সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
সৌদির সেবা কোম্পানির সঙ্গে হজ এজেন্সির চুক্তির নির্দেশনা মহেশখালী থানার বিশেষ অভিযানে পরোয়ানাভুক্ত ১১ জন আসামি গ্রেফতার বৃষ্টির সময় কাবা প্রাঙ্গণে নামাজ আদায় ওমরা পালনকারীদের নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেট গ্রাহকদের মূলধন ফেরত পাওয়ার দাবিতে সংবাদ সম্মেলন মাওলানা আতহার আলীকে বাদ দিয়ে জাতীয় ইতিহাস রচিত হতে পারে না: ধর্ম উপদেষ্টা জরুরি সভা ডাকল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কক্সবাজারে উৎসবমুখর পরিবেশে রোপা আমন ধান কাটা শুরু চাঁদপুর হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতায় জামিয়া ইসলামিয়া দারুস সুন্নাহর সাফল্য বগুড়ায় আন্দোলনে নিহত রিপনের মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন কুমিল্লায় আন্তর্জাতিক ইসলামী মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত

ভারতের আজাদী আন্দোলন: মুসলিমদের শাহাদাত ইপ্সিত দেশপ্রেম

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মূল: শেখ ফাতিমা বাশীর
রূপান্তর: জাবির মাহমুদ

ভারতের মুক্তির সংগ্রাম– পৃথিবীর ইতিহাসে সবচে’ দীর্ঘতর রক্তত্যাগী সংগ্রামের একটি। আমাদের সংগ্রামী পথপ্রদর্শকেরা ইংরেজদের রাজত্ব থেকে মুক্তি লাভের জন্য প্রায় ৯০ বছর চেষ্টাব্রত রেখেছেন নিজেদের! বীরত্ব ও আত্নত্যাগী প্রতিরোধে ইংরেজ বাহিনীর ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছেন। চূড়ান্ত চেষ্টা ও প্রাণবিলানো মেহনতের বদৌলতে দেশ ছাড়বার জন্য বাধ্য করেছেন, তাদেরকে।

১৮৫৭ সালের সংগ্রামই ছিলো ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রথম মুক্তি সংগ্রাম। যেটা দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরের নেতৃত্বেই হয়েছিলো। স্বাধীনতার সকল যুদ্ধে মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক, হিন্দুধর্মের পন্ডিত, আর্য গোত্রসমূহের নেতৃবৃন্দ, শিক্ষাগুরু, বুদ্ধিজীবী, উকিল, সিপাহী, চিকিৎসক— পুরুষ হোক বা মহিলা, মোটকথা সমাজের প্রতিটা স্তর ও ব্যক্তিত্বের একনিষ্ঠ অংশগ্রহণ ছিলো।

স্বাধীনতার পর ভারতের সরকারও সে-সকল ব্যক্তিদের সম্মানের চোখেই দেখেছে। তাদের ত্যাগ ও চেষ্টাকে মূল্যায়ন করেছে। কিন্তু আপসোস— বর্তমানে স্বদেশবাসী কারো কারো ধারণাই এমন যে, হিন্দুস্তানের স্বাধীনতায় মুসলমানরা কোনো অংগ্রহণমূলক অবদানই রাখে নি! এবং সময়ের সাথে সাথে মুসলমান জানবাজ যোদ্ধাদের বাতচিতও ইতিহাসের কিতাবাদি থেকেও মুছে ফেলা হয়েছে।

এছাড়াও একথা চাওর হয়ে যায় যে, মুসলমান রাহনুমারা নিজেদের জন্য একটা আলাদা রাষ্ট্রের দাবি করেছিলেন! যদিও এটা ভিত্তিহীন। ওইসব রাহবারদের প্রতি মিথ্যারাপ বৈ কিছু নয়। বাস্তবতা তো মূলত— তারা ভারত ভাগ এবং দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরোধিতা করে আসছিলেন প্রবলভাবেই।

