মাসউদুল কাদির।।
একটা নাম শুনলেই, একটা সুর কানে বাজলেই, একটা তেলাওয়াতের শব্দ শুনতে পেলেই মনের গভীরে অনেকখানী শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সংগীত বেজে উঠতো। আল্লামা তাফাজ্জুল হক রহ. সেই সুর সংগীতময় ভালোবাসার শ্রেষ্ঠ মানুষ ছিলেন।
ছোটবেলার সেই স্মৃতিগুলো প্রতিনিয়ত ভাস্বর হয়ে ওঠে। কেবল তার বয়ান শুনতেই, কেবল তার কণ্ঠে কোরআনের মুজেজাময় তেলাওয়াত শুনতেই রাত কি রাত হেঁটেছি, অন্ধকারে আছাড় খেয়ে পড়েছি, কখনো খারাপ লাগেনি।
আমাদের গ্রামের নাম খড়কী। হবিগঞ্জের মাধবপুরের একটি আদর্শ গ্রাম। নিজের গ্রামকে আদর্শ গ্রাম বলতে ইচ্ছে করে। তবে সেই আদর্শের কিছুই বাকি নেই এখন আর। এইখানে অনেক মানুষ ছিল, আলেম ছিল, ভালোবাসা ছিল। তাদের কারণেই দেওবন্দী আলেমদের সেই গ্রামে কদর ছিল।
আল্লামা তাফাজ্জুল হক রহ.কে এই গ্রামের মানুষেরা কতখানী ভালোবাসেন তা বলে কয়ে শেষ করা যাবে না। গ্রামের মানুষদের বর্তমান অবস্থা যতটাই নিচে নেমে যাক না কেন? দুয়েকজন ভিন্নমতের মানুষ ছাড়া প্রত্যেকটি মানুষই হবিগঞ্জের গর্বের প্রতীক এই আলেমের জন্য আজ চোখ ভেজাবে।
যখন তিনি খড়কী মাদরাসার মাহফিলে বয়ানে বসতেন তখন কেউ পথেঘাটে হাঁটতো না। নিবিড়ভাবে তার বয়ান শুনতো। তার ধমকটাও নিজেদের পথচলার পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করতো মানুষ। এইসব সমাজের মানুষের কাছে গেলেই বোঝা যায়।
তার আধ্যাত্মিক পাওয়ার অতটাই ক্ষমতাসম্পন্ন ছিল যে, রাষ্ট্রের উচ্চস্তরের মানুষজনও তাকে নিয়ে ভাবতো। হবিগঞ্জে নানা ধরনের অপতৎপরতাকে তিনি রুখে দিতেন কেবল ব্যক্তিত্ব দিয়ে।
একজন ক্রীড়ামোদীর গল্প বলি। একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যাচ্ছিলেন হবিগঞ্জে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার জন্য। সবার সহযোগিতা চাচ্ছিলেন। উল্লেখিত ক্রীড়ামোদির কাছে জানতে চাইলেন, অমুক অমুককে এনে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা যায় না? তিনি বললেন, বাধা আছে।
তিনি জানতে চাইলেন, কীসের বাধা। এখন তো সবকিছু ঠিকঠাকই চলছে।
তখন ঐ ক্রীড়ামোদি বললেন, মাওলানা তাফাজ্জুল হক।
হয়তো আল্লামা তাফাজ্জুল হক রহ.-এর সঙ্গে কথাও বলা হয়নি। আধ্যাত্মিক ক্ষমতায়নের জায়গাটা এই রকমের ছিল, তিনি সবার আলোচনায় উপস্থিত থাকতেন। ক্ষমতা বলি আর প্রভাব বলি, তা রাখতেন। অপসংস্কৃতির সয়লাব এভাবেই তিনি রুখে দিতেন। হবিগঞ্জে আলেমদের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায়ও তার অবদান অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
আল্লামা তাফাজ্জুল হক রহ.-এর মতো শ্রেষ্ঠ আলেম আর দ্বিতীয়জন এই সময়ে ছিলো না, মেধাবী বলবেন, হাদিসের দখল বলবেন বা আধ্যাত্মবাদ বলবেন বা দেওবন্দের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে বলবেন- তিনি ছিলেন রৌদ্রোজ্জ্বল, গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। আজ সত্যটা হলো, আমাদের প্রিয় হবিগঞ্জবাসী একজন সুন্দর মানুষকে হারালো।
আল্লামা তাফাজ্জুল হক রহ. জন্মেছিলেন ১৩৫৯হি. মোতাবেক ১৯৩৮ই.। তার পিতা মাওলানা শাইখ আব্দুন-নূর রহ.(মৃত: ১৯৯৮ইং)। প্রায় আশি বছর বয়স পেয়েছেন তিনি। হবিগঞ্জ শহরের অদূরে ‘কাটাখালী’ গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মলাভ করেন।
তাঁর পিতা শাইখ আব্দুন-নূর রহ.ছিলেন বিজ্ঞ আলিম ও সমাজ সংস্কারক। মাওলানা তাফাজ্জুল হক -এর নানা হলেন, আল্লামা আসাদুল্লাহ রহ.। তিনি বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম সারির একজন সিপাহসালার ছিলেন। হবিগঞ্জ এলাকার বিশিষ্ট সমাজ সেবক ও সমাজ সংস্কারকও ছিলেন তিনি।
মাওলানা তাফাজ্জুল হক তাঁর পাঁচ ভাইদের মাঝে তিনিই বড়। তাঁর অন্যান্য ভাইও নিজ নিজ ময়দানে সফল ব্যক্তিত্বের অধিকারী।
পড়াশোনার হাতেখড়ি পিতা-মাতার কাছেই। পিতা আব্দুন-নূর রহ. ছিলেন একজন বিজ্ঞ আলিম ও সফল শিক্ষক। এরপর তিনি হবিগঞ্জের অদূরে রায়ধর গ্রামের ঐতিহাসিক মাদরাসা ‘জামিয়া সা’দিয়্যায়’ ভর্তি হন। সেখানে তিনি তাঁর মামা আল্লামা মুখলিসুর রহমান রহ.(মৃত ১৪২২হি.) এর নিকট আরবী ব্যাকরণ ও আরবিভাষা রপ্ত করেন। পরে হাটহাজারী মাদরাসা থেকে ১৯৬০-৬১ইং সনে ‘দাওরায়ে হাদীস’ সফলতার সাথে সম্পন্ন করেন।
আশাবাদের কথা হলো, হবিগঞ্জে আল্লামা হবিগঞ্জী এমন একটি চারা রোপণ করে গেছেন তা কিয়ামত পর্যন্ত আলো দিয়ে যাবে। উমেদনগ মাদরাসা সেই স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে টিকে থাকবে অনেক দিন। আল্লাহ তাআলা এই মহান বুজুর্গের পরকালের দারাজাত বুলুন্দ করুন। আমীন।
লেখক : প্রিন্সিপাল, ইকরা বাংলাদেশ হবিগঞ্জ
আরএম/