সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ
অথিতি লেখক
শহীদ বুদ্ধিজিবী মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তি চিন্তাশীল দার্শনিক শহীদবুদ্ধিজীবী মাওলানা অলিউর রহমান ছিলেন বঙ্গবন্ধুর একান্ত সঙ্গী, আওয়ামী ওলামা পাটির প্রতিষ্টা সভাপতি ও ৭১এর স্বাধীকার আন্দোলনের কিংবদন্তির নায়ক। স্রোত পরিবেশের বিপরীত তিনি বঙ্গবন্ধুর চিন্তা চেতনা সংগ্রামকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যেভাবে কাজ করে গেছেন ইতিহাসে তা বিরল ঘটনা। নিঃস্বার্থ বঙ্গবন্ধু প্রতির নজিরবিহীন ঘটনা। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা আআন্দোলনকে প্রতিষ্ঠিত করার তিনি একজন মহান চিন্তক।
একজন আলেম হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে এমন বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রদান সহ্য হয়নি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের। এই আলেমকে তারা কালো রাতে নির্মমভাবে হত্যা করে। এদেশকে মেধাশূন্য করারও দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকরার যে মিশনে নেমেছিল বর্বর পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় রাজাকার বাহিনী।
সেই মহান বুদ্ধিজীবিদের আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। এপ্র জন্মের কাছে জেনারেল শিক্ষিত ডাক্তার, প্রকৌশলি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক বুদ্ধিজিবীদের তালিকা জানা থাকলেও দুভাগ্যজনক হলেও সত্য আলেম বুদ্ধিজিবীদের নাম একাত্তর পরবর্তি প্রজন্মে কাছে পরিচিত নয়।
মুক্তিযুদ্ধে অসংখ্য আলেম মুহাদ্দিস মুফতি ইমামকে হানাদার বাহিনী হত্যা করেছিল। সেই বুদ্ধিজীবী হত্যার নির্মমতায় শিকার হন মাওলানা শহীদ অলিউর রহমান, শায়খুল হাদিস আল্লামা শহীদ দানেশ রহ.- সহ অনেক আলেম উলামাও রয়েছেন।কিন্তু কোন অপরাধে মুক্তিযুদ্ধের জন্য অসামান্য অবদান রাখার পরেও এসব আলেম বুদ্ধিজীবীরা আজ ইতিহাসের অস্থাচলে।
বঙ্গবন্ধু ৬ দফা ঘোষণা করে অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম চালু করলে এই লেখক গবেষক মাওলানা অলিউর রহমান খোরাসানি জনমত গঠনের জন্য মাঠে ময়দানে বঙ্গবন্ধুর সাথে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। আওয়ামী উলামা পাটির উদ্দ্যোগে স্বাধীকার আন্দোলনের পক্ষে মহাসমাবেশ হয় তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু এতে প্রধান অতিথির ভাষণ দেন। তিনি তখন স্বাধীকার আন্দোলনের পক্ষ জনমত সৃষ্টির লক্ষ্য, বাঙ্গালি মুসলিম সমাজকে জাগিয়ে তুলতে কলম ধরেন। লিখেন একের পর এক আলোচিত গ্রন্হ। তারমধ্য উল্ল্যেখযোগ্য , শরীয়তের দৃষ্টিতে ৬ দফা, ৬ দফা ইসলাম বিরোধী নহে, যুক্তির কষ্টি পাথরে ৬ দফা, জয় বাংলা ইসলাম বিরোধী স্লোগান নহে ইত্যাদি।
এ পুস্তকগুলো দেশব্যপী ব্যাপক সাড়া জাগায়। স্বাধীকার আন্দোলনে মানুষের মাঝে উৎসাহ উদ্দীপনা বাড়িয়ে দেয়। তিনি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখামুখি হন। আওয়ামী ওলামা পার্টির সভাপতি হিসাবে যোগ্যতা ও দক্ষতায পরিচয় দেন । (সূত্র আলেম মুক্তিযুদ্ধার খোঁজে পৃষ্টা ১৩১)
বঙ্গবন্ধুর পক্ষে একাত্তরের পর্ব থেকেই জনমত তৈরি করে ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ইতিহাসে এই মাওলানা অমর হয়ে আছেন। ৬দফার, মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে তার এই ঐতিহাসিক অবদান ও জনমত গঠনকে খুবই খারাপ চোখে দেখেছিল হানাদার বাহিনী ও তার দোসররা । ১৪ ডিসেম্বরে আল বদর আল শামসের হাতে মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করার জন্য দেশের এই স্বনামধন্য মাওলানা অলিউর রহমান শহীদ হয়েছিলেন ।
