হামদ ও নাতের পর...
মুহতারাম দোস্ত বুযুর্গ! আল্লাহ তায়ালা নিজ ফজলে। রাসূল সা.-এর মেহনতের বদৌলতে এখানে লাখ লাখ মানুষকে জমা হওয়ার তাওফিক দিয়েছেন। সমস্ত নবীরা যে মাকসাদে মেহনত করেছেন, সে মেহনতের নিয়তে আমাদেরকে এখানে জমা করেছেন। হাদিসে কুদসিতে আছে, যে বান্দা তার অপর ভাইকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসেন, তিনিও তাকে ভালোবাসেন।
দ্বিতীয়ত হলো, যারা নিজ পরিবার আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে দ্বীনের জন্য বেরিয়ে যায়, তার জন্য আল্লাহর ভালোবাসা ওয়াজিব হয়ে যায়। আল্লাহ বান্দার আমলের অনেক মূল্য দেন।
একবার রাসূলুল্লাহ সা. মসজিদে এসে সাহাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমরা এখানে কী করো?’ তারা বললেন, আল্লাহর তাসবিহ পড়ছি। নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করছি এবং ঈমানের মুযাকারা করছি। তিনি বললেন, ‘আল্লাহর কসম! তোমরা কি সত্যিই এজন্য বসেছো? তারা বললেন, আল্লাহর কসম আমরা এজন্যই বসেছি।
রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, আমি তোমাদের থেকে কোন খারাপ ধারণাবশত কসম নেইনি বরং একটু আগে জিব্রাইল আ. এসে খবর দিয়েছেন যে, তোমাদের এ কাজ দেখে আল্লাহ তোমাদের নিয়ে ফখর করছেন। আল্লাহ আমাদেরও সে কাজের জন্য এখানে জমা করেছেন।
হাদিসে এসেছে একবার রাসূল সা. সাহাবায়ে কেরামকে আল্লাহর রাস্তায় বের হওয়ার জন্য তাশকিল করলেন, তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। তাই তারা মদীনাতেই থেকে যাওয়ার ইচ্ছা করলেন। রাসূল সা. বললেন, তোমরা কি চান না যে, তোমরা বেহেস্তের বাগানে অবস্থান করো? এরপর সাহাবায়ে কেরাম ময়দানে চলে গেলেন এবং সেখানে রাত্রি যাপন করলেন।
গতকাল আপনারা এখানে এসেছেন। নামাজ পড়েছেন, দুআ করেছেন। সাথীরা আসছে, জায়গা পাচ্ছে না। তারপরও নিজেরা মুজাহাদা করে জায়গা করে দিচ্ছেন। এর বদৌলতে আল্লাহ কত না মানুষের হেদায়েতের মাধ্যম বানিয়ে দিবেন।
রাসূল সা. বলেন, যারা দুনিয়াবাসীর উপর রহম করে, আল্লাহ তাদের উপর রহম করেন। মানুষ তো ছোট, তার রহমও ছোট হবে। কিন্তু আল্লাহ তা বড় করে কবুল করেন। তাদেরকে রহমত ও বরকত দান করেন। আমাদের রহমের বদলা অমুসলিমদেরকেও দীন গ্রহণের সুযোগ করে দিবেন এবং অন্য প্রাণীরাও শান্তি থাকবে।
আল্লাহ তাআলা কত নিয়ামত দিয়েছেন- তিনি বলেন, তোমরা আমরা নিয়ামত গুণে শেষ করতে পারবে না। এর মধ্যে কিছু নিয়ামত হলো, বস্তুগত। আর কিছু আত্মিক বা রূহানী। বস্তুগত নিয়ামত পাওয়ার পর রূহানী নিয়ামতের মধ্যে বড় কিছু হল, ঈমান, ইসলাম ও দীন। যারা দীনের উপর চলবে, এর বদলে তার আরামের সাথে মৃত্যু হবে। জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাতে জায়গা পেয়ে যাবে। যে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে গেল, সে তো মহা সৌভাগ্যবান।
এ দীনের মূল হলো, কালিমা লাইলাহা ইল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। এটি ঈমান ইখলাস ও তাকওয়ার কালিমা। এর দ্বারা বান্দা গুনাহ থেকে বিরত থাকে। ঈমানওয়ারার ঘরে যখন সন্তান আসে, তাকে কালিমা দিয়ে তার জীবন শুরু হয়। আর কালিমা পড়ে মৃত্যু হলে, সেও মুক্তি পেয়ে গেল।
হাদিসে আছে, ‘দুনিয়ার সবকিছু একপাল্লায় ও কালিমা আরেকপাল্লায় রাখা হলে কালিমার পাল্লাই ভারী হয়ে যাবে।’
এটি এত উঁচু কালিমা একবার রাসূল সা. এর কাছে দুজন ইহুদী এসে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার কালিমার সবচে বড় সাক্ষি কী?