তাদের এই বিশ্বাসের উপর আস্থার্জনের জন্য কিছু মুসলমান বাহাদুর ব্যক্তিদের জীবনের উপর সামান্য দৃষ্টিপাত করুন— যারা স্রেফ স্বাধীনতার জন্যই যাবজ্জীবন কারাদন্ড, ফাঁসি, কালাপানির দ্বীপে নির্বাসনের মতো শাস্তিকে বিধিলিপি করে নেন। তথাপিও ইংরেজদের থেকে দেশ রক্ষার যুদ্ধে ছিলেন সংগ্রামরত— (শেষ পর্ব)

ডক্টর জাকের হুসাইন (৮ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৭–১৯৬৯, ৩ মে)

ভারত স্বাধীনতার তৃতীয় ব্যক্তিত্ব। প্রথম মুসলিম প্রেসিডেন্ট। মহাত্মা গান্ধীর অহিংসা নীতির শক্ত সমর্থক। তার চিন্তা ছিলো— ভারতীয় যুবকদের ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা। দরকার ট্রেনিং। সেজন্য স্বাধীনভাবে নীতিমালা তৈরি করা। নিজ দায়িত্বেই করেন সেটা।

ছিলেন জামিয়া ইসলামিয়া দিল্লির সহ-প্রতিষ্ঠাতা। ২২ বছর (১৯২৬–১৯৪৮) সেখানে ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে কর্মরতও। জিন্নার দ্বিজাতি তত্ত্বের ঘোর বিরোধী তিনি। অপিসে ডিউটিরত অবস্থায় জীবনের শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৯৬৩ সালে তাকে 'ভারত রত্ন' এ্যাওয়ার্ডে সম্মানিত করা হয়।

আব্দুল গাফফার খান–ফ্রন্টিয়ার গান্ধী (৬ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯০–১৯৮৮, ২০ জানুয়ারি)

ভারত স্বাধীনতার একজন অ্যানিমেটেড। গুরুত্বপূর্ণ রাহবার। ডাব আন্দোলনের সূচক। এটাকে স্বীয় নেতৃত্বের সফলতায় শেষতক পৌঁছান। তিনিও ভারত ভাগের বিরোধীতায় সামনে সামনে থাকেন। ১৯৮৮ সালের ২০ জানুয়ারি লোকান্তরিত হন।

সায়্যিদ মুহাম্মদ শরফুদ্দিন কাদেরী (১৯০১–২০১৫, ৩০ ডিসেম্বর)

১৯০১ সাল। বিহারের 'নয়ডা'য় জন্ম। গ্রীক ডাক্তারের পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। ১৯৩০ সালে লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশ নেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে লেগে যান। তিনি এক বাহিনী কমান্ডারও ছিলেন। দল প্রস্তুত করার সব বয়ানও জানা ছিলো তার।

ভারত স্বাধীনতার পর রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণই দূরে ছিলেন। পরবর্তীতে ক্রমাগত দেশ চালনায় চেষ্টারত থাকেন। ২০০৭ সালে তাকে "পদ্মভূষণ" এ্যাওয়ার্ড দেয়া হয়। ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর মৃত্যু হয় তার। ১১৪ বছর বয়সে।

মাওলানা মাজহারুল হক (২২ ডিসেম্বর, ১৮৬৬–১৯৩০, জানুয়ারি)

পাটনায় জন্ম। পেশাগত উকিল। ১৮৫৭ সালের দুর্ভিক্ষের সময় সামাজিক কাজের কল্যাণে লোকজন তাকে চিনে। খেলাফত আন্দোলন ও চম্পারন সত্যাগ্রহ আন্দোলন সফলায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

মৃত্যুর পূর্বে তিনি তার সমগ্র সম্পদ শিক্ষা সমৃদ্ধায়নে দান করে যান। ১৯৯৮ সালের এপ্রিলে তার সম্মানে 'মাওলানা মাজাহারুল হক আরবী ও ফার্সি বিশ্ববিদ্যালয়' প্রতিষ্ঠা করা হয়।