মাওলানা অলিউর রহমান ছিলেন আওয়ামী ওলামা পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। বঙ্গবন্ধুর পরামর্শ ও একান্ত ইচ্ছায় ১৯৬৬ সালে মাওলানা অলিউর রহমানের হাত ধরেই আওয়ামী ওলামা পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু যখন ১৯৬৬ সালে ৬ দফা ঘোষণা করেন তখন পাকিস্তান সরকারের বেতনভুক্ত বহু আলেম উলামা ৬ দফা কে ইসলাম বিরোধী বলে ঘোষণা দেন়।
সেই সময় মাওলানা অলিউর রহমান ‘ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে ৬দফা’ নামক একটি বই লিখে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার কোন দাবিই যে ইসলামি শরিয়াহর বিরোধী নয় তা প্রমাণ করেন। তার এই ‘ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে ৬ দফা’ বইটি সেই সময় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করে।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে কেন্দ্রীয়ভাবে ১৯৬৬ সালে মাওলানা অলিউর রহমানের ‘ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে ৬ দফা’ বইটি প্রত্যেক আওয়ামী লীগ কর্মীর হাতে পৌঁছে দেয়া হয়। পাকিস্তানি শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মাওলানা অলিউর রহমানই ১৯৬৬ সালেই বঙ্গবন্ধুর সমর্থনে বিপুল আলেম উলামাদের নিয়ে ৬ দফার পক্ষে জনমত গঠনে কাজ করেন। ফলে ২৫মার্চ কালো রাতেই এই আলেম বুদ্ধিজিবীকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকহানাদার বাহিনী।
তিনি মাওলানার পাশাপাশি একজন সুনামখ্যাত হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার ছিলেন। ‘আরোগ্য কুটির’ নামে ঢাকার কেরানিগঞ্জের সিলেটি এই আলেম বুদ্ধিজিবীর একটি চিকিৎসালয় ছিল। ‘মুক্তিযুদ্ধা শহীদ মাওলানা অলিউর রহমান: জীবন ও সাহিত্য’ গ্রন্থে আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী লিখেছেন, অলিউর রহমান ছিলেন ধর্ম মন্ত্রনালয়ের স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রস্তাবকারী। তিনি এব্যাপারে একটি গ্রন্থও লিখেছিলেন, স্বতন্ত্র ধর্ম দপ্তর একটি জাতীয় প্রয়োজন। তিনি ছিলেন স্বপ্ন সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ট সহযোদ্ধা।
শহীদ বুদ্ধিজিবী মাওলানা অলিউর রহমানের মূল্যায়ণে, জাতীয় অধ্যাপকও দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ লিখেছেন, এদেশের অনেক সোনার ছেলে স্বাধীনতা সংগ্রাম প্রাণ হারিয়েছে, শহীদ মাওলানা অলিউর রহমান তারই মধ্যে একজন।
ভাষা আন্দোলনের স্থপতি প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম তার স্মৃতিচারণ করেছেন এভাবে- কোন কোন আলেম যে জীবন ও জগৎ সর্ম্পকে এত আধুনিক জ্ঞান ও চিন্তা চেতনার অধিকারী হতে পারেন এবং এত বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জল বাংলা ভাষায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বক্তৃতা দিতে পারেন তা মাওলানা অলিউর রহমানের বক্তৃতা শোনার আগে আমি কোনোদিন কল্পনাও করতে পারিনি । একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ও বঙ্গবন্ধুর স্বাধীকার আন্দোলনের এক মহান নেতা হিসাবে এই মাওলানার ঐতিহাসিক অবদান তাকে অমর করে রেখেছে দেশ ও জাতির কাছে।
তথ্য সূত্রঃ [১] বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র : ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩৩২- ৩৩৬।.[২] এম আর আখতার মুকুল, আমি বিজয় দেখেছি, বিস্তারিত পৃষ্ঠা নং - ১৬৭।.[৩] দ্যা রেইপ অব বাংলাদেশ, পৃ. ২৪।.[৪] একাত্তরের দিনগুলি, পৃ. ১২৩।
আরএম/