মুহাম্মাদ লুতফেরাব্বী ।।
টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমায় প্রতি বছর পৃথিবীর শতাধিক দেশ থেকে বহু ধর্মপ্রাণ মুসলমান অংশ নিয়ে থাকেন। প্রথম দিকে পরিমাণে কম হলেও সব মিলিয়ে বিদেশি মেহমানের সংখ্যা ২৫ হাজার ছাড়িয়ে যায়। ইজতেমা ময়দানের উত্তর পাশে মেহমানদের জন্য থাকার জায়গা বানানো হয়।
এই অঞ্চলে প্রবেশাধিকার খুব কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় বলে সাধারণ কেউ সেখানে ঢুকতে পারে না। তবে ভেতরের অবস্থা সম্পর্কে জানতে অনেকেই ইচ্ছুক থাকেন। তাই আওয়ার ইসলামের পাঠকদের জন্য কিছু তথ্য এখানে পেশ করা হলো।
বিদেশ থেকে যারা আসেন: বিশ্ব ইজতেমায় বিদেশ থেকে মোট চার ধরনের মেহমান আসেন।
এক. ভারত–পাকিস্তান মারকাযের কেন্দ্রীয় মুরুব্বী উলামায়ে কেরাম ও সব দেশের মারকাজের শুরার সাথীগণ।
দুই. তাবলিগে সময় লাগানো সব শ্রেণির পুরাতন সাথীরা। (তবে তাদের সাথে শুধু ইজতেমার তিন দিন অংশগ্রহণ ও দেখার উদ্দেশ্যে অনেক নতুন সাথীও আসেন।)
তিন. বিভিন্ন দেশের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ এবং সরকারি উচ্চপদস্থ পরিচালক–কর্মকর্তাগণ। মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক দেশের শরীয়া বোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে কেরামও অংশগ্রহণ করেন।
চার. প্রবাসী বাংলাদেশী, যারা শুধুমাত্র ইজতেমার উদ্দেশ্যে দেশে আসেন।
থাকার ব্যবস্থা: মুরুব্বী ও শুরার সাথীদের থাকার ব্যবস্থা টঙ্গী ময়দানে নির্মিত স্থায়ী মাদরাসায় করা হয়। এখানে ভিন্ন ভিন্ন কামরায় তারা অবস্থান করেন। মাদরাসার বড় হলরুমে সব দেশের মুরুব্বী ও শুরা সাথীদের অংশগ্রহণে প্রতিদিন মশওয়ারা অনুষ্ঠিত হয়। এখানে ইজতেমার প্রতিদিনের কারগুজারি শোনানো ও আমল বণ্টন, সব দেশের কারগুজারি শোনানো, বিভিন্ন পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা ও ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারণ করা হয়।
সাধারণ সাথীদের জন্য মৌলিকভাবে চারটি অস্থায়ী টিনশেড তাঁবু বানানো হয়। একটিতে আরব, আফ্রিকা ও রাশিয়ার দেশসমূহ। দ্বিতীয়টিতে পূর্ব এশিয়া ( চিন, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়শিয়া, থাইল্যান্ড ও অন্যান্য), ইউরোপের দেশসমূহ। তৃতীয়টিতে দক্ষিণ এশিয়া ( ভারত, পাকিস্তান, শ্রিলংকা)। এছাড়া স্থান সংকুলান না হলে চতুর্থ তাবুও ব্যবহার করা হয়।
তাঁবু ব্যবস্থাপনা: বিদেশি মেহমানদের সুযোগ–সুবিধা নিশ্চিত করতে কয়েক হাজার মানুষ সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমে নিয়োজিত থাকেন।
১ – যিম্মাদার: প্রতি তাবুতেই কাকরাইল শুরার পক্ষ থেকে যিম্মাদার নির্ধারণ করে দেয়া হয়। তারা পুরো ইজতেমায় উপস্থিত মেহমানদের যাবতীয় বিষয়ের তদারকি করেন।
২ – ট্রান্সপোর্ট: মেহমানদের আনা–নেয়া ও যাতায়াতের ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য এই জামাত কাজ করে। কাকরাইল মসজিদের নিজস্ব গাড়ি ছাড়াও ইজতেমা উপলক্ষে শতাধিক গাড়ি ব্যবহারের জন্য দিয়ে থাকেন যিম্মাদার সাথীরা। ‘বিদেশি মেহমানদের খেদমতে নিয়োজিত’’ স্টিকার সম্বলিত এই গাড়িগুলো এয়ারপোর্ট টু ময়দান নির্বিঘ্নে চলাচলের সুবিধা পায়।
৩ – ইস্তেকবাল: বিদেশি খিমার প্রবেশ মুখেই ইস্তেকবালের কামরা থাকে। এই জামাতের সাথীরা এয়ারপোর্ট থেকে আগত মেহমানদের ইস্তেকবাল করে তাদের লাগেজ–সামানা আনা নেয়ায় সহায়তা করেন। পাশাপাশি প্রত্যেকের পাসপোর্ট এন্ট্রিও করা হয়।
৪ – আমানত: মেহমানদের পাসপোর্ট, টাকা ও মূল্যবান সামগ্রী জমা রাখার জন্য আমানত কামরা থাকে। এখানে ব্যাংকের লকারের মত প্রত্যেকের নামে বিশেষ লকারে তাদের আমানত সংরক্ষণ করা হয়।
৫ – তরজমা: যারা মূল উর্দু বয়ান বুঝেন না তাদের বোঝার সুবিধার্থে দশের অধিক ভাষায় তাৎক্ষণিক অনুবাদের ব্যবস্থা করা হয়। রাইবেন্ড ও নিযামুদ্দিন মাদরাসা থেকে শিক্ষা সমাপনকারী বিদেশি আলেমরাও তরজমায় অংশ নেন।
