মুফতি এনায়েতুল্লাহ ।।
ঘটনাটা এ রকম। রাস্তার পাশে দুই কিশোরের খুনসুঁটি ঝগড়ার রূপ নিয়েছে। আর দূর থেকে ভেসে আসছে জনপ্রিয় একটি গজলের সুর ‘জামানা খারাব হ্যায়।’ দুই কিশোরকে ধমক দিয়ে তাদের দাদি-নানি কেউ একজন বলছেন, ‘জামানা খারাপ না, তোরা খারাপ; তাই জামানারে খারাপ বানাইছ।’ এটা দেখে উঠতি সমাজচিন্তক ও বিশিষ্ট ফেসবুকার মহব্বত আলী বুড়িকে বললেন, আপনার কথা কি ওই বাচ্চারা বুঝবে? বুড়ি বললেন, সেটা না বুঝলেও সমস্যা নেই, ঝগড়াতো থেমেছে?
আসলে জগৎ সংসারের নানা অনাচার দেখতে দেখতে অতিষ্ঠ ও ক্ষুব্ধ ওই নারী ছোট দুই বাচ্চার খুনসুঁটি থামাতে জীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা মিশ্রিত কথা বলেছেন। যদিও মহব্বত আলীর মতো হুজুগেদের এটা বোঝার সাধ্য নেই। আমাদের সমাজে এমন মহব্বত আলীদের সংখ্যা কিন্তু কম না।
সংক্ষেপে এই হলো- আমাদের রাজনীতি, সমাজনীতি, ঐক্যনীতি, বন্ধুনীতি ও দলনীতির হালচাল। কিছু হলেই ‘আমি এবং আমরা’ ভালো। আর জামানাকে খারাপ বানানোর সর্বনাশা খেলায় মেতে আছে ‘ওরা বা ওনারা’- এই বলে দায় এড়ানো, নিজের মত-পথ ও পছন্দের মানুষ কিংবা নীতির প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে ভিন্নমতের প্রতি উন্মত্তের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে গালাগালি, শোনা কথা প্রচার, বিষোদগার দেখতে দেখতে ওই বুড়ির ন্যায় আমাদের মতো অসহায় নাগরিকদের ‘জামানা খারাব হ্যায়’ খেদোক্তি করা ছাড়া আর বিকল্প কী আছে?
এখানে আমরা সবাই মহব্বত আলী। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ‘কে কার চেয়ে বেশি খারাপ হতে পারি’ এই অধঃপতনের প্রতিযোগিতায় এখন প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন কৌশল, নতুন নতুন মুখ, নতুন যুক্তি, নতুন পথ ও পদ্ধতি।
এভাবেই সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র ও মাঠগুলো ধীরে ধীরে মহব্বত আলীদের হাতছাড়া হচ্ছে একের পর এক। অথচ মহব্বত আলীদের দরকার ছিলো, তাদের শত্রু দমনের কৌশল রপ্ত করা, তাদের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হয়ে সমাজকে আলোকিত করা। এটা না করে তারা একের পর এক শত্রু বানাচ্ছে, প্রতিপক্ষের হাতে নিজেদের ভেদ-রহস্য তুলে দিচ্ছে। আর নিজেদের অজান্তেই তারা পরিণত হচ্ছে, কাগুজে বাঘে।
সন্দেহ নেই, আমাদের নিজেদেরকে নিজেরা নির্মূল করার চেষ্টায় অসামান্য কৃতিত্বের দাবিদার। আমরা ভাঙতে জানি, গড়তে জানি না। আমরা দূরে ঠেলে দিতে পারি, কাছে টানতে পারি না। আমরা প্রশংসা শুনতে অভ্যস্ত, গঠনমূলক সমালোচনাকে শত্রুতা ভাবি, আমরা নিজেকে ছাড়া অন্যকে কিছুই ভাবি না, নিজের মত ও দলকে হক বলি, অন্যেরটা হক হলেও চুপ থাকি। নিজে কোনো ভুল করলেও সেটাকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে সঠিক বলে প্রমাণ করি- এই যে আমাদের অসামান্য স্বার্থপর মার্কা মনোভাব এটা দেখতে দেখতে মহব্বত আলীরা ক্লান্ত। কিন্তু মহব্বত আলীদের এটা বলার সাহস নেই, এই বাস্তবতা আসলে অধম হওয়ার প্রতিযোগিতা!
