বেলায়েত হুসাইন
অন্যান্য দিনের মতো ঘন কুয়াশা ছিলনা। ফজর পড়েই বেরিয়ে পড়ি। ফরিদপুরের বাহিরদিয়া মাদরাসা ও গোপালগঞ্জের গওহরডাঙ্গা মাদরাসা পরিদর্শন করে আমরা সোজা বাগেরহাট অভিমুখে রওনা হব-আমাদের প্লান ছিল এরকম। কিন্তু দুই জেলার আরও কয়েকটি মাদরাসায় যাওয়ার কারণে আমাদের সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আসে; নতুন প্লান করি, ফিরে আসার সময় গওহরডাঙ্গা দেখব।
ড্রাইভারসহ মোট চৌদ্দজনকে নিয়ে খুব দ্রুত চলছে আমাদের বহনকারী মাইক্রোবাসটি। সরু 'বিশ্বরোড' বেয়ে আমরা একের পর এক মাঠ-গ্রাম অতিক্রম করছি। শীত থাকায় জানালার গ্লাস খোলা যাচ্ছিলোনা। কাঁচের ভেতর থেকেই রাস্তার দু'পাশে গোপালগঞ্জের গ্রামীণ সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম। মাদুর তৈরি করার হোগলা গাছ এই প্রথম দেখলাম। কিছুটা নিচু জমিতে পানির মধ্যে অপরিকল্পিতভাবে এই গাছের জন্ম হয়।
আর্থিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ না হলেও প্রথম দেখার কারণে হোগলা গাছের প্রতি কৌতুহল ছিল। আমাদের গাড়ি গোপালগঞ্জ মাড়িয়ে বাগেরহাটে প্রবেশ করেছে। রাস্তার ডানেবামে কৃত্রিম উপায়ে পানি আটকে রাখা হয়েছে। ছোট ছোট কুয়া সদৃশ এসব ঘেরে চিংড়ি ইত্যাদি মাছ চাষ করা হয়। কুয়ার চারপাড়ে নানারকম শাকসবজির ক্ষেত করা হয়েছে। টমেটো গাছের দুএকটি লাল টমেটো আমাদের যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে আবার হারিয়ে যায়।
শৈশব থেকেই স্বপ্ন দেখতাম ষাট গম্বুজ মসজিদ দেখতে যাওয়ার। কয়েকজন সঙ্গী রাজি হওয়ায় এবার সেই স্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে। ষাট গম্বুজ মসজিদ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা বাগেরহাটে অবস্থিত। ১৫ শতকের দিকে খান জাহান আলি নামের প্রখ্যাত সূফী দরবেশ এই মসজিদটি নির্মাণ করেন।
প্রত্নস্থলটিকে ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো বিশ্বঐতিহ্য কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করে। মসজিদটিতে ৮১ টি গম্বুজ রয়েছে। এটিকে ষাট গম্বুজ মসজিদ কেন বলা হয়- এর নির্ভরযোগ্য কোন ব্যখ্যা পাওয়া যায়না। এই মসজিদটি ছাড়াও এর আশপাশে আরো বেশ কিছু ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে; মসজিদের ঠিক পশ্চিমে সুবিশাল দীঘি ও পীর খান জাহান আলির সমাধি উল্লেখযোগ্য। দেশের অন্যতম একটি পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ খুব প্রসিদ্ধ।
সারা বছর এখানে পর্যটকদের আনাগোনা থাকে চোখে পড়ার মতো। শীতকাল এই অঞ্চল ভ্রমণ করার উপযুক্ত সময়। এজন্য আমরাও শীতকেই বেছে নিয়েছি। বাগেরহাটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার পথেই আমরা ফরিদপুর ও গোপালগঞ্জের কয়েকটি প্রাচীন মাদরাসায় গমন করি- এতে যখন আমরা ষাট গম্বুজে পৌঁছি তখন সূর্য আমাদের মাথার ওপর থেকে নামতে শুরু করেছে।
আমরা দ্রুত বড় দীঘিতে অজু করে ষাট গম্বুজে যোহরের দুই রাকাত (সফরের নামাজ) নামাজ আদায় করি। নামাজ শেষে মসজিদের অভ্যন্তর খুব আগ্রহ ভরে দেখতে থাকি। প্রাচীন ইমারতের চোখধাঁধানো নির্মাণশৈলী আমাদের যারপরনাই বিস্মিত করে তোলে।
মসজিদের উত্তর-দক্ষিণে বাইরের দিকে প্রায় ১৬০ ফুট ও ভিতরের দিকে প্রায় ১৪৩ ফুট লম্বা এবং পূর্ব-পশ্চিমে বাইরের দিকে প্রায় ১০৪ ফুট ও ভিতরের দিকে প্রায় ৮৮ ফুট চওড়া। দেয়ালগুলো প্রায় ৮·৫ ফুট পুরু। ষাট গম্বুজের স্থাপত্যশিল্পের এই নিপুণতা দেখে আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করি- এজন্য যে তিনি দুর্বল মানুষকে কতো বুদ্ধি দান করেছেন।
