আলী আবদুল মুনতাকিম ।।
‘জোরে চিল্লাইয়া কন, ঠিক না বেঠিক’। ‘এ যুবক আওয়াজ দে’। ‘আরও জোরে-হু হু, বইসা যান-হুহু’।
এক শ্রেণির আলেম বক্তার মাহফিলের মঞ্চে উক্ত বাক্যগুলো ছুড়ে দেয়া মুদ্রাদোষে পরিণত হয়েছে। সিনেমার গান নকল করে গাওয়া, সিগারেট পানের নানাহ স্টাইল দেখানো, নোয়াখালী-সিলেট-চিটাগাং এর ভাষা নকল করে শ্রোতাদর্শকদের হাসানো, ওয়াজের মঞ্চে লাফ দেয়া, শ্রোতারা মঞ্চে এসে হুজুরের গলা চেপে ধরা, মাইক ছুড়ে ফেলা, মঞ্চের পর্দা ছিড়ে ফেলা, লাফ দিয়ে শামিয়ানার চূড়ায় উঠে পড়া, এগুলো বক্তারা আবার উপভোগ করে এই ভেবে যে তার কথায় শ্রোতারা ফানাফিল্লাহ হয়ে গেছেন, জোরে চিৎকার দেয়া বা ধমক দিয়ে নিজের বড়ত্ব জাহির করা ইত্যাদি এখন ওয়াজের উপাদান। বক্তাগণ ছাফাই গেয়ে বলেন মাহফিল জমানোর স্বার্থে এগুলো করতে হয়। শুধু বলব- ছিঃ ছিঃ…।
টিক টক আর ইউটিউব ওয়ালারা মাহফিলের এসব বাক্য নিয়ে যাচ্ছে তাই বিদ্রুপ করে যাচ্ছে। হাজারো ভিউয়ার এগুলো দেখে মাওলানাদের গালি তো দিচ্ছেই বরং অস্বাভাবিকভাবে তরুণ- যুবকদের ওয়াজবিমূখী হতে দেখা যাচ্ছে।
আমি আমার এক নিকটাত্মীয়কে বললাম, ইউটিউব-টিকটকে সময় নষ্ট না করে ইউটিউবে ওয়াজ শোনা ভাল নয় কি। এটিতো ধর্মীয় ক্লাসের মত, ক্লাসটি করলে অনেক কিছু শিখতে পারবেন।
তিনি আমাকে জবাব দিলেন, ইউটিউবে সার্চ দিলে তো আগে চলে আসে মোল্লাদের কণ্ঠে জেমস্ আর মমতাজের গান। নোয়াখালী সিলেটের ভাষার ব্যাংঙ্গ বিদ্রুপ। শুনে দেখেছি। ওয়াজের কথাগুলো বা আমলের কথাগুলো মনে থাকে না। মনে থাকে তাদের ব্যাঙ্গ করা গান আর হরিণীর বাঘিনীর কিসসা-কাহিনি।
আমি ভীত হয়ে গেলাম।বলে কি? হেদায়েত পাওয়ার একটা বড় মাধ্যম তো মাহফিল। কে গোপালগঞ্জ এর জামাই, কোন আলেমের কথায় পুলিশ উঠাবসা করে, ১৫০ মাইল গতিতে কোন হুজুর গাড়ি চালায়, কোন হুজুর নতুন গাড়ি কিনে প্রথম মাকে উঠিয়েছে, কোন হুজুর ১৫০০০ মাহফিলের দাওয়াত পেয়ে মাত্র ৯০ টি সিলেক্ট করেছে। কোন আলেমের ছাত্রের ছাত্র হওয়ার যোগ্যতাও আরেক আলেমের নেই। কোন গোত্রকে কাফের না বললে তারাও মুরতাদ কাফের হয়ে যাবে ইত্যাদি এখন ওয়াজের প্রধান খাদ্য। এগুলো শুনে শ্রোতাদের জোরে সুবহানাল্লাহ বলতে বাধ্য করা হয়। ১৫০ মাইল গতিতে গাড়ি চালান শুনিয়ে শ্রোতাদের বলেন, সুবহানাল্লাহ বলুন। কেন বলতে হবে?