নবীজী চুপ রইলেন, একটু পর জিব্রাইল ওহী নিয়ে এসে বললেন, আল্লাহ নিজে সাক্ষী দিয়েছেন, ফেরেশতারাও সাক্ষী দিয়েছে। এটা শুনে রাসূলের হাতে চুমু দিল ও মুসলমান হয়ে গেল।
প্রিয় ভাইয়েরা !
একবার রাসূল সা. বলেন, আল্লাহ বিগত যত নবীদেরকে যা ইলম দিয়েছেন, আমি তার চেয়েও বেশি ইলম রাখি। তার মধ্যে সবচে বড় ও উচু ইলম হল কালিমা লাইলাহা ইল্লাহ। কালিমার চাহিদা হলো, এর উপর আমাদের ইয়াকিন ও বিশ্বাস নিয়ে আল্লাহ যে হুকুম দিয়েছেন, তা পালন করা।
একবার রাসূল সা. কুরাইশের এক মজলিসে আসেন, যেখানে আবু জেহেল ও আবু সুফিয়ানও ছিল। নবীজি বললেন, আমার কাছে এমন একটি কালিমা আছে, তা যদি তোমরা মেনে নেও। তাহলে আরব আজম রোম পারস্য তোমাদের কাছে নত হয়ে যাবে এবং সবকিছু তোমাদের পদানত হবে।
এরপর আবু জাহল দাঁড়িয়ে বলল, যদি তাই হয়, তাহলে তোমার পিতার কসম, আমরা এমন দশটি কালিমা কবুল করতে রাজি। তারা কবুল না করলেও অন্য সাহাবায়ে কেরাম তা কবুল করেছেন এবং রাসূলের কথা পরবর্তীতে সত্য প্রমাণিত হয়েছে।
ঈমানের পরে আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবচে বড় যে আদেশ দিয়েছেন, তা নামাজ। আর ইবাদতের মধ্যে সবচে বড় হলো নামাজ। এর মাধ্যমে বান্দা গুনাহ থেকে বিরত থাকতে পারে। আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় নামাজ অশ্লীলতা ও পাপাচার বিরত রাখে।
এক নতুন সাহাবী ছিল, যার পূর্বেকার কিছু খারাব অভ্যাস রয়ে গিয়েছিল। সাহাবায়ে কেরাম নবীজিকে তার এই বিষয়ে জানালেন। নবীজি বললেন, তোমরা তাকে উত্তমরূপে নামাজ শিক্ষা দাও। নামাজ তাকে এ খারাপ অভ্যাস থেকে ফিরিয়ে আনবে। কিছুদিন পর তেমনি হলো। যদি আমাদের নামাজে রূহ থাকে। সমস্ত হক আদায় করে, নামাজ পড়ি। ঘরের নামাজ চালু করি। তাহলে আমাদের চারপাশের পরিবেশ পবিত্র হয়ে যাবে।
আমরা গুনাহ থেকে বিরত থাকতে পারব। নামাজ এমন একটি ইবাদত যেখানে বান্দা পুরা শরিরকে আল্লাহর ইবাদতে লাগিয়ে দেন। যেমনটা অন্যকোন আমলে হয় না। নামাজের এই ফরজ বিধান আল্লাহ রাসূলের মাধ্যমে মেরাজের সময় দিয়েছেন। প্রথমে পঞ্চাশ ওয়াক্ত থাকলেও পরে পাঁচ ওয়াক্ত হয়ে যায়।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে নবী! তোমার উম্মতরা যদি এই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে তাহলে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজের সওয়াব দান করা হবে।
