মুফতি আমিমুল ইহসান।।
নভেল করোনাভাইরাস (কভিড-১৯) বিশ্বকে ভীতসন্ত্রস্ত করে রেখেছে প্রায় চার মাস। চীন থেকে শুরু হয়ে বর্তমানে বিশ্বের ২০৩টি দেশের মানুষের মধ্যে এই মরণব্যাধি ভাইরাস বিস্তার লাভ করেছে। এ মহামারি হতে বাঁচার জন্য বিশ্ববাসী আকাশপানে তাকিয়ে আছে। মুসলিমরা মহান আল্লাহর দরবারে এ ভাইরাস হতে মুক্তির জন্য দুআ করছে।
বাংলাদেশের মানুষও এ ভীতির বাহিরে নয়। ইতোমধ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অন্যান্য দেশের ন্যায় পুরো বাংলাদেশকে লকডাউন ঘোষণা করেছে। সরকারি-বেসরকারি সব শিক্ষা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দুই দফায় ১১ এপ্রিল পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
নভেল করোনাভাইরাসে ২ এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে আক্রান্তের সংখ্যা ৯ লাখ ৭৩ হাজার ৯৪১ জন, মারা গেছে ৪৭ হাজার ২৭৩ জন, সুস্থ হয়েছে ১ লাখ ৯৫ হাজার ১৮৮ জন। এমতাবস্থায় বাংলাদেশ নভেল করোনাভাইরাস (কভিড-১৯) হতে পরিত্রাণের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নানা কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। জনগণকে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হচ্ছে। সামাজিক দুরত্ব বৃদ্ধি বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।
বলা হচ্ছে- একজন আরেকজন থেকে কমপক্ষে ৩ ফুট দুরত্বে থাকতে হবে। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ৬৮টি কারাগারে ৮৯ হাজারেরও বেশি বন্দি আটক রয়েছে। অথচ এ কারাগারগুলোর ধারণ ক্ষমতা ৪১ হাজার ৩৪০ জন মাত্র। শুধু ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১০ হাজারের অধিক কয়েদি রয়েছে। উক্ত কয়েদিদের মধ্যে দন্ডপ্রাপ্ত, বিচারাধীন, আটকাদেশ প্রাপ্ত ও বিদেশি নাগরিক নারী পুরুষ রয়েছে।
এমতাবস্থায় কয়েদি ও কারা কর্মকর্তাদের জন্য সরকারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুবই অপ্রতুল এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারাবন্দি ও কারা কর্মকর্তাদের আত্মীয় স্বজন মহা উৎকন্ঠার মাঝে সময় অতিবাহিত করছে। যেখানে জনগণকে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার জন্য বলা হচ্ছে, সর্দি-কাশি আক্রান্ত লোককে মসজিদে যেতে বারণ করা হচ্ছে, গণ পরিবহন বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে; সেখানে কারা পরিদর্শক, ডাক্তার ও কর্মকর্তাদেরকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিয়মিত জেলখানায় ডিউটিতে যেতে হচ্ছে।
