মুহাম্মদ ছফিউল্লাহ হাশেমী।।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীবরূপে মানুষ সৃষ্টি করে তাদের মনের ভাব প্রকাশের জন্য ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন। বিচিত্র ধরনের ভাষা পৃথিবীতে রয়েছে। জগতজুড়ে ভাষা বৈচিত্র্যের এই যে অপরূপ সমাহার সেটা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের মহান কুদরতের এক অনুপম নিদর্শন। পবিত্র কুরআন মাজিদে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কুদরতের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। ভাষা ও বর্ণের নিদর্শন সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘তার আরও একটি নিদর্শন হচ্ছে নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয়ই এতে জ্ঞানীদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে।’ (সুরা আর-রূম, আয়াত নং- ২২)।
জন্মগতভাবে মানুষ তার মাতৃভাষাতে মনের ভাব প্রকাশ করে থাকে। কারণ আল্লাহ তায়ালা মানুষের জন্মের পর তাকে মায়ের ভাষাতেই কথা বলতে শিখিয়েছেন। ভাষা মানুষের প্রতি মহান আল্লাহ তায়ালার অশেষ দয়া ও অনুগ্রহ এবং তাঁর সৃষ্টি কুশলতার একটি অনুপম নিদর্শন। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনুল কারিমে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘করুণাময় আল্লাহ, শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন, সৃষ্টি করেছেন মানুষ এবং তাকে কথা বলা শিখিয়েছেন।’ (সুরা আর-রহমান, আয়াত নং- ১৪)।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পৃথিবীতে অসংখ্য নবি-রাসূল প্রেরণ করেছেন। তাঁরা পৃথিবীতে এসেছেন আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অমীয় বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য। যুগে যুগে আল্লাহ তায়ালা যে অঞ্চলে নবি-রাসূল প্রেরণ করেছেন সেই নবি বা রাসূলকে সেই অঞ্চলের মানুষের ভাষাভাষী করেছেন। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আমি সব নবিকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করেই প্রেরণ করেছি, যাতে তাদের পরিষ্কারভাবে বোঝাতে পারে। অতঃপর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা সৎপথ প্রদর্শন করেন। তিনি পরাক্রান্ত, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা ইবরাহিম, আয়াত নং- ৪)।
এ আয়াতে কারিমায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, মাতৃভাষার মাধ্যমে যত সহজে মানুষকে কোন বিষয় বোঝানো যায়, তা অন্য কোন ভাষায় ততো সহজে করা যায় না। আর এই কারণেই আল্লাহ তায়ালা নবিদের তাদের নিজ নিজ কওমের ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছেন। তাই লক্ষ্য করা যায়- হিব্রু ভাষাভাষী অঞ্চলে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যখন কোন নবি-রাসূল প্রেরণ করেছেন তার ভাষাও হয়েছে হিব্রু এবং তার কাছে আল্লাহ তায়ালার যে কিতাব নাজিল হয়েছে, তাও সেই ভাষায়ই নাজিল হয়েছে। যেমন- তাওরাত ও ইনজিল। আবার এমনটিও লক্ষ্য করা যায়, কোন নবি বা রাসূল জন্মগ্রহণ করেছেন এক ভাষাভাষী অঞ্চলে কিন্তু তাকে অন্য ভাষাভাষী অঞ্চলে গিয়ে বসবাস করতে হয়েছে।
সেই অঞ্চলের মানুষের ভাষা তিনি আয়ত্তে এনেছেন এবং সেই ভাষাতেই তাঁর প্রচার কাজ করেছেন। যেমন, আল্লাহর নবি হজরত লুত আ. জন্মগ্রহণ করেছিলেন উর্বর হেলাল অঞ্চল বলে পরিচিত মেসোপটেমিয়া অর্থাৎ ইরাক অঞ্চলে। তিনি পরবর্তীতে ফিলিস্তিন অঞ্চলে চলে যান এবং সেই অঞ্চলের মানুষের ভাষায় প্রচার কাজ চালান। এমনিভাবে দেখা যায়, প্রত্যেক নবি-রাসূলই তাঁর মাতৃভাষাতেই মানুষের কাছে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের বাণী পৌঁছে দিয়েছেন, মানুষকে সত্য ও সুন্দরের পথে আহ্বান করেছেন।
[caption id="attachment_175956" align="aligncenter" width="300"] বই কিনতে ক্লিক করুন[/caption]
