জহির উদ্দিন বাবর ।।
বাংলাদেশে ‘শায়খুল হাদিস’ বললে যে অবয়বটি সবার সামনে ভেসে উঠে তিনি সবার প্রিয় আল্লামা আজিজুল হক। ২০১২ সালে তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। ইন্তেকালের আগে প্রায় তিন দশক পর্যন্ত তিনি এদেশের রাজনীতি ও ধর্মীয় অঙ্গনে সর্বমহলের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার অনন্য প্রতীক ছিলেন।
শায়খুল হাদিসকে চিনেন না এমন সচেতন মানুষ বোধহয় এই দেশে নেই। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, একটি প্রথম সারির সংবাদভিত্তিক টেলিভিশনের এক প্রতিবেদনে দেখানো হলো, নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি) প্রতিষ্ঠাতা নাকি শায়খুল হাদিস! এটা একজন রিপোর্টারের ভুলই নয়, জঘন্য মিথ্যাচার। চলে যাওয়া সর্বজন শ্রদ্ধেয় একজন শীর্ষ আলেম সম্পর্কে এ ধরনের মিথ্যাচার ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।
শায়খুল হাদিস শুধু এদেশের ধর্মীয় অঙ্গনেই নয়, মূলধারার রাজনীতিতে ছিলেন একজন ব্যাপক পরিচত আলেমে দীন। সব দল ও মতের মানুষ তাঁকে সমীহ করতো, শ্রদ্ধার চোখে দেখত। ছয় দশকের বেশি সময় তিনি কুরআনে কারিমের পর সবচেয়ে বিশুদ্ধ কিতাব বুখারি শরিফের দরস দিয়েছেন। দেশের হাজারো শায়খুল হাদিসের মধ্যেও ‘শায়খুল হাদিস’ বললে সবার দৃষ্টি চলে যেতো মহান এই মানুষটির দিকে। দেশে-বিদেশে তাঁর লাখ লাখ ছাত্র ও ভক্ত-অনুরাগী আছে।
ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ লংমার্চের প্রধান নেতা হিসেবে শায়খুল হাদিস আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন। ২০০০ সালের দিকে গঠিত চারদলীয় জোটের শীর্ষ নেতা ছিলেন তিনি। ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন এই জোটকে ক্ষমতায় আনার পেছনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন শায়খুল হাদিস।
আবার পরবর্তী সময়ে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এই শায়খুল হাদিসের সঙ্গেই পাঁচ দফা চুক্তি করেছিল। ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত দেশের দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তাকে সমীহ করতো। প্রখ্যাত এই আলেমকে জঙ্গি নেতা হিসেবে চিহ্নিত করার অপচেষ্টার দুঃসাহস ওই টেলিভিশন চ্যানেলটি কোথায় পেল!
শায়খুল হাদিস তো এদেশের অপরিচিত, অখ্যাত কোনো আলেম নন। তাঁর ব্যাপারে কোনো তথ্য পরিবেশনের আগে অবশ্যই শতভাগ নিশ্চিত হয়ে দেয়া উচিত ছিল। কিন্তু যমুনা টেলিভিশনে যে প্রতিবেদনটি পুনঃপ্রচার হয়েছে সেখানে তা করা হয়নি। এটা শুধু হলুদ সাংবাদিকতাই নয়; জঘন্য অপরাধ। এমন অপরাধীদের কারণেই মিডিয়া দিন দিন গণমানুষের আস্থা হারাচ্ছে। আর সাংবাদিকদের প্রতি সৃষ্টি হচ্ছে ঘৃণা ও বিদ্বেষ।
যে রিপোর্টার প্রতিবেদনটি করেছেন জানাশোনার গণ্ডি খুবই সীমিত।
সর্বমহলে পরিচিত মূলধারার একজন রাজনীতিবিদ আলেমকে জঙ্গি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা বানিয়ে দেয়া ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। এদেশে কথিত উগ্রবাদ কীভাবে বিস্তার লাভ করেছে; জঙ্গি সংগঠন হুজি কীভাবে প্রতিষ্ঠা পায় এসব ব্যাপারে রিপোর্টারের ন্যূনতম ধারণা আছে বলে মনে হয়নি।
কারণ, কথিত এই জঙ্গি সংগঠনের লোকেরা শায়খুল হাদিসের মতো রাজনীতিক আলেমদেরকে কখনোই পছন্দ করতো না। বরং তাদের পথে বড় বাধা বলে মনে করতো। সুতরাং শায়খুল হাদিসের মতো খ্যাতিমান একজন আলেম কথিত জঙ্গিবাদী কোনো কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রশ্নই আসে না।
জঙ্গিবাদের সঙ্গে এদেশের মূলধারার আলেমদের সম্পৃক্ততা কোনোকালেই ছিল না। শুরুর দিকে হুজির কার্যক্রমের প্রতি কোনো কোনো আলেমের সমর্থন থাকলেও পরবর্তী সময়ে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যাওয়ায় তাদের প্রতি সেই সমর্থন আর থাকেনি। বিশেষ করে ইসলামি ধারার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তাদের সঙ্গে হুজিসহ কথিত এই জঙ্গিবাদীদের একটা বড় বিরোধ রয়েছে। প্রচলিত রাজনীতির সঙ্গে জড়িত আলেমদের সম্পর্কে কোনো কোনো উগ্রবাদী গোষ্ঠীর চরম মনোভাব রয়েছে।
এরশাদবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে এদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে শায়খুল হাদিস রহ.-এর উজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। এ কারণে তিনি জেল-জুলুমের শিকার পর্যন্ত হয়েছেন। খেলাফত আন্দোলন থেকে শুরু করে খেলাফত মজলিস ও ইসলামী ঐক্যজোটের মাধ্যমে তিনি আজীবন মূলধারার রাজনীতি করে গেছেন। অথচ সেই নেতাকে আজ একটি জঙ্গিবাদী দলের প্রতিষ্ঠাতা বানিয়ে দেয়া হচ্ছে।
শায়খুল হাদিস জঙ্গিবাদী নেতা হলে এদেশের আর কোন আলেম বাকি থাকলেন এই তকমা থেকে! মূলধারার আলেমদেরকে এভাবে জোর করে কথিত জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িয়ে দেয়ার পরিণতি কারও জন্যই শুভকর নয়।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম
আরএম/