তৈয়ব উল্লাহ নাসিম
বৈশ্বিক মহামারী করোনায় আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশের অবস্থাও কার্যত বিপর্যস্ত। দীর্ঘ পঁচিশ দিন থেকে লকডাউনের কবলে সারাদেশ। জনগণের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করেই কার্যত এই লকডাউনের ঘোষণা। এরমধ্যে গত ছয় এপ্রিল মসজিদগুলোও এক রকম লকডাউনের আওতায় এসে পড়ে।
ধর্ম মন্ত্রনালয় থেকে এই দিন আদেশ জারি করা হয়, পাঞ্জেগানা নামাজে পাঁচজন ও জুমায় দশজন মুসল্লী সীমিত করণের। তখন থেকেই মূলত মসজিদগুলো একরকম বন্ধ থাকার মতো অবস্থায়। ইতিমধ্যে বাজার ঘাট ইত্যাদিতে জনসাধারণের অবাধ বিচরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাই বিভিন্ন মহল থেকে সচেতন মানুষ ও ওলামায়ে কেরাম সতর্কতামূলক পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন সাপেক্ষে মসজিদগুলো উন্মুক্ত করে দেয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন।
এ ধারাবাহিকতায় দেশের শীর্ষ মুফতী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক নির্বাচিত পাঁচজন ফতোয়াবীদের একজন, শায়খ জাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের সম্মানিত মহাপরিচালক, আল্লামা মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ সরকার সমীপে মসজিদগুলো উন্মুক্ত করে দেয়ার জন্য দীর্ঘ একটি প্রস্তাবনা পেশ করেন। এতে তিনি ১২ দফা সুপারিশমালা পেশ করেছেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি আমাকেও পাঠিয়েছেন, এবং তাঁর ফেসবুক ওয়ালেও তা প্রকাশ করেছেন। নিম্নে আওয়ার ইসলামের পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো।
করোনা ভাইরাস এমন একটি মহামারী রোগ যার প্রকোপে সারা বিশ্ব আজ স্তব্ধ । আমাদের প্রিয় বাংলাদেশও কঠিন ঝুঁকিতে আছে। দিন দিন আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এমতাবস্থায় দেশ ও জাতির এ মহামারী থেকে বাঁচার একমাত্র পন্থা পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার কাছে আত্মসমর্পণ করা , খালেস অন্তরে সকল অপরাধ অন্যায় জুলুম পাপাচার অশ্লীলতা বেহায়াপনা এককথায় সকল গুনাহ থেকে তাওবা ও ইসতিগফার করা।
এর পাশাপাশি সকলের কর্তব্য হচ্ছে সরকার এবং WHO(বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)এর সকল দিকনির্দেশনা আন্তরিকভাবে মেনে চলে ঘরে অবস্থান করা এবং সকল গণসমাগম ও গণজমায়েত বর্জন করে চলা। ইতিমধ্যে আমাদের সামনে আগত মহাপবিত্র আলকোরানের মাস রমজান।
যার আগমন রহমত, বরকত ও মাগফিরাত নিয়ে । সিয়াম সাধনা, খতমে কুরআন, সেহরী ইফতার, দান-দক্ষিণা, যাকাত প্রদানসহ তারাবীর নামাজ, রমজান শেষে ঈদের নামাজ বিশেষভাবে পালন করতঃ এই পবিত্র মাসের সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান ও মূল্যায়ন করা ঈমান ও সময়ের দাবী। করোনা ভাইরাসের বিস্তার থেকে সর্বাধিক সতর্কতা অবলম্বনপূর্বক এই মহতি মাসের বিশেষ ইবাদতগুলো পালন করে আল্লাহর করুণা ও সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে সরকার মহোদয়ের নিকট কয়েকটি জরুরী প্রস্তাবনা নিচে উপস্থাপন করা হলো।
ওলামামাশায়েখের পক্ষ থেকে সরকার মহোদয়ের নিকট কয়েকটি জরুরি প্রস্তাবনা।
