মুফতী জুবায়ের রশীদ
তরুণ আলেম ও লেখক
১৯৭১ আমাদের জাতীয় ইতিহাসের স্মারক অধ্যায়। হাজার বছরের বাঙালির শ্রেষ্ঠতম বছর। আনন্দের। বিয়োগের। সুখের। কষ্টের। বিজয়ের। আত্মত্যাগের। আমাদের বিগত ও অনাগত সমস্ত সফলতার শিকড় এই ৭১। দীর্ঘ নয়টি মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর অত্যাচারী পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী হাত থেকে মুক্ত হয় সুজলা সুফলা শষ্যের আকর এই বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সাতচল্লিশ হাজার গ্রাম। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের মানচিত্র। বিনিময়ে রক্তের গঙা বহেয়ে। লাশের পাহাড় জমেছে। আগুনে পুড়েছে মাটি ও মানুষ আমদের সম্পত্তি।
২৬ মার্চ দেশব্যাপি মুক্তি আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পনের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। বিশ্ব মানচিত্রে অঙ্কিত হয় এক নতুন দেশ। গড়ে উঠে নতুন সীমানা। জন্ম লাভ করে স্বাধীন বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে দল মত নির্বিশেষে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সবাই। নারী পুরুষের বিভেদ ছিলো না।
কিশোর যুবাদের ভূমিকা ছিলো প্রশংসনীয়। সকলের সাথে আলেম সমাজও দেশ ও জাতির স্বার্থে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অন্যায় ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। রেখেছেন যথার্থ ভূমিকা। কিন্তু সাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে আলেমদের নাম উচ্চারিত হলেই ঘৃণা ভরা তাচ্ছিল্য ঝরে পড়ে একশ্রেণির মানুষের মুখে। তারা তাদের বই পুস্তক সিনেমা চলচ্চিত্রে আলেমদেরকে রাজাকার হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
অথচ তা স্পষ্টত মিথ্যা। বানোয়াটি। ইতিহাসের সাথে প্রতারণা বৈ কিছু নয়। বাস্তবতা হলো, আলেমসমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে আলেম সমাজের কথা তেমন আলোচনা হয় না। আলেম বলতেই’ মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকা, অবদান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়। এটা ইতিহাসের অবিসংবাদিত সত্য ও অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়। এ সত্যকে পদদলিত করা হচ্ছে। ইতিহাসের পবিত্র দেহকে করা হচ্ছে ক্ষত-বিক্ষত। আলেম সমাজের গায়ে এঁকে দেয়া হচ্ছে রাজাকার, আল-বদরেরর অভিশপ্ত ফলক।
২৫ শে মার্চ গণহত্যার পরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ না হলেও যাত্রাবাড়ি মাদরাসা ও লালবাগ মাদরাসাসহ তৎকালীন বড় বড় মাদরাসাগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। উলামায়ে কেরাম ছাত্রদেরকে দেশের জন্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
তৎকালীন জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম পাকিস্তানের সেক্রেটারি মুফতি মাহমুদ ২৬শে মার্চ পূর্ববর্তী ঢাকায় এসে জমিয়ত নেতাদের বলে গিয়েছিলেন, আপনারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলুন,দেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য উৎসাহিত করুন।
দেশের আলেমসমাজ ও সাধারণ জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করার জন্য সমকালীন বাংলাদেশের শীর্ষ আলেম আল্লামা মুহাম্মদুলাহ হাফেজ্জি হুজুর রহ. বলেন, এ যুদ্ধ ইসলাম আর কুফরের যুদ্ধ নয়, এটা হলো জালেম আর মজলুমের যুদ্ধ। পাকিস্তানিরা জালেম, এদেশের বাঙালিরা মজলুম। তাই সামর্থ্যের আলোকে সকলকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হবে এবং এটাকে প্রধান কর্তব্য বলে মনে করতে হবে।
বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় একটি কওমি মাদরাসার হলো চট্টগ্রাম পটিয়া মাদরাসা। মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান পটিয়া মাদরাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। তখন তাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন পটিয়া মাদরাসার মুহতামীম আল্লামা দানেশ রহমাতুল্লাহ আলাইহি। এ ঘটনা জানতে পেরে পাক বাহিনী নির্বিচারে বোমা হামলা করে। শহীদ হন আল্লামা দানেশ রহমাতুল্লাহ আলাইহিসহ আরো অনেকে।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বেলাল মোহাম্মদের লেখা ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’বইটির ৫৪,৫৫,১০২ পৃষ্ঠায় এই ঘটনার বর্ণনা রয়েছে। মুফতি আমিমুল ইহসান রহ. সত্তরের দশকের এদেশের একজন প্রথিতযশা ইসলাম বিশেষজ্ঞ বুজুর্গ আলেম। তিনি পাকিস্তানি জুলুম নিপীড়নের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ইয়াহিয়া সরকার রুষ্ট হয়ে তাকে জোরপূর্বক সৌদি আরব নির্বাসন দেন। দেশ স্বাধীন হবার পর পুনরায় তিনি দেশে ফিরে আসলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের প্রধান খতীব হিসেবে নিযুক্ত করেন।