নভেল করোনাভাইরাস (কভিড-১৯) হতে রক্ষার জন্য স্বাস্থ্য সচেতন থাকতে জোর তাগিদ প্রদান করা হচ্ছে। সেখানে জেলখানায় দু তিন’শ বন্দির জন্য একটি মাত্র টয়লেট। বন্দিদেরকে দুর্গন্ধযুক্ত টয়লেটের সামনে ঘুমাতে দেয়া হয়। বন্দিরা নিরাপদ দূরত্ব কীভাবে বজায় রাখবে? কারাগার হাসপাতালগুলো ভিআইপি কয়েদিদের আয়েশি জীবন যাপনের নিরাপদ কেন্দ্র। অসুস্থ বন্দিদের সেখানে থাকার কোনো সুযোগ নেই বললেই চলে। অসুস্থ বন্দিরা সেখানে নামে মাত্র চিকিৎসা পেয়ে থাকে। আল্লাহ না করুন যদি চীন, স্পেন, ইতালি, ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মত বিপর্যয় নেমে আসে তাহলে বাংলদেশের মানুষ ও বন্দিরা চিকিৎসাহীন অবস্থায় মৃত্যুর মিছিলে শামিল হবে। কারাগারেও করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক কারাগারে ১৬৭ জন কয়েদি ও ১১৪ জন কারাকর্মীর শরীরে করোনা পজিটিভ পাওয়া গেছে। ইতিমধ্যে একজন কারাস্টাফ করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। নিউইয়র্ক সিটির বোর্ড অফ কারেকশান ২১৮৫ জন কয়েদিকে জামিন প্রদানের জন্য সুপারিশ করেছে। এদের মধ্যে ৯০৬ জন বন্দি রয়েছে ষাটোর্ধ। নিউইয়র্ক সিটির গভর্নর এন্ড্রু কুমো বলেন, ধারাবাহিকভাবে বন্দি মুক্ত করা হবে। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী ২২ মার্চ থেকে যুক্তরাজ্যে ২২৬ জন কয়েদি ও ১৩১ জন কারাস্টাফ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে।
নভেল করোনাভাইরাস (কভিড-১৯) -এর ভয়াবহতায় ইতোমধ্যে ইরান ৮৫ হাজার কয়েদিকে জামিন প্রদান করেছে। ইরানের বিচার বিভাগীয় প্রধান ইবরাহিম রঈসি জানান, করোনার ভয়াবহতা না কমা পর্যন্ত বন্দি মুক্ত করার এ ধারা অব্যাহত থাকবে। (স্কাই নিউজ)।
কারাসূত্রে জানা যায়, দেশের ৬৮টি কারাগারের মধ্যে মাদারীপুর কারাগার লকডাউন করা হয়েছে। মাদারীপুরে অধিকসংখ্যক বিদেশফেরত প্রবাসীদের কারণে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে কারা অধিদফতর। বাগেরহাট কারাগারে নতুন বন্দি তিন চাইনিজ নাগরিককে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে।
দেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে প্রতিটি কারাগারে নতুন বন্দিদের জন্য আলাদা সেল খোলা হয়েছে। এই সেলে রাখা হয়েছে ১৪টি কক্ষ। নিরাপত্তা নিশ্চিতে বন্দিদের পর্যায়ক্রমে ১৪টি কক্ষে নেওয়া হচ্ছে। ‘নতুন আমদানি সেল’ নামে এই সেলে বন্দি আনার আগেই তাদের পরীক্ষা ও তলাশি করার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।
কারাগার বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হতে বাঁচতে এই মুহূর্তে কারাগারের ধারণ ক্ষমতা বিবেচনা করে কিছু বন্দি কমানো দরকার। অথচ কোর্ট বন্ধ থাকায় অন্যান্য সময়ের মতো স্বাভাবিক জামিনও হচ্ছে না, অন্যদিকে কয়েদি বাড়ছে প্রতিনিয়ত। কারাগার বিশেষজ্ঞ ও সাবেক ডিআইজি প্রিজন মেজর জেনারেল সামছুল হায়দার সিদ্দিকি গণমাধ্যমকে বলেছেন, করোনাভাইরাস একটি ছোঁয়াচে রোগ, সে তুলনায় কারাগারে বন্দিদের ভীড় বেশি থাকে সব সময়।
