শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
১৬ টি বছর জুলুম-ষড়যন্ত্রের মধ্যে ছিল মাদরাসার ছাত্ররা: ড. শামছুল আলম  ‘সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায় সংস্কার কমিশন’ জমিয়ত সভাপতি মাওলানা মনসুরুল হাসানের ইন্তেকালে খেলাফত মজলিসের শোকপ্রকাশ কাল ১০ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায় রোজায় বাজার সহনশীল রাখার চেষ্টা করা হবে: বাণিজ্য উপদেষ্টা মাওলানা মনসুরুল হাসান রায়পুরীর ইন্তেকালে বিএনপি মহাসচিবের শোক রাষ্ট্রপতি নির্বাচনসহ যেসব সুপারিশ সংস্কার কমিশনের বাংলাদেশিদের সুখবর দিলো ইতালি, পুনরায় ভিসা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হাসিনা ও তার দোসরদের পুনর্বাসনে কোনো সাফাই নয়: সারজিস মাওলানা মনসুরুল হাসান রায়পুরীর ইন্তেকালে সিলেট মহানগর জমিয়তের শোক

করোনা সংকট: শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলাম

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

উবায়দুল্লাহ তাসনিম

করোনায় বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছে মানুষ। কল-কারখানা সব বন্ধ৷ রুদ্ধ শ্রমিক জনতার রোজগারপথ । এমন দুর্দিনে তাদের পরিবার চালানো কঠিন৷ এর মাঝে বেতন বাকি। সবমিলিয়ে দুঃসহ অবস্থা!

আমাদের পোশাক কারখানার মালিকদের পুরনো স্বভাব এটা। শ্রমিকদের বেতন বাকি রাখা। বেতন না পেয়ে শ্রমিকদের ধর্মঘট এটাও বাংলাদেশের চিরচেনা একটা ব্যাপার। এ সময়কার নিউজে প্রায়ই শ্রমিকদের রাস্তায় বিক্ষোভের দৃশ্য মিডিয়াতে আসছে। এই তো গত রবিবারের খবর প্রণোদনা ঘোষণার পাশাপাশি সরকারের হুশিয়ারির পরও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ৩৭০টি কারখানার মালিক তাদের শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করেননি বলে জানিয়েছে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর।

মহামারী করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে ছুটির ও অচলাবস্থার পরিস্থিতিতে গত ১৩ এপ্রিল শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান হুশিয়ারি দিয়ে কারাখানা মালিকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ১৬ এপ্রিলের মধ্যে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করতে হবে। ওই তারিখের মধ্যে বেতন দিতে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট মালিকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এরপর ১৬ এপ্রিলের মধ্যে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করার প্রতিশ্রুতি দেন কারখানা মালিকরা। কিন্তু প্রণোদনা ঘোষণার পাশাপাশি সরকারের হুশিয়ারির পরও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি কারখানার মালিকরা।'

নরসিংদীর মাধবদীতে বেতনের দাবিতে বিক্ষোভ করেছে জজ ভূঁইয়া গ্রুপের জেএস লিংক পোশাক কারখানার শ্রমিকরা।

রোববার (১৯ এপ্রিল) সকালে এ বিক্ষোভ করে কারখানার শ্রমিকরা। এ সময় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে গাছ ফেলে অবরোধ করে তারা। এতে মালবাহী গাড়ির দীর্ঘ যানজট তৈরি হয়।

জানা গেছে, ফেব্রুয়ারি মাস থেকে এ পর্যন্ত বেতন না দেয়ায় এই বিক্ষোভ করে শ্রমিকরা। বর্তমানে শ্রমিকরা অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে।

শ্রম আর শ্রমিক সমাজ ব্যবস্থা সচল রাখার দু'টি গুরত্বপূর্ণ উপাদান। যে উপাদানের সাথে জড়িয়ে আছে সমাজের গতিশীলতার মূল নিয়ামক উৎপাদন ব্যবস্থা। যা অর্থনীতির চালিকাশক্তি। শ্রম আর শ্রমিক না থাকলে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়বে। অচল হয়ে পড়বে আর্থ- সামাজিক ব্যবস্থা। আজকের করোনা সংকট এর টাটকা প্রমাণ।

