মুফতী জুবায়ের রশীদ ।।
ঢাকাসহ সারাদেশে ইতোমধ্যে শীতের প্রকোপ বেড়েছে। শৈত্য প্রবাহ শুরু হয়েছে। পৌষের ভোরে পেঁজা তুলার মতো ঝরছে কুয়াশা। নিদারুণ শীতে কাঁপছে দেশ। শীত এলে চরম ভোগান্তির শিকার হয় এ দেশের ছিন্নমূল মানুষ। অসহায় দরিদ্রজনদের ভোগান্তির শেষ নেই। একেকটি রাত কাটে তাদের নিদারুণ যন্ত্রণাতায়।
বিশেষকরে উত্তরাঞ্চলে বরাবরই শীতের মাত্রা তীব্র হয়ে থাকে। তাদের দুর্ভোগের সীমা ছাড়িয়ে যায় সবকিছু। ঝড় বৃষ্টির মোকাবিলা করতে হয় শীতের বিষণ্ণ প্রহরেও। এইতো আর কিছুদিন পর থেকেই পত্রিকার পাতায় শোকের কালিতে ছাপা হবে অমুক জায়গায় শৈত্যপ্রবাহ এতোজন মারা গেছেন। আরো নানান দুঃসংবাদ।
প্রতিবছরই শীত আসলে এসব সংবাদ আমরা বেশ উদ্বেগ উৎকণ্ঠার সাথে পড়ি। আর নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। দুঃখবোধ করি তাদের এমন বেঁচে থাকা দেখে। তাদের মানবেতর জীবনাচার,অসহায় হাড় জিরজিরে রুগ্ন শরীর দেখে। সামান্য শীত নিবারণের বস্ত্রটুকুও থাকে না শরীরে। আল্লাহর ইচ্ছায় প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই ঋতুর পালাবদল ঘটে। প্রকৃতির আচরণ মানুষের অসহায়ত্বকে আরও প্রকট করে তোলে। হাড়কাঁপানো এই শীতেও অনেককে খোলা আকাশের নিচে রাত যাপন করতে হয়।
ছিন্নমূল অসহায় মানুষ খড়কুটা জ্বালিয়ে শীত মোকাবিলার প্রয়াস চালায়। নিদারুণ শীতে তাদের পিঠের উপর শক্ত রশির মতো ভেসে উঠে শরীরের রগগুলো। সত্যিই ভাবতে ভারি কষ্ট হয়। কান্না করতে ইচ্ছে করে। সেই সাথে মায়াও হয় অনেক। এই মায়া তৈরি হওয়াটাই মানবতা। মনুষ্যত্বের আদর্শিক দাবি। মূল্যবোধের পরিচায়ক।
ঘোর দুর্দিনে তাদের পাশে একটু দাঁড়ানো। কিঞ্চিত সাহায্যের জন্য হাত বাড়ানো। অন্তত একটি শীতের কাপড় নিয়ে। সামর্থের সীমানা থেকে সহায়তা পৌঁছে দেওয়া। পরোপকারে নিজেকে খানিকটা শামিল করা। শুধুই কি মানবতা,পরোপকার আর সহানুভূতি? না, আমাদের ধর্ম পবিত্র ইসলামও দিয়েছে এর সবিশেষ গুরুত্ব। উচ্চারণ করেছে উৎসাহের সর্বোচ্চ ভাষা। দিয়েছে উত্তম বিনিময়ের প্রদানের ঘোষণা।
মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন, যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান খায়রাত কর, তবে তা কতই না উত্তম। আর যদি কর গোপনে এবং অভাবগ্রস্তদের দিয়ে দাও তবে তা তোমাদের জন্য আরও উত্তম। আল্লাহ তোমাদের গোনাহকে ক্ষমা করে দিবেন। (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৭১)।
অপর আয়াতে আরো ঢের গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন,আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করে দেন এবং দান খায়রাতকে বর্ধিত করেন। সুরা বাকারা, আয়াত: ২৭৬)
আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা হালাল ছাড়া অন্যকিছু গ্রহণ করেন না। যে ব্যক্তি কোনো হালাল জিনিস সদকা করে সেটা আল্লাহ তায়ালা তার ডান হাতে গ্রহণ করেন। যদিও একটি খেজুরই হোক না কেন। এটি বাড়তে থাকে পরম দয়াময় প্রভুর হাতে। এমনকি পাহাড় হতেও বড় হয়ে যায়। ( তিরিমিযি, হাদীস: ৬৬১)
অন্যত্র বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের পার্থিব একটি মুসিবত দূর করবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার মুসিবতসমূহ দূর করে দেবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো অভাবী মানুষকে সচ্ছল করে দিবে, আল্লাহ তাকে ইহকাল ও পরকালে সচ্ছল করে দিবেন এবং আল্লাহ বান্দার সাহায্য করবেন যদি বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্য করে। (মুসলিম) দিগুণ উৎসাহিত করার জন্য তিনি আরও বলেছেন, দান অবশ্যই প্রতিবারের ক্রোধ প্রশমিত করে এবং অপমৃত্যু প্রতিহত করে। ( তিরমিযি, হাদীস: ৬৬৪)
