মুহাম্মদ নাজমুল ইসলাম ইসহাকী।।
ফারসি শব্দ রোজার আরবি অর্থ হচ্ছে সওম, বহুবচনে সিয়াম। সওম বা সিয়ামের বাংলা অর্থ বিরত থাকা। ইসলামী শরীয়তে সওম হল আল্লাহর নির্দেশ পালনের উদ্দেশে নিয়তসহ সুবহে সাদিকের শুরু থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকা।
২য় হিজরীর শাবান মাসে মদীনায় রোজা ফরজ সংক্রান্ত আয়াত নাজিল হয় “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হলো যেভাবে তা ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে তোমরা সংযমী হও”। (সূরা বাকারা, আয়াত-১৮৩)।
ফরজ বিধান এই রোজা সঠিকভাবে পালন করতে হলে জানতে হবে কোন অবস্থায় রোজা ভঙ্গ হয়ে যায়, আবার কোন অবস্থায় রোজা ভঙ্গ হয় না। অর্থাৎ রোজার যাবতীয় বিধি-বিধান জানা একজন মুমিনের অবশ্য কর্তব্য। তাই আজকে আমি রোজার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মাসয়ালা আপনাদের সামনে তুলে ধরবো।
১. ইনজেকশন (Injection):
ইনজেকশন নিলে রোজা ভাঙ্গবে না। (জাওয়াহিরুল ফতওয়া)
২. ইনহেলার (Inhaler):
শ্বাসকষ্ট দূর করার লক্ষ্যে তরল জাতীয় একটি ঔষধ স্প্রে করে মুখের ভিতর দিয়ে গলায় প্রবেশ করানো হয়, এভাবে মুখের ভিতর ইনহেলার স্প্রে করার দ্বারা রোজা ভেঙ্গে যাবে। (ইমদাদুল ফতওয়া)
৩. এনজিওগ্রাম (Angio Gram):
হার্ট বøক হয়ে গেলে উরুর গোড়া দিয়ে কেটে বিশেষ রগের ভিতর দিয়ে হার্ট পর্যন্ত যে ক্যাথেটার ঢুকিয়ে পরীক্ষা করা হয় তার নাম এনজিওগ্রাম। এ যন্ত্রটিতে যদি কোনো ধরনের ঔষধ লাগানো থাকে, তারপরেও রোজা ভাঙ্গবে না।
৪. এন্ডোসকপি (Endos Copy):
চিকন একটি পাইপ, যার মাথায় বাল্ব জাতীয় একটি বস্তু থাকে। পাইপটি পাকস্থলিতে ঢুকানো হয় এবং বাইরে থাকা মনিটরের মাধ্যমে রোগীর পেটের অবস্থা নির্ণয় করা হয়। এই নলে যদি কোন ঔষধ ব্যবহার করা হয় বা পাইপের ভিতর দিয়ে পানি/ঔষধ ছিটানো হয়ে থাকে তাহলে রোজা ভেঙ্গে যাবে, আর যদি কোন ঔষধ লাগানো না থাকে তাহলে রোজা ভাঙ্গবে না। (জাদীদ ফিকহী মাসায়েল)
৫. লেপারোসকপি (Laparoscopy):
শিক্ জাতীয় একটি যন্ত্র দ্বারা পেট ছিদ্র করে পেটের ভিতরের কোন অংশ বা গোশত ইত্যাদি পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে বের করে নিয়ে আসার জন্য ব্যবহৃত যন্ত্র। এতে যদি ঔষধ লাগানো থাকে তাহলে রোজা ভেঙ্গে যাবে অন্যস্থায় রোজা ভাঙ্গেব না। (আল মাকালাতুল ফিকহীয়া)
৬. অক্সিজেন (OXzgen):
রোজা অবস্থায় ঔষধ ব্যবহৃত অক্সিজেন ব্যবহার করলে রোজা ভেঙ্গে যাবে। তবে শুধু বাতাসের অক্সিজেন নিলে রোজা ভাঙ্গবে না। (জাদীদ ফিকহী মাসায়েল)
৭. মস্তিষ্ক অপারেশন (Brain Operation):
রোজা অবস্থায় মস্তিষ্ক অপারেশন করে ঔষধ ব্যবহার করা হোক বা না হোক রোজা ভাঙ্গবে না। (আল মাকালাতুল ফিকহীয়া)
৮. রক্ত নেয়া বা দেয়া:
রোজা অবস্থায় শরীর থেকে রক্ত বের করলে বা শরীরে প্রবেশ করালে রোজা ভাঙ্গবে না। (আহসানুল ফতওয়া)
৯. সিস্টোসকপি (cystoscop):
প্রসাবের রাস্তা দিয়ে ক্যাথেটার প্রবেশ করিয়ে যে পরীক্ষা করা হয় এর দ্বারা রোজা ভাঙ্গবে না। (হেদায়া)
১০. প্রক্টোসকপি (proctoscopy):