জনশ্রুতি আছে, হযরত খানজাহান আলি রহ. ষাট গম্বুজ মসজিদ নির্মাণের জন্য সমুদয় পাথর সুদুর চট্রগ্রাম, মতান্তরে ভারতের উড়িষ্যার রাজমহল থেকে তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা বলে জলপথে ভাসিয়ে এনেছিলেন। ইমারতটির গঠন বৈচিত্রে তুঘলক স্থাপত্যের বিশেষ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এ বিশাল মসজিদের চতুর্দিকে প্রাচীর ৮ফুট চওড়া, এর চার কোনে চারটি মিনার আছে। দক্ষিণ দিকের মিনারের শীর্ষে কুঠিরের নাম রোশনাই কুঠির এবং এ মিনারে উপরে উঠার সিড়ি আছে। মসজিদটি ছোট ইট দিয়ে তৈরী, এর দৈর্ঘ্য ১৬০ফুট, প্রস্থ ১০৮ ফুট, উচ্চতা ২২ফুট। মসজিদের সম্মুখ দিকের মধ্যস্থলে একটি বড় খিলান এবং তার দুই পাশে পাঁচটি করে ছোট খিলান আছে। মসজিদের পশ্চিম দিকে প্রধান মেহরাবের পাশে একটি দরজাসহ মোট ২৬টি দরজা আছে। মসজিদ দর্শণীয় স্থানে রূপান্তরিত হওয়ায় সামনের আঙিনাকে সাজিয়ে তোলা হয়েছে বাহারি ফুল গাছের সমারোহে। এসব গাছের নানারকম ফুলও দূরদূরান্ত থেকে আগত পর্যটকদের মনে দোলা দিতে থাকে।
ষাট গম্বুজের পশ্চিম দিকে বিরাট যে দিঘিটির কথা উল্লেখ করেছি- এটাকে অলৌকিক কোন জলাধার মনে হয়- এর মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে জন্ম নেয়া রক্ত শাপলা মানুষকে যেমন বিমোহিত করে, ঠিক তেমনি জলের গভীরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে অজানা এক শংকা নাড়া দেয় মনকে; পুরনো শেওলা শাপলার লতাকে কি ভয়ঙ্করভাবে জড়িয়ে আছে- উহ! ভাবলেই গা শিওরে ওঠে। অদ্ভুত কালো পানি যেন ভয়ের দূত! দীঘির এই অ্যাডভেঞ্চারের মধ্যেও অন্যরকম একটি ভাললাগা আছে অবশ্যই- দর্শকই শুধুমাত্র এর অনুভব করতে পারে। আমরা দীঘির পাশে বসার জায়গায় কিছুক্ষণ বসে বিশ্রাম নিলাম এবং খোশগল্প সারলাম। পূব-পশ্চিম তীরের লেকটায় কিছুক্ষণ হাঁটার পরে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য পীর খান জাহান আলির সমাধির দিকে রওনা হলাম।
মাত্র পাঁচ-সাত মিনিটে খান জাহান আলির সমাধিতে এসে দাঁড়াল আমাদের বহনকারী গাড়িটি। হাতে সময় কম থাকায় শায়েখ খান জাহান আলি রহ. এর মাজার জেয়ারত করে আমরা আবার ষাট গম্বুজ চত্বরে ফিরে আসি। ফরিদপুর থেকে নিয়ে যাওয়া খেজুর রসের দুধচিতাই পিঠা খেতে বসি সেখানেই। খাওয়া শেষ হলে আমরা আবার গোপালগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা হই, গন্তব্য গওহরডাঙ্গা মাদরাসা। গোটা উপমহাদেশের সর্বশ্রদ্ধেয় আলেম মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ. প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠানটি ঘুরেফিরে দেখি এবং তাঁর সমাধি জেয়ারত করি। রাত তখন নয়টা, মাদরাসার মসজিদে ইশার নামাজ পড়ে আবার রওনা করি ফরিদপুরের উদ্দেশ্যে।
কীভাবে যাবেন?
ঢাকার গুলিস্তান থেকে সরাসরি বাস আছে বাগেরহাটে যাওয়ার। আবার মুন্সিগঞ্জের মাওয়া থেকে লঞ্চ বা ফেরিতে পদ্মা নদী পার হয়ে কাঁঠালবাড়ি থেকে বাসে সরাসরি বাগেরহাটে যেতে পারেন। এই সড়কটাও চমৎকার। গাবতলী থেকেও বাগেরহাটে যাওয়ার বাস ছাড়ে। যাঁরা সময় নিয়ে যাবেন, তাঁরা বাগেরহাট থেকে মোংলায় গিয়ে সেখান থেকে মোটরচালিত নৌকায় চড়ে সুন্দরবনে ঘুরে আসতে পারেন। বলে রাখা ভালো, বাগেরহাটে থাকার ব্যবস্থা একটু কম। দু-একটা হোটেল রয়েছে।
-এটি