শ্রম ও শ্রমিক এ দু'টো বিষয় ততক্ষণ ভালোরকম সচল থাকবে, যতক্ষণ তাদের ন্যায্য অধিকার বহাল থাকবে। যতক্ষণ তারা তাদের শ্রমের যথাযথ মূল্য পাবে। এর বিপরীত হলে শ্রম আর শ্রমিক ব্যবস্থা গৌণ হয়ে পড়বে।

ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রম

ইসলাম সামগ্রিক জীবনব্যবস্থা হিসেবে তাই শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় অপূর্ব অবদান রেখেছে। ইসলাম শ্রমিকের শ্রমের যথাযথ মূল্য দিয়েছে।

শ্রম আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার মৌলিক একটি উপাদান, শ্রম যা দারিদ্র মোকাবেলার প্রতিনিধিত্ব করে৷ শ্রম সম্পদ উপার্জনের প্রধান মাধ্যম। পৃথিবীতে ইবাদতের জন্য আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে তার প্রতিনিধি বানিয়ে বসবাস করতে পাঠিয়েছেন। সালেহ আ এর উদ্ধৃতি দিয়ে পবিত্র কুরানের ইরশাদ,

قَوْمِ ٱعْبُدُوا۟ ٱللَّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَٰهٍ غَيْرُهُۥهُوأَنشَأَكُم مِّنَ ٱلْأَرْضِ وَٱسْتَعمزكم فيها

হে আমার জাতি। তোমরা আল্লাহর বন্দেগী (ইবাদত) কর, তিনি ছাড়া তোমাদের কোন উপাস্য নাই। তিনিই যমিন হতে তোমাদেরকে পয়দা (সৃষ্টি)করেছেন, তন্মধ্যে তোমাদেরকে বসতি দান করেছেন। (সূরা হুদ ৬১)

পৃথিবীতে বসবাসের জন্য প্রয়োজন শ্রমের মাধ্যমে সম্পদ উপার্জন করে দারিদ্র মোকাবেলার। তাই শ্রমের গুরত্ব অপরিসীম।

পৃথিবীর আলো-বাতাসে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে জীবিকা অর্জন অপরিহার্য একটা ব্যাপার। জীবিকা অর্জনের ব্যাপারে কুরআনে তাগিদ এসেছে,

هُوَ ٱلَّذِى جَعَلَ لَكُمُ ٱلْأَرْضَ ذَلُولًا فَٱمْشُوا۟ فِى مَنَاكِبِهَا وَكُلُوا۟ مِن رِّزْقِهِۦ وَإِلَيْهِ ٱلنُّشُورُ

তিনি তোমাদের জন্যে পৃথিবীকে সুগম করেছেন, অতএব, তোমরা তার কাঁধে বিচরণ কর এবং তাঁর দেয়া রিযিক আহার কর। তাঁরই কাছে পুনরুজ্জীবন হবে।(সূরা,মূলক১৫)

হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে,নিজহাতে কাজ করার মাধ্যমে উপার্জিত খাদ্যের চেয়ে অন্য কোন পবিত্র খাদ্য নেই।(বুখারি)

শ্রম সেই জীবিকা অর্জনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই শ্রমের বিকল্প নাই। জীবিকা-শ্রমের গুরত্ব এতটাই ইসলাম দিয়েছে যে, নিজের ভূখন্ডে কর্মসংস্থান না হলে প্রবাসে শ্রম প্রদান করতে বলা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, وَمَن يُهَاجِرْ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ يَجِدْ فِىٱلْأَرْضِ مُرَٰغَمًا كَثِيرًا وَسَعَةً

যে কেউ আল্লাহর পথে দেশত্যাগ করে, সে এর বিনিময়ে অনেক স্থান ও সচ্ছলতা প্রাপ্ত হবে। (সূরা নিসা১০০) হাদিসে এসেছে,سافروا تستغنوا প্রবাসে যাও ধনী হতে পারবে।(তাবরানী, আওসাত)