এক ইউটিউবার আমেরিকায় বসে তার ভাষায় এক অহংকারী-দাম্ভিক আলেম জিহাদিকে রোষ্ট করে প্রোগ্রাম পোস্ট করেছেন। রোস্টিং পোস্ট এর জবাবে তিনি ওই ইউটিউবারকে অন্য মাহফিলের মঞ্চে এমন ধমক দিয়েছেন যা এখন প্রচন্ড ভাইরাল। জিহাদি সাহেব ওই ইউটিউবারকে ক্যানসারে বা এক্সিডেন্টে মৃত্যুর বদদোয়া করেছেন। তাহলেতো না বুঝে শহীদি মৃত্যুর দোয়া করা হল। রোগে বা দূর্ঘটনার মৃত্যু কি শহীদি নয়?
জিহাদি সাহেব এক মাহফিলে বললেন স্বামী-স্ত্রী মোটর সাইকেলে চড়ে ধাক্কা খেলে ১টা করে হজ্জের সওয়াব। এ কথা তিনি কোথায় পেলেন? এই গাঁজাখোরী ওয়াজের কোন প্রতিবাদ নাই। যা মুখে আসে তাই বলে যান। মাথায় টুপি না দিয়ে সারা জীবন বাথরুমে যান নাই, এটা বলার উদ্দেশ্য কি? টুপি মাথায় দিয়ে কি গোসলও করেন?
একজন তথাকথিত ডক্টর কোরানের আয়াত বানিয়ে বলতেন। তুমূল প্রতিবাদের মূখে ক্ষমা চেয়েছেন। আরেকজন পীর ডক্টর বক্তা হেলিকপ্টার বসিয়ে রেখে ওয়াজ করেন কেন, তার গল্প বলেন, আরেকজন হেলিকপ্টার থেকে মাহফিলের মাঠ উপর থেকে দেখে (পুলিশ না দেখে) কেন ফিরে আসতে হয়, এ গল্প শোনান মাহফিলের মঞ্চে বসে।
তাহলে তার ইজ্জত ও নিরাপত্তার মালিক কি পুলিশ? (হতে পারে হেলিকপ্টার মালিকদের/ক্যাপটিনের কারসাজি)৷ টাকার বিনিময়ে মাহফিল, এখানে গল্প কেন? সব কথায়ই সুন্দর যুক্তি আছে। অস্বীকার করি না।
টিকটক ওয়ালাদের কিছু কটু কথা বলব ভাবছিলাম, কিন্তু কোন যুক্তিতে। আমি যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না। তবুও টিকটক থামাতেই হবে। কারণ তাদের বাড়াবাড়ি সীমাহীন।
তাবলীগের ওজাহাতি আর এতায়াতি বিতর্কও এখন মাহফিলের এজেন্ডা হয়ে গেছে। মাওলানা সাদ ও তার অনুসারীরা হয়ে গেছেন সাদিয়ানী। আমি তাদের সমর্থন করছি না। কিন্তু থামা উচিত। এভাবেই কিন্তু শিয়া সূন্নীর জন্ম হয় যা আজ বিশাল দু’টি ধারা, আন্তর্জাতিক ভাবেই।
আজ মানুষ ভুলে যেতে চাইলেও ওয়াজ এর কারণে সাদিয়ানী ইস্যু জিইয়ে থাকবে। হুজুরগণ যেন দূরদর্শী হন আমরা প্রাণ ভরে দোয়া করতে পারি।
আরেকটি কথা বলতেই হয়। ইউটিউবে মাওলানা ওলিপুরি ও মাওলানা সাঈদ সাহেবের একটি বক্তৃতা অনুষ্ঠান দেখলাম। ওলিপুরী এক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে কিছু অপ্রয়োজনীয় কথা বলেছেন। মন্তব্যকারীদের কথাই তুলে ধরলাম। মাওলানা আব্বাসী জৈনপুরীর বাহাসের আহবান, তার ডাকে সারা দেয়া বা না দেয়া, নানারকম ছলচাতুরীর জন্য বাহাস না হওয়া ইত্যাদি বিষয় বলেছেন যার সাথে দ্বিমত নাই।
