আল্লামা মাহমুদুল হাসান।।
আমির, মজলিসে দাওয়াতুল হক বাংলাদেশ
বর্তমান বিশ্বে নতুন এক আতঙ্কের নাম করোনা ভাইরাস। হাদিস শরিফে কেয়ামতের আগে ছয়টি নিদর্শন প্রকাশ হওয়ার ব্যাপারে বলা হয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো, মওতে আম বা দুর্ভিক্ষ এবং মহামারী নেমে আসবে। এই মহামারী একেকবার একেক নামে আসবে। ইতিপূর্বে কলেরা, বসন্ত, যক্ষ্মা, সোয়ায়েন ফ্লু, ইবোলাসহ নানা ভাইরাসে পৃথিবী দীক্ষা পেয়েছে। এবার এসেছে করোনা, কোভিড-১৯। এই ভাইরাসে ইতিমধ্যে পৃথিবীর শতাধিক দেশ সংক্রমিত হয়েছে। বাংলাদেশ এই সংক্রমিত দেশের অন্তর্ভূক্ত।
এই পরিস্থিতিতে ইসলামের শিক্ষা হলো, হাদিসে এসেছে- রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহামারীর সংক্রমণরোধে আক্রান্ত অঞ্চলে যাতায়াত নিষিদ্ধ করে বলেছেন, কোথাও মহামারী দেখা দিলে এবং সেখানে তোমরা অবস্থানরত থাকলে সে জায়গা ছেড়ে চলে এসো না। আবার কোনো এলাকায় এটা দেখা দিলে এবং সেখানে তোমরা অবস্থান না করে থাকলে, সে জায়গায় গমন করো না।
এজন্য একবার হযরত উমর রাযি. হযরত আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহকে নিয়ে সিরিয়ায় সফর করতে বেরুলে সেখানে মহামারীর খবর শুনতে পান। এরপর তিনি সে সফর স্থগিত করেন। তখন আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ বললেন, আপনি আল্লাহর তকদির থেকে পলায়ন করছেন? হযরত উমর রাযি. সে সময় অত্যন্ত দূরদর্শিতার সাথে জবাব দিলেন, আমি আল্লাহর তকদির থেকে পালিয়ে আল্লাহর তকদিরের দিকেই অগ্রসর হচ্ছি।
আমাদের দেশেও এখন একই পরিস্থিতি বিরাজমান। ইতিমধ্যে বিভিন্ন রাষ্ট্র সরকারিভাবে করোনা আক্রান্ত দেশগুলোতে যাতায়াতে সতর্কতা জারি করেছে। চিকিৎসকদের মতে, এ ভাইরাসটি একজনের দেহ থেকে অন্যজনের দেহে ছড়ায়, তাই অন্যজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত, শরীর স্পর্শ ও কথাবার্তায় সতর্কতা অবলম্বন জরুরি।
গোটা বিশ্ব এই করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব প্রতিরোধকরণ কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে। তারা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবছেন, ফলে এই উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সকল শিক্ষাকার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেছেন। এটি সময়োপযোগী ও সঠিক সিদ্ধান্ত। শরিয়তও এটি সমর্থন করে। আমার কাছেও সরকারের এই সিদ্ধান্ত কল্যাণকর মনে হয়েছে, এটি যদি আমরা গ্রহণ করি তাহলে শরয়ি দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো বাধা নেই।
এখানে আরেকটি বিষয় বিবেচনার দাবি রাখে- আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমাদের ওপর আরোপিত সকল বালা-মসিবত আমাদের কৃতকর্মেরই প্রতিফল। এই আয়াতের ধারাবাহিকতায় হাদিসেও এসেছে, যখন কোনো জাতির মধ্যে প্রকাশ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে, তখন তাদের মধ্যে দুর্ভিক্ষ ও মহামারী ব্যাপক আকার ধারণ করবে। এই হাদিসের ভাষ্যমতে আমাদের মাঝে অশ্লীলতা, জিনা-ব্যাভিচার এবং অনাচারমূলক সকল অন্যায় কাজ পরিহার করে আল্লাহর তায়ালার কাছে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব থেকে মুক্তির জন্য কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করতে হবে। ঘরে ঘরে কুরআন তেলাওয়াত, তাসবিহ-তাহলিল এবং আল্লাহর ইবাদতে আত্মনিমগ্ন থাকবে। খুব প্রয়োজন ব্যতীত ঘরের বাইরে যাবে না এবং জনসমাগমস্থল পরিহার করে চলবে।
শুধু শরীরের ভাইরাস দূর করলেই চলবে না। আত্মারও পরিশুদ্ধিকরণ প্রয়োজন। উদাহরণত, আমাদের শরীরে যদি ঘা হয়, তাহলে স্রেফ আক্রান্ত জায়গায় মলম লাগিয়ে ক্ষান্ত যাওয়া উচিত নয়। রক্তপরিষ্কারের জন্যেও ওষুধ সেবন প্রয়োজন। তদ্রূপ মানুষের শরীর যদি হয় একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র তাহলে সে শরীরের রাজধানী হলো কলব, যেটি আয়ত্তে চলে এলে বাকি অঙ্গসমূহও আপনাআপনি আয়ত্তে চলে আসবে। ঠিক যেমন কোনো দেশ দখল করতে হলে প্রথমে সে দেশের রাজধানী দখল করতে পারলে গোটা দেশটি দখলে আনতে তেমন বেগ পেতে হয় না, তেমনি কলবকে আয়ত্তে আনতে পারলে অন্যান্য অঙ্গগুলোও আয়ত্তে আনা সহজতর হয়ে যাবে।
এ সম্পর্কিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিসটি আমাদের সবার কাছে খুবই প্রসিদ্ধ। হাদিসটি হলো, শরীরের মধ্যে একখণ্ড মাংসপিণ্ড আছে। সেটি পরিশুদ্ধ হলে সমস্ত শরীর পরিশুদ্ধ হয়ে যায়। পক্ষান্তরে সেটি নষ্ট হলে সমস্ত শরীরই নষ্ট হয়ে যায়। আর সেই মাংসপিণ্ডটি হচ্ছে কলব বা অন্তর। তাই অন্তর পরিশুদ্ধিতে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। এজন্য অন্যায়কে বর্জন করে আল্লাহর ইবাদতে নিজেকে নিমগ্ন রাখতে হবে। আর বেশি বেশি রোনাজারির মাধ্যমে আল্লাহর কাছে নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে দোয়া পড়তে হবে-
اَللّهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْبَرَصِ وَالْجُنُوْنِ وَالْجُذَامِ وَمِنْ سَيِّءِ الأَسْقَامِ
আর বাহ্যিক পরিশুদ্ধির জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং আই.ই.ডি.সি.আর নির্দেশিত পন্থায় নিজেদের পরিচালনা করতে হবে এবং প্রয়োজনে হোমকোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। আল্লাহ আমাদের সকলকে তওফিক দান করুন। আমীন।
অনুলিখন : রিদওয়ান হাসান
-এএ