আরও বিভিন্নভাবে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে, যেনো অসহায় আর্ত মানবতার সেবায় এগিয়ে আসে মানুষ। নিঃস্বার্থভাবে বিপদগ্রস্ত মানুষের সাহায্য ও সেবা করাই মানবধর্ম। এ মহৎ ও পুণ্যময় কাজই সর্বোত্তম ইবাদত। অসহায় মানুষের দুর্দিনে সাহায্য, সহানুভূতি ও সহমর্মিতার মনমানসিকতা যাদের নেই, তাদের ইবাদত-বন্দেগি আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না। সুতরাং ব্যক্তিগত নামাজ, রোজার সঙ্গে কল্যাণের তথা মানবিকতা ও নৈতিকতার গুণাবলি অর্জন করাও জরুরি।
এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, পূর্ব ও পশ্চিম দিকে তোমাদের মুখ ফেরানোতে কোনো পুণ্য নেই, কিন্তু পুণ্য আছে কেউ আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতাগণ, সব কিতাব এবং নবীদের প্রতি ইমান আনয়ন করলে এবং আল্লাহ-প্রেমে আত্মীয়স্বজন, এতিম, মিসকিন, পর্যটক, সাহায্যপ্রার্থীদের এবং দাসমুক্তির জন্য অর্থ দান করলে, নামাজ প্রতিষ্ঠা করলে ও জাকাত প্রদান করলে এবং প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা পূর্ণ করলে, অর্থসংকটে, দুঃখ-ক্লেশে ও সংগ্রাম-সংকটে ধৈর্য ধারণ করলে। এরাই তারা, যারা সত্যপরায়ণ এবং তারাই মুত্তাকি। (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৭৭)
ধর্মের উৎসসমূহের দিকে তাকালে রাশি রাশি বাণী খুঁজে পাই যেখানে পরোপকার ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষকে মানুষের পাশে দাঁড়াতে বলা হয়েছে। বিশ্বমানবতার আশিষ হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এক মুসলমান অন্য মুসলমানকে একটি কাপড় দান করলে আল্লাহ তাকে জান্নাতের একটি পোশাক দান করবেন। ক্ষুধার্ত অবস্থায় কাউকে খাদ্য দান করলে আল্লাহ তাকে জান্নাতের সুস্বাদু ফল দান করবেন। কোনো মুসলমানকে তৃষ্ণার্ত অবস্থায় পানি পান করালে আল্লাহ তাকে জান্নাতের সিলমোহরকৃত পাত্র থেকে পবিত্র পানি পান করাবেন। (সুনানে আবু দাউদ)
অপরের কষ্ট দুঃখে তাদের পাশে দাঁড়াবার সর্বোচ্চ বাণীর ঘোষণা দিয়েছে আমাদের ধর্ম ইসলাম। তাই মানবিক চেতনাকে বুকে ধারণ করে ধর্মের মন্ত্রে আশাবাদী এবং যুগপৎ উদ্বুদ্ধ হয়ে অসহায় শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। সাহায্য ও সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। নৈতিক ও আত্মিক দাবি থেকে নিজেকে এগিয়ে আসতে হবে। অপরকে এগিয়ে আসার কার্যকরী আহ্বান করতে হবে। সমাজের বিত্তবান ও মানবিক বোধসম্পন্ন ব্যক্তিরা যদি দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পাশে না দাঁড়ায়, তা হলে মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়বে। এ ক্ষেত্রে সবাইকে নিজ নিজ দায়িত্ববোধ থেকে এগিয়ে আসতে হবে।
ব্যক্তিপর্যায়ের উদ্যোগ, প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ক্যাম্পাস আয়োজন ও সামাজিক সংগঠনেরসহ বিভিন্ন মাধ্যমে এমন পরিস্থিতি থেকে শীতার্তদের রক্ষা করার কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে। অধিকতর এগিয়ে আসতে হবে দেশের বিত্তবান নাগরিকদের।
সরকারীভাবেও গ্রহণ করতে হবে বৃহৎ কর্মসূচি। তাহলেই শীতের অসহ্য যাতনা থেকে মুক্তি পাবে অসহায় মানুষজন। ফুলের মতো হাসি ফুটবে তাদের মুখে। সুন্দরভাবে বেঁচে থাকবে তারা। বেঁচে থাকবে আমাদের মানবতা ও ধর্মের সুখের অধ্যায়গুলো। হৃদয়ে বইবে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ভালোবাসার হিল্লোল।
লেখক : তরুণ আলেম ও শিক্ষক