৬ – তাশকিল: ইজতেমায় বিদেশিদের অধিকাংশই এক বা একাধিক চিল্লায় সময় লাগানোর নিয়তে আসেন। তাদের জামাতবন্দি করা, মুতারজিম ঠিক করা ও রোখ দেয়ার কাজ করেন তাশকিলের সাথীরা।
৭ – মাসয়ালা হল: নানা বয়সী মেহমানদের বিভিন্ন রকম সমস্যা ও প্রয়োজন থাকে। এসব সমস্যা সমাধান ও প্রয়োজন পুরণের জন্য ‘মাসয়ালা হল’ নামে জামাত থাকে। তারা এই খেদমত আঞ্জাম দেন।
৮ – পাহারা: সরকারি প্রশাসনের উদ্যোগে বিদেশি খিমার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হলেও ইজতেমার পক্ষ থেকে পাহারা জামাত থাকে। পালাক্রমে চব্বিশ ঘণ্টা মূল গেট ও প্রত্যেক তাবুতে পাহারা দেয়া হয়।
৯ – অস্থায়ী দোকান: এই দোকানে বেডিং, মশারি, কম্বল, জুতা, সকল প্রকার ফল ও পানীয় সুলভমূল্যে বিক্রি করা হয়।
১০ – মানি এক্সচেঞ্জ: মেহমানদের কষ্ট লাঘব ও প্রতারণা থেকে বাঁচাতে ময়দানেই অস্থায়ী মানি এক্সচেঞ্জ বসানো হয়। সব ধরনের মূদ্রা ক্রয় – বিক্রয়ের সুবিধা থাকে এখানে।
১১ – পরিচ্ছন্নতা: তাবু থেকে বর্জ্য অপসারণ ও টয়লেট–অজুখানা–গোসলখানা পরিষ্কারের জন্য কয়েকটি জামাত থাকে। প্রতিদিন রাত ১২ টার পর এই জামাতের সাথীরা সব ধরনের পরিচ্ছন্নতার কাজ আঞ্জাম দেন।
উল্লেখ্য, উপরোক্ত সব জামাতে তিন চিল্লা দিয়েছেন এমন সাথীদের নির্বাচন করা হয়। প্রত্যেক বিভাগসংক্রান্ত প্রয়োজনীয় সব কিছু তারা নিজেরাই ব্যবস্থা করেন এবং ইজতেমার দুই পর্বের মোট ১৫ দিন সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমে মেহমানদের খেদমত করেন।
খাবার ব্যবস্থাপনা: মেহমান নাওয়াযি ও অতিথিপরায়ণতায় বাংলাদেশিদের সুনাম রয়েছে বিশ্বময়। ইজতেমায় আগত মেহমানদের সর্বোচ্চ আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয় প্রতিবছর। পুরাতন ঢাকার ঐতিহ্যবাহী কয়েকটি পরিবার বংশানুক্রমে এই মহান খেদমতের জিম্মাদারি পালন করে আসছেন। তাদের সাথে বিভিন্ন বিভাগে প্রায় হাজারখানেক স্বেচ্ছাসেবী শরিক হোন।
শুরা মেহমানখানা ও আম মেহমানখানার আয়োজন পৃথকভাবে হয়ে থাকে। উভয় জায়গায় দেশের ভিন্নতা হিসাবে পছন্দমাফিক খাবার পরিবেশন করা হয়। সাথে ২৪ ঘন্টা দুধ চা ও রঙ চা’র ব্যবস্থা থাকে।
আম মেহমানখানার খাবার পরিবেশনের দায়িত্বে থাকেন বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। আর রুটি বানানোয় অংশ নেন কাকরাইল মাদরাসার ছাত্ররা।
বিশুদ্ধতা ও উৎকৃষ্ট মান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সব কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত–খামার থেকে ফরমালিনমুক্তভাবে আনা হয়ে থাকে। খাবার পানি গভীর নলকূপ থেকে উঠিয়ে ফিল্টারিং করে বোতলজাত করা হয়।
বি.দ্র. অনেকেই মনে করেন ইজতেমার এই বিশাল আয়োজনের অর্থের যোগান বিদেশ থেকে হয়ে থাকে। এটি একটি ভিত্তিহীন অমূলক ধারণা; বরং স্থানীয় কিছু ধর্মপ্রাণ মুসলমান আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় আল্লাহর রাস্তার মেহমানদের জন্য এই অর্থ ব্যয় করে থাকেন।
শেষ কথা: টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা বাংলাদেশের জন্য আল্লাহর বিশেষ দান। স্বল্প আয়ের একটি দেশে এত বড় একটি আয়োজন যেভাবে সুচারুরূপে সম্পাদিত হয় তা দেখে বিদেশিরা অভিভূত হয়ে পড়েন। আরবের অনেক বড় বড় উলামায়ে কেরাম প্রথমে তাবলীগ সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব পোষণ করলেও বিশ্ব ইজতেমায় ঘুরে গিয়ে মত পাল্টেছেন। তাই, ছিদ্রান্বেষণ ও ত্রুটি বিশ্লেষণ নয়; ইসলাম ও উম্মাহর কল্যাণ কামনা ও দ্বীনের দাওয়াত বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়ার এই কাফেলার প্রতি আন্তরিকতা ও সাধ্যমত অংশ নেয়াই প্রতিটি মুসলমানের আবশ্য কর্তব্য।
লেখকঃ এমফিল গবেষক, আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়, মিসর
আরএম/