আমাদের প্রিয় নবি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাতৃভাষা ছিল আরবি। তাঁর কাছে আসমানি কিতাব পবিত্র কুরআন মাজিদ নাজিল হয় মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। এই কুরআন মাজিদের ভাষা আরবি। প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাতৃভাষা আরবিতে কুরআন মাজিদ নাজিল হওয়া প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি আপনার ভাষায় কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি, যাতে তারা স্মরণ রাখে’। (সুরা আদ্-দুখান, আয়াত নং- ৫৮)। ‘এমনিভাবে আমি আপনার প্রতি আরবি ভাষায় কুরআন নাজিল করেছি, যাতে আপনি মক্কা ও তার আশপাশের লোকদের সতর্ক করেন এবং সতর্ক করেন সমাবেশের দিন সম্পর্কে’। (সুরা আশ্-শুরা, আয়াত নং- ৭)। ‘আমি একে আরবি ভাষায় কুরআনরূপে নাজিল করেছি, যাতে তোমরা বুঝতে পারো’। (সুরা ইউসুফ, আয়াত নং- ২)।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর প্রিয় হাবিব রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উদ্দেশ্য করে ইরশাদ করেন, ‘আমি কুরআনকে আপনার ভাষায় সহজ করে দিয়েছি, যাতে আপনি মুত্তাকীদেরকে সুসংবাদ দেন এবং কলহকারী সম্প্রদায়কে সতর্ক করেন’। (সুরা মারইয়াম, আয়াত নং- ৯৭)। ‘এমনিভাবে আমি আরবি ভাষায় কুরআন নাজিল করেছি এবং এতে নানাভাবে সতর্কবাণী ব্যক্ত করেছি, যাতে তারা আল্লাহভীরু হয় অথবা তাদের অন্তরে চিন্তার খোরাক জোগায়’। (সুরা তোয়াহা, আয়াত নং- ১১৩)।
পবিত্র কুরআন মাজিদ হতেই আমরা জানতে পারি, ইসলামি আদর্শ যেমন সর্বজনীন, ইসলামের ভাষাও তেমনি সর্বজনীন। ‘‘এভাবে ভাষা, বর্ণ ও আঞ্চলিকতার সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে ইসলাম শাশ্বত মানুষকে আপনাকে রবের পথে বিজ্ঞানসম্মত ও উত্তম ভাষণ দ্বারা আহ্বান করুন এবং তাদের সঙ্গে সদ্ভাবে আলোচনা করুন’। (সুরা আন-নাহল, আয়াত নং-১২৫)।
এ কারণেই দেখা যায়, পরবর্তী সময়ে ইসলাম প্রচারকগণ পৃথিবীর যে অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করতে গিয়েছেন সেই অঞ্চলের মানুষের ভাষা আয়ত্ত করে সেই ভাষাতেই ইসলামের সুমহান বাণী সেই অঞ্চলের মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন। তাদের মাতৃভাষায় পবিত্র কুরআন মাজিদ অনুবাদ করে তাদেরকে কুরআন-হাদিসের জ্ঞানদান করেছেন এবং নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতের হুকুম-আহকাম, নিয়ম-কানুন শিক্ষা দিয়েছেন। যতদূর জানা যায়, বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার শুরু হয় ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রা.-এর খিলাফতকালের মধ্যভাগ হতে অর্থাৎ ৬৪০ খ্রিস্টাব্দের দিকে।
আরব, ইয়েমেন, ইরাক, ইরান, খুরাসান, তুরস্ক, মিসর প্রভৃতি বিভিন্ন দেশ হতে ইসলাম প্রচারকগণ বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার করার জন্য আগমন করেছেন। তারা এদেশে এসে এদেশের মানুষের ভাষা আয়ত্ত করেছেন এবং এদেশের মানুষের ভাষাতেই ইসলাম প্রচার করেছেন। এদেশের মানুষ অতি সহজেই তাদের কাছ থেকে ইসলাম সম্পর্কে জানতে পারে, ফলে দলে দলে লোক ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে। আরও লক্ষ্য করা যায়, বাংলা ভাষা এক দারুণ অবহেলিত অবস্থা হতে উদ্ধারপ্রাপ্ত হয় মুসলমানদের আগমনের ফলে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বাংলার সুলতানগণ দ্বারাই বাংলা ভাষার উৎকর্ষ ও বিকাশ সাধিত হয়।
এ সম্পর্কে শ্রী দীনেশ চন্দ্রসেন ‘বঙ্গভাষার উপর মুসলমানদের প্রভাব’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেছেন: “মুসলমান আগমনের পূর্বে বঙ্গভাষা কোন কৃষক রমণীর ন্যায় দীনহীনবেশে পল্লী কুটিরে বাস করিতেছিল।”
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলেজ শিক্ষক
-এএ