এক. পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জামাত, জুমা, তারাবী মসজিদে আদায় করার জন্য পাঁচজন, দশজনের সংখ্যা বাধ্যতামূলক না করে সীমিত লোকদের সুযোগ করে দেয়া হোক।
পনেরো বছরের উপরের পঞ্চাশ বছরের নীচের লোকজন যারা অসুস্থ নন, শারীরিকভাবে দুর্বল নন, হাঁচি, কাশি বা জ্বরে আক্রান্ত নন, করোনায় আক্রান্ত কোনো লোকের সংস্পর্শে ছিলেন না, বা কোনো রোগীর সেবা খেদমতে নিয়োজিত নন, শুধু এ ধরণের লোকদের জন্য অন্তত মাহে রমজান উপলক্ষে মসজিদকে বাধা মুক্ত করে দেয়া হোক।
দুই. যারা মসজিদে আসবেন তাদের জন্য নিম্নোক্ত নিয়মাবলী মানা আবশ্যক-
ক. মসজিদে আসার পূর্বে বিশ সেকেন্ড সাবান দিয়ে উভয় হাত ধৌত করবে।
খ. প্রত্যেক নামাজের জন্য ঘরেই অজু করে আসবে।
গ. অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করবে।
ঘ. নামাজের আগে-পরে সুন্নাতসমূহ অবশ্যই ঘরে পড়বে।
ঙ. নামাজের পূর্বে ও পরে এবং আসা যাওয়ার সময় সকল ধরনের গণজমায়েত ও গণসমাবেশ থেকে অবশ্যই বিরত থাকবে।
চ. মসজিদ প্রশস্থ হলে তারাবীর নামাজ ভিতরে পড়বে, অন্যথায় মসজিদে উন্মুক্ত জায়গা বা বারান্দা থাকলে সেখানে আদায় করা বাঞ্ছনীয়। রাস্তাঘাট বা ফুটপাতে জামাত করা থেকে বিরত থাকবে।
তিন. সকল মসজিদের ফ্লোর জীবাণুনাশক দিয়ে প্রতি নামাজের পর পর ধৌত করা আবশ্যক। মসজিদের কার্পেট সরিয়ে ফেলতে হবে। প্রত্যেক মুসল্লী নিজ নিজ পরিষ্কার জায়নামাজ সাথে নিয়ে মসজিদে আসতে পারে।
চার. নামাজীগণ কাতারবন্দী হওয়ার ক্ষেত্রে WHO (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা) এর দেয়া দিকনির্দেশনা মোতাবেক নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা জরুরি। যেমন, কাতারে পরস্পর এক ফুট থেকে সর্বোচ্চ তিন ফুট ফাঁক রেখে দাঁড়াতে পারবে। দুই কাতারের মাঝে ছয় ফুট পরিমাণ জায়গা খালি রাখা আবশ্যক। প্রথম কাতারে দাঁড়ানো নামাজীর বরাবর পেছনের কাতার খালি রাখবে, এবং প্রথম কাতারের খালি জায়গাগুলো বরাবর পেছনের কাতারের নামাজী দাঁড়াবে।
উল্লেখ্য, WHO ইতিমধ্যে নামাজের ক্ষেত্রে এভাবে দূরত্ব রাখা হলে করোনা বিস্তার থেকে নিরাপদ থাকা যাবে বলে মতামত দিয়েছেন বলে জানা গিয়েছে । তাই মুসল্লীদের সুরক্ষার স্বার্থে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মসজিদে কাতার করা ও স্থান চিহ্নিত করার ভূমিকা রাখতে পারেন।
পাঁচ. নামাজীগণ মুসাফাহা, মুয়ানাকা থেকে বিরত থাকবে। মসজিদে অবস্থানকালেও নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে বসবে পাশাপাশি হাত দিয়ে মুখমণ্ডলি স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকবে।
ছয়. ইমাম ও খতীব ও হাফেয সাহেবগন মসজিদে পাঞ্জেগানা নামাজ, জুমা, খুতবা ও তারাবী সংক্ষিপ্তভাবে আদায় করবে। এক্ষেত্রে বিশ রাকাত তারাবী সংক্ষিপ্ত সূরা দিয়েও আদায় করা যেতে পারে। খতমে তারাবীর ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে না করে বিশেষ বিশেষ মসজিদগুলোতে করা যেতে পারে। একাধিক খতমে তারাবী পড়তে ইচ্ছুকগণ নিজ গৃহে, বাসস্থানে সুরক্ষার জাবতীয় নিয়ম পালন করতঃ খতমে তারাবীর ব্যবস্থা করতে পারেন।