নবী-রাসূলগণ নিজ হাতে কাজ করেছেন। হাকেম রা ইবনে আব্বাসের সূত্রে বর্ণণা করেছেন, দাউদ আ ছিলেন লৌহবর্ম প্রস্তুতকারক, আদম আ ছিলেন চাষী, নূহ আ ছিলেন কাঠ মিস্ত্রি, ইদরিস আ ছিলেন দর্জি, মূসা আ ছিলেন রাখাল।(মুস্তাদরাকে হাকেম)

রাসূল সা শ্রমিক হিসেবে কাজ করে ছিলেন। পারিশ্রমিকের বিনিময়ে খাদিজা রা এর ব্যবসার পণ্য নিয়ে দূরে গিয়েছেন। আলী রা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন। উমর রা শ্রমিক হয়ে ছাগল ছড়িয়েছেন। বিখ্যাত সাহাবী ইবনে মাসউদসহ অনেকেই শ্রমিক হিশেবে কাজ করেছেন।

ইসলামে শ্রমিকের মর্যাদা

বস্তুবাদের পৃথিবীতে শ্রেণী বৈষম্যের ব্যাপারটা খুব প্রকট। বিত্তশালী শ্রেণীটির কাছে শ্রমিক প্রশ্নটা তুচ্ছ, নগন্য বিষয়। সমাজে শ্রমিক শ্রেণীটি অবহেলিত। অনেক ক্ষেত্রে নিষ্পেষিত। অথচ ইসলামে শ্রেণী বৈষম্যের ধারণা ইসলামে প্রত্যাখ্যাত। ইসলামে মর্যাদার মাপকাঠি তাকওয়া-পরহেযগারী।

নিশ্চই আল্লাহর নিকট সে-ই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত, সে সর্বাধিক তাকওয়ার অধিকারী' (সূরা হুজুরাত,১৩)

ইসলামে শ্রমিকের যেই মর্যাদা ও অধিকার রয়েছে, এর নজির তুলনাবিহীন। শ্রমিককে ভাইয়ের মর্যাদা দিয়েছে । শ্রমিক আর মালিকের মাঝে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক কায়েম করতে চেষ্টা করেছে । মালিক-শ্রমিক দু' পক্ষে সমান অধিকার নিশ্চিত করতে চেয়েছে। রাসূল সা ইরশাদ করেন, তোমাদের দাসরা(শ্রমিক) তোমাদের ভাই। যার অধীনে তার (শ্রমিক) ভাই রয়েছে, সে যেনো শ্রমিককে তাই খাওয়ায়, যা সে নিজে খায়, তাকে তাই পরায়, যা সে নিজে পরে। তাদের জন্য প্রচন্ড কষ্টকর হয় এমন কাজে তোমরা তাদের বাধ্য করো না। কখনো যদি ভারী কাজ করাতে হয়, তাহলে তোমরা সেই কাজে তাকে সাহায্য করো।(বুখারি,৩০)

অন্য হাদিসে আছে, তোমরা যা খাবে, তাদেরকে তাই খাওয়াবে, যা পরবে, তাদেরকে তাই পরাবে, তোমরা আল্লাহর সৃষ্টিকে(দাস-শ্রমিক) (অন্যায়ভাবে) কষ্ট দিবে না।( মুসলিম,১৬৬১)

ইসলাম শ্রমিকের শ্রম হ্রাস করার পক্ষে। মালিকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে, শ্রমিকের কাজ যথাসম্ভব কমিয়ে দিতে। রাসূলুল্লাহ সা ইরশাদ করেছেন,

তুমি শ্রমিকের যে পরিমাণ কাজ কমিয়ে দিবে, সে পরিমাণ সওয়াব তোমার আমলনামায় জমা হবে। (ইবনে হিব্বান, ২৩১৪,আবু ইয়ালা,১৪৭২)

ইসলামে শ্রমিকের অধিকার

ইসলাম শ্রমিকের কাজের যথাযোগ্য মূলায়ন করেছে। শরীরের ঘাম শুকানোর পূর্বেই তার পারিশ্রমিক আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নবীজি সা ইরশাদ করেছেন, তোমরা শ্রমিকের ঘাম শুকানোর পূর্বেই তার পারিশ্রকটা দিয়ে দাও।( ইবনে মাজাহ, ২৪৪৩)