গাদাগাদি করে থাকতে হয়। লঘু দন্ডপ্রাপ্ত যে সকল অপরাধী রয়েছে তাদের জামিনের ব্যবস্থা করলে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি কমতো। বিষয়টি সরকার ও সংশ্লিষ্টরা বিবেচনা করতে পারেন। তিনি আরো বলেন, শুধু বন্দিদের বিষয় দেখলে হবে না বরং বন্দিদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত কারারক্ষী, পরিদর্শক ও ডাক্তারদের স্বাস্থ্য বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। তারা যেন সতর্কতার সাথে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে কারাগারে ডিউটি পালন করে।
বন্দিদের মর্য়াদা ও অধিকার প্রদানে ইসলাম: ইসলাম বন্দিদেরকে সম্মান ও মর্যাদা প্রদান করেছে। রাসূল সা. বন্দিদের সাথে কোমল ব্যবহার করার জন্য কঠোর নির্দেশ প্রদান করেছেন। বদর যুদ্ধের বন্দিদের সাথে উত্তম ব্যবহার করার জন্য তিনি সাহাবিদের নির্দেশ প্রদান করেন। অসুস্থ বন্দিদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে তাগিদ প্রদান করেন। ইসলামের নির্দেশনা অনুযায়ী বন্দিদেরকে এমন স্থানে রাখতে হবে যেখানে তারা জীবনের নিরাপত্তাবোধ করবে। সমূহ অনিষ্ট, ভীতি ও ক্ষতি হতে বন্দিদেরকে দূরে রাখতে হবে। কেননা বন্দিদের আটকের উদ্দেশ্য হলো মানব মর্যাদা অক্ষুন্ন রেখে তাদেরকে সংশোধন করা ও সমাজের কল্যাণে প্রস্তুত করা। শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “শরিয়তের দৃষ্টিতে কয়েদিকে নিরাপদ ও পরিচ্ছন্ন জায়গায় আটক রাখবে, যেখানে তার ব্যক্তিগত কোন শক্তি প্রয়োগের সুযোগ থাকবে না। চাই সে বন্দিত্ব ঘরে, মসজিদে কিংবা কারাগারে হোক। -মাজমুউল ফাতাওয়া : ৩৫/৩৯৮।
রাসূল সা. বন্দিদের রাখার জন্য প্রশস্ত ও আলো প্রবেশ করে এমন তাবু নির্বাচন করতেন। যাতে বন্দিরা শারীরিক ও আত্মিক প্রশান্তি লাভ করে। রাসূল সা. কয়েদিদেরকে মসজিদে নববিতে বন্দি করে রাখতেন। মসজিদে নববি তখন ৩২৮১ মিটার প্রশস্ত ছিলো। যা পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্তায় সুশোভিত ছিলো। যাতে সাহাবাদের সাথে বন্দিদের নিয়মিত সাক্ষাৎ হয়।
কয়েদিরা পাঁচ ওয়াক্ত নামায মসজিদে নববিতে আদায় করে এবং রাসূলের সা. নসিহত ও খুতবা হতে শিক্ষা গ্রহণ করে। আধুনিক যুগে এ ধরণের কারাগারকে উম্মুক্ত কারাগার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় । যাতে কয়েদিদের জন্য স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বিরাজ করে। (সহিহ ইবনে খুজায়মা : ২/২৮৫, হুকুকুল মাসজুন ফিশ শরিয়াতিল ইসলামিয়া : পৃষ্ঠা ৫৪, সহিহুল বুখারী, বাবু রবতিল আসিরে ফিল মসজিদে, হাদিস নং : ৪৫০, সহিহ মুসলিম, বাবু রবতিল আসিরে ওয়া হাবসিহি, হাদিস নং : ১৭৬৪)।
রাসূল সা. দন্ডপ্রাপ্তদেরকে ঘরে বন্দি রাখার জন্য নির্দেশ দিতেন। যাতে তারা তাদের মৌলিক অধিকারসমূহ স্বাচ্ছন্দে ভোগ করতে পারে। আমিরুল মু’মিনীন ওমর ইবনুল খাত্তাব রা. একটি ঘর ক্রয় করে তা কারাগারের জন্য নির্দিষ্ট করে রাখেন। আলী রা. সর্বপ্রথম কারাগার নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে মুসলিম শাসকগণ খলিফাদের পথ অনুসরণ করেন। কারাগারগুলো মানুষের বসবাসের নিকটবর্তী এলাকায় স্থাপন করা হয় যাতে বন্দিরা আযান শুনতে পায়। [আখবারুল কুযাত লিল ওয়াকি : ৩/১৬৫, নিযামুশ শুরতা ফিল ইসলাম : পৃষ্ঠা ১৮৬]।