যশোর রেল স্টেশন মাদরাসার মুহতামীম মাওলানা আবুল হাসান যশোরী। তিনি দেওবন্দ থেকে পড়ালেখা সমাপ্ত করেছেন। তিনি এবং তার মাদরাসার ছাত্ররা মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তার মাদরাসার ছাত্ররা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। ১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল তার মাদরাসায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হামলা করে। সে নৃশংসতর হামলায় ২১ জন শহীদ হয়। যাদের মধ্যে একজন ছিলেন আলেম মাওলানা হাবীবুর রহমান, ৫ জন ছাত্র এবং বাকীরা ছিল ওখানে আশ্রয় নেয়া মুক্তিযোদ্ধা। মাদরাসা প্রাঙ্গনে আজো সেসব শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর রয়েছে। ওই হামলায় মাওলানা আবুল হাসান যাশোরী গুলিবিদ্ধ হয়ে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। পরে ১৯৯৩ সালে যশোরী ইন্তেকাল করেন।
ব্রাক্ষণবাড়িয়া অবস্থিত সবচেয়ে বড় কওমি মাদরাসা জামিয়া ইউনিসিয়া। সে মাদ্রাসার মুহতামিম ফখরে বাঙ্গাল আল্লামা তাজুল ইসলাম রহ. তিনিও তদীয় অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছিলেন। ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলায় অনেক বড় বড় আলেম উনার ফতোয়া শুনে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
শুধু তাই নয়, অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে ফখরে বাঙ্গাল তাজুল ইসলাম নিজের বাসায় আশ্রয় দিয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু উনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে একটি চিঠিও দিয়েছিলেন। (তথ্যসুত্রঃ ফখরে বাঙাল আল্লামা তাজুল ইসলাম রহমাতুল্লাহ আলাইহি ও উনার সাথীবর্গ, লেখকঃ হাফিয মুহাম্মদ নুরুজ্জামান, ইসলামিক) মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ ২৪৩ দিন আত্মগোপনে থেকে যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। তার পরামর্শে অসংখ্য মানুষ যুদ্ধে অংশ নেয়। পাকিস্তানী হানাদাররা তার বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়। নরসিংদী জেলার শীর্ষ আলেম, দারুল উলুম দত্তপাড়া মাদরাসার শাইখুল হাদিস আল্লামা বশিরুদ্দিন, হাতিয়ার মাওলানা মোস্তাফিজ, চট্টগ্রামের মাওলানা ছৈয়দ, ছাগল নাইয়ার মাওলানা মাকসুদ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
২৬ মার্চ পাক হানাদারদের গুলিতে প্রাণ হারান ঢাকার হাতিরপুল মসজিদের ইমাম। বৃহত্তর ময়মনসিংহের ইমাম মাওলানা ইরতাজ আলি কাসিমপুরী পরাধীন দেশে জুমআর নামাজে ইমামতি করতে অস্বীকৃতি জানান। পাকিস্তানী হানাদাররা তাকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। এই ইরতাজ আলি কাসিমপুরীর কথা হুমায়ূন আহমেদ তার বিখ্যাত উপন্যাস জোছনা ও জননীর গল্পে উল্লেখ করেছেন। ইতিহাসের এমন বহু উদ্বৃতি দেওয়া যাবে একেএকে। সেসব তথ্য উপাত্ত নিয়ে মাওলানা শাকের হোসাইন শিবলী রচনা করেছেন এক অনবদ্য গ্রন্থ, আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে।
১৯৭১ এর দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামে আলেমসমাজ কেবল ফতোয়া ও সমর্থন দিয়েই ক্ষান্ত থাকেননি পাশাপাশি লিপ্ত হয়েছেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মোকাবেলায়। হাজার হাজার আলেম নিজ নিজ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সংগঠিত করেছেন। বয়ান বিবৃতি দিয়ে উৎসা উদ্দীপনা দিয়েছেন যেমন, তেমনি সাহায্য-সহযোগিতাও করেছেন অকুণ্ঠমনে। এটিই ইতিহাসের ধ্রুব সত্য। এ সত্য চাপা দিয়ে রাখা যাবে না কিছুতেই। ইতিহাস তার মহিমায় জ্বলে উঠবে প্রতিবার। দিবসের সূর্যের মতোই এ কথা দেদীপ্য যে, আলেমসমাজ দেশকে ভালোবাসেন। স্বাধীনতার জন্য তারা রক্ত দিয়েছেন। স্বাধীনতা রক্ষার জন্যও আলেমসমাজ রক্ত দিবে। কারণ তারা ভালোবাসে দেশকে। দেশের মাটি ও মানুষকে।
লেখক : তরুণ আলেম ও শিক্ষক