এমনি ঘটনা হলো, হযরত উকবা ইবনে আমের রা. মরুভূমিতে উট চালাতেন। একবার তিনি রাসূল সা. এর
দরবারে হাজির হলেন। নবীজি বয়ান করছিলেন, যে ভালোভাবে অযু করে নামাজ আদায় করবে। আল্লাহ তার পিছনের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দিবেন। তিনি একথা শুনে খুশিতে বাগ বাগ হয়ে গেলেন। পাশে বসা উমর রা. জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি এত খুশি কেন? তিনি রাসূলের কথা পুনরাবৃত্তি করলেন।
উমর রা. বললেন, এর আগে এর চেয়েও দামী কথা বলেছেন। তাহলো যে উত্তমরূপে অযু করে, এবং শেষে আশহাদু আল্লাইলাহা ইল্লাহু ও আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ও রাসুলুল্লাহ বলবে। তার জন্য বেহেস্তের আটটি দরজা খুলে দিবেন।
যদি আমাদের মধ্যে তাকওয়া আসে তাহলে আসমান জমিনের বরকত লাভ করবে। পূর্ববর্তী নবীরা শুধু দীন শিখাতেন আমাদের নবী সর্বশেষ নবী তিনি খাতামুন্নাবিয়্যীন। তার খতমে নবুওয়াতের কারণে তিনি দুটি কাজ করতেন- দীন শেখানো এবং সাহাবায়ে কেরামকে দীনের মেহনতে লাগানো। তাই তো ইসলামের শুরুতে যারাই দ্বীন গ্রহণ করতো, তারা সাথে সাথে দাঈও হয়ে যেত।
কুরআনে এই উম্মাহকে সর্বত্তম উম্মাহ বলা হয়েছে। এটা হয়েছে রাসূলের খতমে নবুওয়াতের কারণে। একবার আল্লাহ ঈসা আ.কে বললেন, তোমার পরে এমন একটি জাতি আসবে, যারা ইলম ও হিলম না থাকার পরেও সকল পেরেশানীতে আমার দিকেই ঝুঁকবে। এব আমার কাছেই সাহায্য চাইবে। ঈসা আ. বললেন, এটা কীভাবে সম্ভব?
আল্লাহ বললেন, আমি তাদেরকে আমার নিজ ইলম ও হিলম দান করব। যার উত্তম নমুনা দেখা যায়, আম্মার বিন ইয়াসির রা. এর পরিবারে। নবীজি তাদের পাশ দিয়ে অতিক্রম কালে বলতেন , তোমরা আল্লাহর জন্য এই কষ্ট সহ্য কর। আল্লাহ তোমাদেরকে এর বিনিময়ে নিশ্চয় জান্নাত দান করবেন।
আল্লাহ বলেন, যদি তোমরা আমার দ্বীনের সাহায্য করো, তাহলে আমি তোমাদের সাহায্য করবো। তাইতো মদীনায় সাহাবায়ে কেরাম প্রথমে ছয়জন ছিলেন, এরপর আশিজন তাদের দাওয়াতে পুরো মদীনাবাসী ইসলাম গ্রহণ করে। নবীজি তাদের মাঝে হিজরত করেন।
দীনের নুসরত করতে গিয়ে তারা মুহাজিরদের সকল ব্যয়ভার গ্রহণ করে নেন। মুহাজিররা সবসময় দাওয়াত ও জিহাদের কাজে লেগে থাকতেন। আনসাররা সকল দুনিয়াবী প্রয়োজন পুরা করতেন। আস্তে আস্তে বাইরের লোকেরাও আসতে থাকে। আনসাররা তাদেরও একরাম ও খেদমদ করতে থাকে। এভাবে তাদের ব্যয়ভার বেড়ে যায়। কিন্তু আল্লাহ তাদের এই অল্পতেই বরকত দিয়েছিলেন।