কিন্তু একটি অহংকার করতে গিয়ে ওলিপুরী সাহেব নিজের কথায় আটকে গেলেন। তিনি বললেন, আব্বাসীকে আমাদের সাথে বাহাস তো দূরের কথা, আমাদের ছাত্রের ছাত্রর সাথে বাহাস করার যোগ্যতাও তার নাই। তাকে ক্যানভাসার এর সাথে তুলনা করা হয়। এটা নিয়ে আমার বলার নেই, কারণ আব্বাসীকে আমার ওইভাবে জানাই নাই । কিন্তু একজন মন্তব্যকারী চমৎকার কথা বলেছেন।
ক্বাবার ঈমাম হযরত আস সুদাইসীসহ মক্কা মদিনার ঈমামগণ, কাতার, কুয়েত, দুবাই এর ইসলামি স্কলারগণ, মিশরের আল আযহার ভার্সিটির স্কলারগণ, মালয়শিয়ার ও আফ্রিকার ইসলামি স্কলারগণ, বিভিন্ন ধর্মের পন্ডিতগণ ড. জাকির নায়েকের লেকচার তার সামনে বসে শুনেন। তাকে এপ্রিসিয়েট করেন। (ড. জাকির কে আমি ডিফেন্ড করছি না)৷
ক্বাবা ঘরের ঈমাম কি আপনাদের চেয়ে কম জ্ঞান রাখেন? সেই জাকির নায়েককে বলেন তার সাথে কোন আলেম নাই। সুদাইসী কি আলেম নন? আপনারা নাকি তাকে বাহাসের আহবান জানিয়েছে, তিনি সারা দেন নি । এখন তিনি আপনাদের যদি ছাত্রের যোগ্য মনে না করেন এবং সাড়া না দেন তখন তাকে দোষ দেয়া যাবে কি? অতএব সাধু সাবধান!!
বাংলাদেশের গ্রামে-শহরে ও নগরের খোলা মাঠে ময়দানে, ধান কাটা ক্ষেতের শুকনা অসম ফসলী মাটিতে চটের বিছানা পেতে শামিয়ানা টানিয়ে শীত মওসুমের ৪/৫ মাস ব্যাপি চাদর মুড়ি দিয়ে কিশোর, তরুণ যুবকেরা, বৃদ্বরা বসে বসে ঠান্ডা কাপুনিতে ৪/৫ ঘন্টা ধরে আমাদের প্রানপ্রিয় মাওলানাদের ওয়াজ শুনেন, দুগাঁল বেয়ে তাদের পানি ঝরে।কেঁদে বাসায় ফিরেন, বাবা মায়ের সেবা বাড়িয়ে দেন। নামাজ পড়া শুরু করেন। ঈমান মজবুত হয়, আমল বাড়ে। হেদায়েতের পথ ধরেন।
সুতরাং মাঠ-ময়দান, হলরুম-অডিটোরিয়ামের ওয়াজ মাহফিল আমাদের মা মাটি মানুষের রক্তের সাথে মিলে মিশে একাকার। আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ধর্মীয় ক্লাস ময়দান। এটা চলে আসছে, চলছে এবং চলবে ইনশাল্লাহ তায়লা।
এই ক্লাসের শিক্ষক হচ্ছেন আমাদের শ্রদ্ধাশীল ওয়ায়েজগণ। আজ তাদের যেন ব্ল্যাকলিস্ট করা হচ্ছে, তাদের বদনাম রটানো হচ্ছে, তাদেরকে টিকটক এর মাধ্যমে বেইজ্জতি করা হচ্ছে। অল্প ক’জন মাওলানার কারণে গোটা আলেম সমাজকে কলঙ্কিত হতে হবে কেন? বড় মাপের আলেমগণ এটা খেয়াল এবং পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন আশা করি।