শ্রমিকের অধিকার না আদায়ের ব্যাপারে কঠোর ধমকি এসেছে হাদিসে।আল্লাহ কিয়ামত দিবসে শ্রমিকের পক্ষ নিবেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, কিয়ামতের দিন আমি তিন ব্যক্তির প্রতিপক্ষ হবো।...৩. যে ব্যক্তি শ্রমিককে কাজে লাগিয়ে কাজ উদ্ধার করার পর তার পারিশ্রমিক দেয় না। (বুখারি,২১১৪, ইবনে মাজাহ, ২৪৪২, মুসনাদে আবু ইয়ালা, ৬৪৩৬)

মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক

আজকাল মালিক শ্রমিকের সম্পর্ক স্বার্থপরতায় কলুষিত। পারস্পরিক হৃদ্যতার ছোঁয়া নেই। মালিক শ্রেণীটি বিশেষ করে ঝুলুম করে। অসৎ ব্যবহার করে। অথচ আগেও উল্লেখ করেছি, ইসলাম মালিক শ্রমিকের ভাই ভাই সম্পর্কে বিশ্বাসী। রাসূলুল্লাহ সা খাদেম- শ্রমিকের সংগে সৎ ব্যবহার করেছেন। শ্রমিককে কখনো প্রহার করেননি।হাদিসের ইরশাদ, রাসূলুল্লাহ সা কখনো নিজ হাতে কোন নারী, কোন খাদেমকে প্রহার করেননি। (মুসলিম, ২৩২৮ সুনানে আবু দাউদ, ৪৭৮৬, ইবনে মাজাহ, ১৯৮৪)

বছরের পর বছর খেদমতের সময়কালে খাদেম অসন্তুষ্ট হয়, এমন কোন আচরণ করেননি রাসূল সা। আনাস রা থেকে বর্ণিত, আমি দশটি বছর রাসূল সা এর খেদমত করেছি। তিনি কোনদিন আমার ব্যাপারে 'উফ' শব্দটা উচ্চারণ করেননি। (অবাঞ্চিত)কোন কাজ করে বসলে বলেননি, এটা কেন করেছ? (যে কাজ করা উচিত ছিল এমন) কোন কাজ না করলে বলেননি, এটা কেনো করলে না?(বুখারি, ২৭৬৮, মুসলিম, ২৩০৯তিরমিযি, ২০১৫, সুনানে আবু দাউদ, ৪৭৭৩ মুসনাদে আহমদ, ১১৫৭৭)

অন্যদেরকেও অধীনস্থ লোকজনের সাথে সুন্দর ব্যবহার, কষ্ট না দেওয়ার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। মানবতা, আন্তরিকতার কথা বলেছেন, তোমরা অধীনস্থদের সাথে সদ্ব্যবহার করবে। তাদেরকে কোন রকমের কষ্ট দিবে না। তোমরা কি জানো না? তাদেরও তোমাদের ন্যায় একটি হৃদয় আছে। ব্যথাদানে তারা দুঃখিত হয়, এবং কষ্টবোধ করে। আরাম ও শান্তি প্রদান করলে সন্তুষ্ট হয়৷ তোমাদের কি হয়েছে যে তোমরা তাদের প্রতি আন্তরিকতা প্রকাশ করো না?

একদিন এক সাহাবি এসে নবি করিম সা কে জিজ্ঞাসা করলেন, হুজুর, চাকর খাদেমদের অপরাধ কতোবার ক্ষমা করবো? (ঘটনা বর্ণাণাকারী বলেন) নবি করিম সা তা শুনে চুপ করে রইলেন। সেই সাহাবি পুনরায় আবার এ কথা জিজ্ঞাসা করলেন, তখন রাসূল সা ব্যাকুল হয়ে বলে উঠলেন,(কতোবারের কথা জিজ্ঞেস করছো?) প্রতিদিন সত্তরবার হলেও তাকে ক্ষমা করে দিও।

লেখক: তাকমিল, জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া মুহাম্মপুর, ঢাকা।

ওআই/আবদুল্লাহ তামিম


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