মানবমণ্ডলিকে অসুস্থতা, ঝুঁকি ও মহামারি হতে রক্ষা করা ইসলামি শরিয়তের অন্যতম নির্দেশনা। আলাহর ভাষায় : তোমরা নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিও না। [সূরা বাকারা : ১৯৫]
ফিকহ বিশেষজ্ঞগণ বলেন, বেশি সংখ্যক বন্দিকে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে আটক রাখা জায়েজ নয়। যেখানে শীতে ও গরমে বন্দিদের কষ্ট হয়। রাষ্ট্রের দায়িত্ব কয়েদিদের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা। ইসলামি আইনবিদগণ আরো বলেন, বন্দিদেরকে কারাগারে চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে। ডাক্তার ও নার্সদের রুগির সেবায় জেলখানায় প্রবেশে কোনরূপ বাধা প্রদান করা যাবে না। জেল কর্তৃপক্ষ যদি কোনো কয়েদিকে বাহিরে চিকিৎসা করাতে বাধ্য হয় তাহলে বিচারক তাকে বাইরে নেয়ার অনুমতি প্রদান করবে।
কোনো কোনো ফকিহ সেক্ষেত্রে জামিনদারের মাধ্যমে বাইরে প্রেরণের শর্তারোপ করেন। তবে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা প্রদান করলে জামিনদারের প্রয়োজন নেই। (আল এখতিয়ার : ৫/২৬, হাশিয়াতু ইবনে আবেদিন : ৫/৩৭৮, ফাতহুল কাদির ইবনুল হুমাম : ৫/৪৭১, আদাবুল কাযি লিল খাসসাফ : ২/৩৭৫, ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ৪/৪১২, হুকুকুল মাসজুন ফিশ শরিয়াতিল ইসলামিয়্যা : পৃষ্ঠা ৭৬)।
ইতোমধ্যেই করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব থেকে কারাগার সংরক্ষিত রাখতে দেশের ৩ হাজার কারাবন্দিকে জামিন দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য। করোনায় সৃষ্ট দুর্যোগের কারণে কারাবন্দির সংখ্যা কমাতেই দেশের ৬৮ কারাগারে ছোটখাটো অপরাধ ও জামিনযোগ্য ধারায় বিচারাধীন ৩ হাজারের বেশি কারাবন্দিকে জামিন দিতেই এ উদ্যোগ বলে কারা সূত্রে জানা গেছে। এরপরও ৪১ হাজার ৩১৪ জন ধারণক্ষমতা সম্পন্ন কারাগারগুলোতে বাকী ৮৬ হাজারেরও বেশি কারাবন্দিকে গাদাগাদি করে থাকতে হবে, যা করোনাসৃষ্ট মহামারীর সময়ে ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ।
বর্তমান সময়ে কয়েদিদের সব ধারণের সুবিধা বিনষ্ট হচ্ছে এতে কোন সন্দেহ নেই। এমতাবস্থায় কারাগার বিশেষজ্ঞ ও আইন গবেষকদের মতামত অনুযায়ী ১৯৬০ সালের বিচার বিভাগীয় অধ্যাদেশ আলোকে লঘু দন্ডপ্রাপ্ত কয়েদি, রাজনৈতিক বন্দি, শিক্ষাবিদ, বয়োবৃদ্ধ বন্দি ও নারী বন্দিদের শর্ত সাপেক্ষে জামিন প্রদান করার ব্যবস্থা করা যায় কিনা, বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি অতীব গুরুত্বের সাথে দেখবেন বলে আশা করছি।
লেখক: মুফতি, আরবি ভাষাবিদ, এমফিল গবেষক (কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়)।