আল্লাহ বখ্শ সুম্র (soomro) মুহাম্মদ উমর [আল্লাহ বখ্শ সুম্র] (১৯০০–১৯৪৩, ১৪ মে)

সিন্ধুর রাজ্যপালে তিনি দু'বার— (২৩ মার্চ, ১৯৩৮–১৯৪০, ১৮ এপ্রিল) এবং (৭ মার্চ, ১৯৪১–১৯৪২, ১৪ অক্টোবর) নিজ দায়িত্ব পালন করেন। যাতে লোকদের উন্নতি এবং পরহিতকর কিছু কাজ ছিলো। ১৯৪৩ সালের ১৪ মে চারজন দূর্বৃত্ত মিলে এই মহান মানুষটিকে নির্মমভাবে হত্যা করে।

মাগফুর আহমদ এজাজী (৩০ মার্চ, ১৯০০–১৯৬৬, ২৬ সেপ্টেম্বর)

বিহারের মোজাফফরপুরে তার জন্ম। আজাদী আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য কয়েকবার জেলও খাটেন। জিন্নার দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরোধী ছিলেন। হিন্দুস্তানের স্বাধীনতার পরবর্তী সময় শিক্ষা সমৃদ্ধি ও উর্দু ভাষান্নয়নে জীবন বিলিয়ে দেন।

ইয়ুকুম মাজেদ (২০ সেপ্টেম্বর, ১৯০৯–২০০০, ১০ জুলাই)

ইয়ুকুম মৌলভী ও নারায়ণ পতনে প্রভাবিত হয়ে ১৯৪২ সালে 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলনে শামিল হন। তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনিও জিন্নার দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরোধিতা করেন।

মুহাম্মদ আব্দুর রহমান (১৮৯৮–১৯৪৫, ২৩ নভেম্বর)

কেরলের ত্রিসুর জেলায় জন্ম। ১৯২১ সালের বিশৃঙ্খলাক্রান্ত অঞ্চলসমূহে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন। যার ফলস্বরূপ দুই বছর তার জেলের হাওয়া খেতে হয়।

১৯২৯ সালে কালিকাট থেকে 'আল-আমিন' নামী একটি সংবাদপত্র প্রকাশনা শুরু করেন। যার গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যই ছিলো মুসলিম জনসাধারণের সতর্কতা। তাদেরকে অ্যানিমেটেড করা। লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশ নেয়ার কারণে ৭ বছর জেলবন্দি থাকেন। তিনিও ভারত ভাগের বিরোধী ছিলেন। ১৯৪৫ সালের ২৩ নভেম্বর মৃত্যু হয় তার।

মুহাম্মদ আলী ও শওকত আলী

'হামদর্দ' এবং 'কামরেড' নামী দুটি সাপ্তাহিকী চালু করেন। প্রশাসনের অসন্তোষের ফলস্বরূপ ১৯১৯ সালে তাদেরকে একবার গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে পুনঃ খেলাফত আন্দোলন শুরু করেন তারা। যদ্দরুন (১৯২১–১৯২৩) সময়টাতে শওকত আলীকে দ্বিতীয়বার গ্রেপ্তার করা হয়।

আব্দুল হাফিজ মুহাম্মদ বরকতুল্লাহ [মাওলানা বরকতুল্লাহ] (৭ জুলাই, ১৯৫৪–১৯২৯, ২০ সেপ্টেম্বর)

অগ্নিবর্ষী বয়ান। বিপ্লবী লেখনির মাধ্যমে হিন্দুস্তানের আজাদী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন, তিনি। ১৯২৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর। স্বাধীনতার পূর্বেই তার ইন্তেকাল হয়ে যায়।