আওয়ার ইসলামের সাহসী সম্পাদক, মুফতি হুমায়ুন আইয়ুবের প্রেসক্লাবের একটি অনুষ্ঠানের কথা বলি। অনুষ্ঠানে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, এমপি ওবায়দুল মোকতাদির, মাওলানা আশরাফ আলী, মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ, মাওলানা ওবায়দুর রহমান খান নদভীসহ অনেক দেশ বিখ্যাত আলেম ছিলেন, আমি অধম লেখক ও অতিথি ছিলাম।
চমৎকার উপস্থাপনায় হুমায়ুন আইয়ুব বাংলাদেশের ওয়াজকে বলে ফেললেন, এটি আজ ওয়াজ শিল্প। এমপি সাহেব বলেছিলেন, ‘ওয়াজ শিল্প’ নামটি নতুন শুনলাম। এই শিল্পের কারিগর আমাদের শ্রদ্ধাশীল ওয়ায়েজিনগণ। তারা দাওয়াতের যে কাফেলা বা ট্রেনে চলছেন তার ইঞ্জিনের ফুয়েলে কেউ কি ভেজাল মেশাচ্ছেন, হুজুরগণ কি নিজেদের হারিয়ে ফেলছেন, তারা কি অপ্রয়োজনীয় গ্রুপিং-দ্বন্দ্ব-ফেরকায় জড়িয়ে পড়ছেন? সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মনের কষ্ট বুঝার চেষ্টা কি করছেন না? আমি জানি না।
ওয়াজে কি বলা হবে না হবে তার একটা মাপকাঠি তৈরি করুন। কিস্সাবাজ- গলাবাজদের ডেকে বসুন। ওয়াজের মাঠে গালাগালি বন্ধ করুন। বাহাসের আহবান, চ্যালেঞ্জ ছোড়াছোড়ি বন্ধ করুন। মুরিদদের মঞ্চে উঠে লাফালাফি, মাইক ফেলা, পর্দা ছিড়ে ফেলার নাটক বন্ধ করুন। অমুসলিম আর নাস্তিক দের হাসাবেন না।
একটি বিনীত অনুরোধ, রিকশাওয়ালা, মুটে-মজুর, কৃষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের চাঁদার টাকায় আয়োজিত মাহফিলগুলোতে দরকষাকষি করে ৩০,০০০/৪০,০০০ টাকা নেওয়া কি ঠিক? সব ক্ষেত্রে না হলেও বেশিরভাগ মাহফিলে এমনটি হয়। বলা হয় মাদরাসা আছে, তার খরচ। এ ব্যাপারে ফতোয়া আশা করছি।
ওয়াজ করে হাত খরচ আর ভাড়ার টাকা নিলেই তো হিসাব করে দেখা যায় মাসে একজন ওয়ায়েজ দেড় লক্ষ টাকা হাতে পান। ২/৩ ঘন্টা সময় দিয়ে। সরকারের একজন সর্বোচ্চ কর্মকর্তা সচিব দৈনিক ৮/১০ ঘন্টা ডিউটি করেও এত টাকা পান না। ১ম গ্রেডের একজন ওয়ায়েজ মাসে ১০ থেকে ২৫ লাখ টাকা আয় করেন ।
একথা ভাবেন না যে, এই টাকা আয় করতে তার পুঁজি কি ছিল। নিশ্চয়ই কোরান হাদিসের বয়ান। এ জন্যই ফতোয়া দরকার। আমি ভুল কিছু বলে থাকলে আল্লাহর ওয়াস্তে মাফ করে দেবেন। যা বললাম আমার মালিকের রেজামন্দির নিয়্যতে। এ গুলো মানুষের মনের কথা।
লেখক : প্রকৌশলী ও কুরআন গবেষক
আরএম/