এক বর্ণনায় আছে নবীজি সাহাবীদেরকে প্রায় একশ পঞ্চাশবারের মত যুদ্ধে পাঠিয়েছেন। তিনি নিজেও পঁচিশ থেকে উনত্রিশ বারের মত অংশ নিয়েছেন। আনসাররা এ সমস্ত যুদ্ধে নিজেরা শরিক হয়েছেন এবং মুহাজিরদেরকে
সহোযোগিতা করেছেন। এর বিনিময়ে আল্লাহ তাদের সবকিছুতে বরকত দিয়েছেন।
আমরাও যদি এভাবে দ্বীনের নুসরত করি, তাহলে আল্লাহ আমাদের জান- মালে ও বরকত দিবেন। হুনাইনের যুদ্ধ শেষে নবীজি আনসারদেরকে কোন গনিমত দিলেন না। তারা কিছুটা মনোক্ষুণœ হলে রাসূল তাদের ডেকে বললেন, তোমরা কি গোমরাহ ছিলে না? অতপর আমার মাধ্যমে হেদায়েত প্রাপ্ত হয়েছো? এবং তোমরা কি দরিদ্র ছিলে না? তারপর তোমাদের মালে বরকত হয়েছে। তোমরা কি চাওনা মুহাজিররা সমস্ত মাল নিয়ে নিক। আর তোমরা আল্লাহ রাসূলকে নিয়ে বাড়ি ফির। তোমরা যদি কোন পথে চলো আমি তোমাদের পথই চলবো। আনসাররা হলো আমার অঙ্গের মত আর সাহাবায়ে কেরাম আমরা জামার মত।
আনসারদের এই ফজিলত লাভ হয়েছে দীনের নুসরতের দ্বারা। আরেক হাদিসে বলেন, তোমাদের জন্য প্রকাশ্য দীনের উপর চলতে পারবে যতক্ষণ তোমরা দুটি জিনিস থেকে বেঁচে থাকবে। এক, জাহালাত বা অজ্ঞতা । দুই, হুব্বুত দুনিয়া বা দুনিযয়ার ভালোবাসা। মানুষকে দীদ্বীনের দিকে ডাকবে, এবং এই অজ্ঞতা ও লোভ থেকে বেঁচে থাকবে, আল্লাহ আমাদেরকে মুহাজিরও আনসার দের মত প্রতিদান দিবেন।
হযরত জী ইলিয়াস রহ. কান্না ও মেহনতের বদলে এ কাজ নতুন ভাবে জীবন্ত হয়েছে। এ জন্য আমরা নিয়ত করি, পিছনের জীবনে যত গুনাহ হয়েছে তার জন্য ক্ষমা চাই একাজ থেকে ইতিপূর্বে যতদিন গাফেল ছিলাম, তার জন্য ইস্তিগফার করি। এবং জীবনের বাকি অংশ দ্বীনের এ কাজের জন্য লাগাব।
হাজি সাহেব রহ. বলতেন, যদি এ কাজ সমস্ত ছিফাতসহ চালু হয়ে যায় তাহলে হেদায়েতের সূর্য ওঠবে। সূর্যের উঠার আলো দ্বারা যেভাবে আধার দূর হয়, তেমনিভাবে মেহনতের দ্বারা গোমরাহি দুর হয়ে যাবে এবং প্রত্যেক ঘরে ঘরে হেদায়েতের আলো পৌঁছে যাবে। এজন্য আমরা নিয়ত করি, এখান থেকে আল্লাহর দীনের জন্য বেরিয়ে যাই। যদি বাড়িতে যাই, তাহলে সেখানে এ কাজে পূর্ণভাবে শরিক থাকব। আল্লাহ আমাদের কবুল করুন। আমিন।
মূল: মাওলানা খুরশিদ আলম (রায়ব্যান্ড)
অনুবাদ: যমীর মাহমূদ
আরএম/