে রয়েছে এক'শত দানা। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বহুগুণ বাড়িয়ে দেন, আর আল্লাহ তায়ালা দানশীল ও সর্বজ্ঞানী। _ সুরা বাকারা- ২৬১)
অর্থাৎ, আল্লাহর রাস্তা যে ব্যক্তি এক টাকা দান করল সে যেন এমন একটা শস্যদানা বপন করল যার শেষ ফলাফল হলো সাতশত দানা। সুতরাং সৎ নিয়তে এক টাকা দান করলে এর বিনিময়ে সাত'শ বা তার চেয়েও বেশি সওয়াব পাওয়া যাবে।
হাদীসে শরিফে এসেছে,عَنْ كَعْبِ بْنِ عُجْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم الصَّوْمُ جُنَّةٌ وَالصَّدَقَةُ تُطْفِيءُ الْخَطِيئَةَ كَمَا يُطْفِئُ الْمَاءُ النَّارَ
(রাসুল সা. বলেন, রোজা হলো ঢালস্বরূপ, আর সদকা পাপকে এমনভাবে নিঃশেষ করে যেভাবে পানি আগুনকে নিভিয়ে দেয়। তিরমিযী- ৬১৪)
কোরআন ও হাদীসে দান-সদকার আরো অনেক গুরুত্ব বর্ণীত হয়েছে। দান-সদকা করার তো এমনিতেই অনেক ফযীলত আর এই সময়ে এর প্রয়োজনীয়তা আরো বহুগুণ। তার উপর এখন পবিত্র রমজান মাস। এ যেন সোনায় সোহাগা।
রাসুল সা. এক হাদীসে বলেন, مَنْ تَقَرَّبَ فِيهِ بِخَصْلَةٍ مِنَ الْخَيْرِ كَانَ كَمَنْ أَدّٰى فَرِيضَةً فِيمَا سِوَاهُ، وَمَنْ أَدّٰى فَرِيضَةً فِيهِ كَانَ كَمَنْ أَدّٰى سَبْعِينَ فَرِيضَةً فِيمَا سِوَاهُ. (যে ব্যক্তি এ মাসে একটি নফল কাজ করল সে যেন অন্য মাসের একটি ফরজ আদায় করল, আর যে ব্যক্তি এ মাসে একটি ফরজ আদায় করল সে যেন অন্য মাসের সত্তরটি ফরজ আদায় করল।_ শু'আবূল ঈমান- ৩৩৩৬)
যদিও এই হাদীসের সনদে দূর্বলতা রয়েছে, কিন্তু রমজান মাস পবিত্র ও বরকতময় মাস হওয়ায় এ মাসে যেকোনো নেক কাজের মধ্যে আল্লাহ তায়ালা বারাকাত দান করবেন এটা আশা করাই যায়!
তাছাড়া রাসুল সা. অন্য হাদিসে বলেন, عَن زَيدِ بنِ خَالِدٍ الجُهَنِيِّ رضي الله عنه، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم، قَالَ: مَنْ فَطَّرَ صَائِماً، كَانَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِهِ، غَيْرَ أنَّهُ لاَ يُنْقَصُ مِنْ أَجْرِ الصَّائِمِ شَيْءٌ (যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে ইফতার করাবে তার ওই রোজাদারের সমপরিমান সওয়াব হবে, কিন্তু রোজাদারের সওয়াব থেকে কিছুই কমানো হবে না। তিরমিযী- ৮০৭)
সামর্থ্যবানদের জন্য মানুষের এই দুর্দিনে তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া মানবতার দাবী বটে, আর সেখানে যদি থাকে সৎ নিয়ত (ইখলাস), আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্য তাহলে প্রভুর কাছে আশা করা যায় এর অফুরন্ত বিনিময়। সেই সাথে আছে পবিত্র ও বরকতময় মাস রমজানের বিশেষত্ব। এই সুযোগ হাতড়ে নেয়া প্রতিটি মুসলমানের জন্য আনন্দের বিষয় হওয়া উচিৎ।
তবে সাহায্যের নামে ফটোসেশন কিংবা আত্মপ্রচার থেকে আমরা অবশ্যই বিরত থাকব, অন্যথায় আমাদের কষ্টার্জিত সম্পদের বিনিময়ে প্রভুর কাছে কিছুই আশা করা যায় না।
আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُبْطِلُوا صَدَقَاتِكُمْ بِالْمَنِّ وَالْأَذَى كَالَّذِي يُنْفِقُ مَالَهُ رِئَاءَ النَّاسِ وَلَا يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ (হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদের দানকে খোঁটা ও কষ্ট দিয়ে ওই ব্যক্তির মত নষ্ট করে দিও না, যে লোক দেখানোর জন্য তার সম্পদ দান করে এবং আল্লাহ ও আখেরাতের উপর বিশ্বাস রাখে না।..... _ সুরা বাকারা- ২৬৪)
সুতরাং লোক দেখানোর জন্য বা মিডিয়ায় প্রচার করার উদ্দেশ্যে দান করলে আল্লাহর কাছে এর বিনিময় আশা করা যায় না। দানের মধ্যে থাকতে হবে ইখলাস ও গোপনীয়তা।
দান করার সঠিক নিয়ম বিশ্বনবী সা. আমাদেরকে বাতলে দিয়েছেন। হাদীস শরিফে এসেছে,
عن أبي هريرة قالَ: قالَ رسُولُ اللَّه ﷺ: سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمُ اللَّهُ في ظِلِّهِ يَوْمَ لا ظِلَّ إلَّا ظِلُّهُ: ورَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ فأَخْفَاها، حتَّى لا تَعْلَمَ شِمالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينهُ (যেদিন আল্লাহর (আরসের) ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া থাকবে না সেদিন আল্লাহ তায়ালা সাত প্রকার ব্যক্তিকে সেখানে ছায়া দিবেন, (তার মধ্যে এক প্রকার হলো) ওই ব্যক্তি যে গোপনে দান করে, এমনকি তার বাম হাতও জানে না তার ডান হাত কী দান করেছে। বুখারী- ৬৬০)
আমাদের দানগুলো হতে হবে একান্ত গোপনীয়তার সাথে। লোক দেখানোর জন্য নয়, একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য মানুষের কল্যাণের উদ্দেশ্যে।
মহামারীর এই দুর্দিনে সামর্থ্যবানেরা দরিদ্র-অসহায় মানুষের দিকে সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।
বরকতময় এই মাহে রমজানে ক্ষুধার্ত, গরিব রোজাদারদের খাদ্য ও ইফতারির ব্যাবস্থা করে অফুরন্ত নেকীর পাশাপাশি আল্লাহর সন্তুষ্টি কুড়িয়ে নেয়ার এই সুযোগকে আমাদের কাজে লাগানোর চেষ্টা করতে হবে।
-এটি