সাত. মসজিদের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে সেহরী-ইফতারের ব্যবস্থা করা পরিহার করতে হবে। শুধুমাত্র নামাজের জামাত চলাকালীন সময়ে মুসল্লীগণ মসজিদে উপস্থিত থাকবেন। সঙ্কটময় অবস্থার উন্নতি না হলে রমজানের শেষ দশদিনে ব্যাপকভাবে একসাথে এ'তেকাফ করা উচিত হবে না। তবে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে সীমিত সংখ্যক লোক সুন্নাত এ'তেকাফ পালন করবে।
আট. পবিত্র ঈদুল ফিতরের জামাত উল্লিখিত নিয়মনীতি অবলম্বন করতঃ পালিত হবে। প্রয়োজনে বড় জামাতগুলোকে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে খোলা মাঠে আদায় করা যেতে পারে।
নয়. মসজিদে নামাজ আদায়ের উপরোক্ত নিয়মনীতিগুলো পালন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মসজিদ ভিত্তিক ‘মুসল্লীকল্যাণ কমিটি’ গঠন করা আবশ্যক। যেখানে ইমাম, খতীব, মুয়াজ্জিন তিনজন, কমিটির সভাপতি ও সেক্রেটারি দুইজন, মসজিদের সচেতন মুসল্লী তিনজন করে মোট আট জনের সমন্বয়ে উক্ত কমিটি গঠন করা যেতে পারে। তারা এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে যোগাযোগ রেখে দায়িত্ব পালন করবে; এবং প্রশাসনও তাদের সার্বিক সহযোগিতা করে যাবে।
দশ. দেশের কোন বিশেষ এলাকা বা মহল্লাতে আল্লাহ না করুন করোনাপরিস্থি মারাত্মক আকার ধারণ করলে শুধুমাত্র সেই মহল্লায় সরকার নামাজে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে ভিন্ন পলিসি গ্রহণ করতে পারবে।
[১১] জুমা' জামাত ও তারাবীর নামাজ চলাকালীন ইমামের আওয়াজ অনুসরণ,অনুকরণে বা অনলাইন অথবা টিভিতে নামাজ সরাসরি সম্পচার করা হলে তা অনুসরণ করে বাসায় বসে একতেদা করে নামাজ আদায় করলে নামাজ হবে না।
বারো. বর্তমান সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে সবগুলো দেশের অবস্থা অভিন্ন নয়। তাই প্রত্যেক দেশের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে জুমা, জামাত ও তারাবীর বিষয়টি স্বতন্ত্র। সুতরাং আমাদের বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভিন্ন কোনো দেশের রেফারেন্স টেনে আনা কখনোই সঠিক হতে পারে না, বরং চলমান পরিস্থিতিতে আমাদের দেশের জন্য উপরোক্ত প্রস্তাবনাবলীর বাস্তবায়ন কোরান সুন্নাহের আলোকে সঠিক বলে বিজ্ঞ উলামা মাশাইখের সিদ্ধান্ত। বিষয়টি সরকার মহোদয়কে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা উচিত।
উপরোক্ত নিয়মনীতিগুলো বাস্তবায়ন করা কোন বিশেষ এক ব্যক্তির দায়িত্বাধীন নয়, এবং একক প্রশাসনের জন্যও তা সম্ভব নয়; বরং প্রত্যেক মুসলমান নিজ নিজ দায়িত্বে নীতিমালাগুলো অবলম্বন করে ইবাদত পালন করতে হবে। আল্লাহ না করুন, উপরোক্ত নীতিমালা লঙ্ঘিত হলে, আল্লাহর ইচ্ছায় মসজিদের নামাজীদের উপর কোনো বিপদ নেমে আসলে তার দায়ভার মুসল্লীদের উপর চাপানো হতে পারে। আল্লাহ্ হেফাজত করুন।
নোট: বিষয়টি আহলে ইলম ও বিশেষজ্ঞ দের বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করা হলো।
প্রস্তাবক: মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ, প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও প্রধান মুফতি, শাইখ যাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, ঢাকা।
ওআই/আবদুল্লাহ তামিম