পাইলস, অর্শ, ইত্যাদি রোগের পরীক্ষাকে প্রক্টোসকপি বলে। মলদ্বার দিয়ে নল প্রবেশ করিয়ে পরীক্ষাটি করা হয়। রোগী যাতে ব্যথা না পায় সে জন্য নলের মধ্যে গ্লিসারিন জাতীয় কোন পিচ্ছিল বস্তু ব্যবহার করা হয়। নলটি পুরোপুরি ভিতরে প্রবেশ করে না। চিকিৎসকদের মতানুসারে ঐ পিচ্ছিল বস্তুটি নলের সাথে মিশে থাকে এবং নলের সাথেই বেরিয়ে আসে, ভেতরে থাকে না। আর থাকলেও তা পরবর্তীতে বেরিয়ে আসে। যদিও শরীর তা চোষে না কিন্তু ঐ বস্তুটি ভিজা হওয়ার কারণে রোজা ভেঙ্গে যাবে। (ফতওয়া শামী)
১১. কপার-টি (Coper-T):
কপার-টি বলা হয় যোনিদ্বারে প্লাস্টিক লাগানোকে, যেন সহবাসের সময় বীর্যপাত হলে বীর্য জরায়ুতে পৌঁছাতে না পারে। এ কপার-টি লাগিয়েও সহবাস করলে রোজা ভেঙ্গে যাবে। কাযা কাফফারা উভয়টাই ওয়াজিব হবে। (দেখতে পারেন মুফতি তাকি ওসমানির রমজানের ৩০ টি মাসআলা)
১২. ডি এন্ড সি (Dilatation and Curettage):
ডি এন্ড সি হল গর্ভধারণের আট থেকে দশ সপ্তাহের মধ্যে উরষধঃড়ৎ এর মাধ্যমে জীবিত কিংবা মৃত বাচ্চাকে মায়ের গর্ভ থেকে বের করে নিয়ে আসা। এতে রোজা ভেঙ্গে যাবে। অযথা এমন করলে কাযা কাফফারা উভয়টি দিতে হবে এবং তওবা করতে হবে। (হেদায়া)
১৩. এম আর (M.R):
এম আর হল গর্ভ ধারণের পাঁচ থেকে আট সপ্তাহের মধ্যে যোনিদ্বার দিয়ে জরায়ুতে এম আর সিরিঞ্জ প্রবেশ করিয়ে জীবিত কিংবা মৃত ভ্রণ নিয়ে আসা। যার পর ঋতু¯্রাব পুণরায় হয়। অতএব মাসিক শুরু হওয়ার কারণে রোজা ভেঙ্গে যাবে এবং কাযা করতে হবে। কিন্তু যদি রাতের বেলা করা হয় তাহলে দিনের রোজা কাযা করতে হবে না। (ফতহুল কাদীর)
১৪. স্যালাইন (Saline):
স্যালাইন নেয়া হয় রগে, আর রগ যেহেতু রোজা ভঙ্গ হওয়ার গ্রহণযোগ্য রাস্তা নয়, তাই স্যালাইন নিলে রোজা ভাঙ্গবে না, তবে রোজার কষ্ট লাঘবের জন্য স্যালাইন নেয়া মাকরূহ। (ফতওয়ায়ে দারুল উলূম)
১৫. টিকা নেয়া (Vaccine):
টিকা নিলে রোজা ভাঙ্গবে না। কারণ, টিকা রোজা ভঙ্গ হওয়ার গ্রহণযোগ্য রাস্তায় ব্যবহার করা হয় না।(দেখতে পারেন মুফতি তাকি ওসমানির ৩০ টি মাসআল)
১৬. ঢুস (Douche):
ঢুস মলদ্বারের মাধ্যমে দেহের ভিতরে প্রবেশ করে, তাই ঢুস নিলে রোজা ভেঙ্গে যাবে। ঢুস যে জায়গা বা রাস্তা দিয়ে প্রবেশ করে এ জায়গা বা রাস্তা রোজা ভঙ্গ হওয়ার গ্রহণযোগ্য স্থান । (ফতওয়ায়ে শামী)
১৭. ইনসুলিন গ্রহণ করা: (Insulin):
ইনসুলিন নিলে রোজা ভাঙ্গবে না। কারণ, ইনসুলিন রোজা ভঙ্গ হওয়ার গ্রহণযোগ্য রাস্তা দিয়ে প্রবেশ করে না এবং গ্রহণযোগ্য খালি জায়গায় প্রবেশ করে না। (জাদীদ ফিকহী মাসায়েল)
১৮. দাঁত তোলা:
রোজা অবস্থায় একান্ত প্রয়োজন হলে দাঁত তোলা জায়েজ আছে। তবে অতি প্রয়োজন না হলে এমনটা করা মাকরূহ। ঔষধ যদি গলায় চলে যায় অথবা থুথু থেকে বেশি অথবা সমপরিমাণ রক্ত যদি গলায় যায় তাহলে রোজা ভেঙ্গে যাবে। (আহসানুল ফতওয়া)
১৯. পেস্ট, টুথ পাউডার ব্যবহার করা:
রোজা অবস্থায় দিনের বেলায় টুথ পাউডার, পেস্ট, মাজন ইত্যাদি ব্যবহার করা মাকরূহ। কিন্তু গলায় পৌঁছালে রোজা ভেঙ্গে যাবে। (জাদীদ ফিকহী মাসায়েল)
লেখক: চরমোনাই কওমি মাদরাসা
-এটি