ইউসুফ মহর আলী (২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯০৩–১৯৫০, ২ জুলাই)

ভারত ছাড়ো আন্দোলন এবং 'সাইমন ফিরে যাও' শ্লোগান— এই মহান হিন্দুস্তানি, মুজাহিদ মুক্তির নায়ক, সোশ্যালিষ্ট রাহবার থেকেই পাওয়া।

এ তালিকায় আরও রয়েছেন- মুহাম্মদ আমিন— এলাহাবাদ, মৌলভী লিয়াকত হুসাইন— আদিবাসী সমিতি— কোলকাতা, মাকবুল হুসাইন, শেখ আহমদ কিদওয়াই, হাকিম আজমল খান, ডক্টর মুখতার আহমদ আনসারী, ব্যারেস্টার খান মুহাম্মদ জোনিজো, সায়্যিদ আতাউল্লাহ শাহ বুখারী, মাওলানা মুহাম্মদ ইরফান— মুম্বাই, এস কে নাবিবুল্লাহ— এ্যাডভোকেট মুম্বাই, মৌলভী মঞ্জুর আলী তৈয়্যব, হাজী মুসা খান, মাওলানা আব্দুল মাজেদ দরিয়াবাদী, শায়েখ এলাহি বখ্শ, মৌলভী ফাতেহ মুহাম্মদ, আলী আহমদ সিদ্দিকী— পাঞ্জাব, আশফাকুল্লাহ খান, কেওড়া বেগম (মাওলানা মুহাম্মদ আলী জওহারের স্ত্রী), জুলাইখা বেগম (মাওলানা আবুল কালাম আজাদের স্ত্রী), আজগরী বেগম (কাজী আব্দুল রহিমের মাতা), খাদিজা বেগম, মুনিরা বেগম (মাওলানা মাজহারুল হলের স্ত্রী), বেগম সকিনা লোকমানী (বদরুদ্দীন তৈয়্যব জী'র কন্যা), ফাতেমা তৈয়্যব আলী, আমেনা তৈয়্যব জী, রাইহানা তৈয়্যব জী, হামিদা তৈয়্যব জী, আসমত আরা খাতুন, বিবি আমাতুল ইসলাম, রাজিয়া সুলতানা, বেগম জিনাত মহল, এনায়েতুল্লাহ খান মাশরিকী।

[caption id="attachment_175956" align="aligncenter" width="300"] বই কিনতে ক্লিক করুন[/caption]

এছাড়াও সে-সব বীরাত্মাদের এক লম্বা তালিকা রয়েছে, যারা সবাই ছিলেন মুসলমান। ইসলামের শিষ্য হওয়ার পাশাপাশি একেকজন মুজাহিদ দেশরক্ষার্থে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ছিলেন লড়াইরত। নিজেদের জীবনকে করেছিলেন ইচ্ছেখুশি কুরবান।

বর্তমানে মুসলমানদের দেশদ্রোহী কপচানেওয়ালাদের এ কথাটা চিন্তা করা উচিত— যে গোত্রের পূর্বপুরুষেরা নিজেদের জীবন, সম্পদ, ঘরবাড়ি কুরবান করে দেশমুক্তির যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন, তাদের বংশধরেরাই প্রকৃত দেশপ্রেমী না-কি মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকারীদের বংশদরদের থেকে পরওয়ানা বাগিয়ে দেশে বিশৃঙ্খলা, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মান্ধতার অগ্নি প্রজ্জলনে মাথাভাঙ্গা পরিশ্রমে ব্রতীগণ— প্রকৃত দেশদ্রোহী আসলে কারা?

"অন্তর ফুঁড়ে বেরুবে না মরেও দেশেপ্রেম,
আমার মাটি থেকেও আসবে ওফাদারীর খুশবু!"

প্রথম পর্ব পড়ুন - ভারতের আজাদী আন্দোলনে মুসলিম : শাহাদাত প্রার্থিত যেখানে

আরএম/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