এই শহরের হাজারও মহব্বত আলীর ভিড়ে আমিও এক মহব্বত আলী। বিপ্লব স্পন্দিত বুকে ভাবতেই শিহরিত হই নিজেকে মহব্বতের কাতারে দেখে। আমার মনে কখনও জাগ্রত হয় না, ‘তুমি অধম, তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?’ সদ্ভাব, সদাচার, সুধারণা এখন নির্বাসনে। চেয়ার, পদ, গদি, নেতৃত্ব, স্বার্থ-সুবিধা ও বাহবা পাওয়ার বাসনায় যেকোনো কিছু করতে আমাদের বুক কাঁপে না। এসব কথা অস্বীকারের কোনো সুযোগ নেই।
আমার মতো মহব্বত আলীরা পরস্পরে বিরোধী দলের ভূমিকায়! নিজেদের ভেতরকার খুনসুঁটিগুলোকে গোপন তথ্য ভেবে ফেসবুকে প্রকাশ করে নিজেকে উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান এ্যাসেঞ্জের সমকক্ষ ভাবছি, নিজেদের মধ্যকার চলা এমন দায়িত্বহীনতার বেপরোয়া প্রতিযোগিতা আর কোনো মহলে হয় কি না- সেটা জানা নেই।
১৭ কোটির মানুষের দেশে নানা গোত্র, দল-উপদলে ভাগ হয়ে আমাদের সংখ্যা কখনও আশাব্যাঞ্জক ছিলো না। নিজেদের ভেতরে চলা নানা তেলেসমাতি, খিস্তিখেউড় আর অভব্য আচরণে আমাদের দল ও শক্তি ক্ষয় হতে হতে বিলীন হওয়ার পথে। এর পরও কী আমাদের হুঁশ হবে না?
নিজেদের আগুনে নিজেরা আর কতকাল পুড়ব? দিন দিন আমাদের দায়িত্বহীন আচরণ বাড়ছে এবং পরিণতিতে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শত্রুতার মাত্রা। এটা সহিংসতা আর প্রাণহানিরও চেয়েও ভয়ংকর। কারণ, পুষে রাখা জেদের কারণে নিজেরা পুড়ে নিংশেষ হওয়ার পাশাপাশি অন্যকে পুড়ছি, ছাই চাপা আগুনে বসবাস করছি। এর কিছুটা প্রকাশ পায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসমূহে।
ধর্মীয় কারণে বোঝাপড়ার আনুষ্ঠানিকতায় ফাটল থাকলে কথা ছিল, কিন্তু এর কোনোটাই ধর্মীয় কারণে নয়; নিছক ব্যক্তি স্বার্থ নয়তো দলান্ধতা। যে পরিমাণ শক্তি আমরা নিজেদের বিনাশ করতে ব্যয় করছি, এর কিছুটা সত্যিকারের বিপক্ষীয়দের জন্য ব্যয় করলে সমাজ অনেক উপকৃত হতো। নিজেদের অধিকারের কথা, ধর্মের কথা নিয়ে রাস্তায় দাঁড়াতে না পারলেও ফেসবুকে অন্যকে তুলোধুনা করতে কসুর করছি না। অনুগত ও দলকানাদের গালাগালি নির্লজ্জ রূপ নিয়েছে। আমাদের মনোজগতে অদ্ভুত কিছু চিন্তা ও অস্বাভাবিক সব ধারণা জায়গা করে নিয়েছে। আমার নেতা স্পেশাল, আমার শায়খ শ্রেষ্ঠ, আমার হজরতের জন্যই সব হয়েছে, এটা শুধু আমার বসের দ্বারা সম্ভব।
আনুগত্য ভালো, অনুগত হওয়া ভালো কর্মীর গুণ। তাই বলে, কৃতিত্ব নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতা, মিথ্যাচার, অহংকারী মানসিকতা কেন? নিজের দল ও সংগঠন বাড়াতে, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে, নিজের প্রতিষ্ঠানের কারণে, প্রসিদ্ধি লাভের বাসনায় কর্ম পদ্ধতিতে সংকট থাকতে পারে পরস্পরে। কিন্তু সেই সংকটের সমাধান ফেসবুক নয়, গালাগালি নয়। এ সংকটের সমাধান করতে হবে আদর্শ, নীতি-নৈতিকতা, আচার-ব্যবহার ও যথাযোগ্য কর্মপন্থা দিয়ে। বিতর্কের বিষয়ের তো অভাব নেই, গবেষণারও নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। এসব না করে, অধঃপতনের প্রতিযোগিতা আর কত দিন?
মহব্বত আলীদের এটা ভাবার কী সময় আছে? মহব্বত আলীদের হৃদয়ে এটা জাগ্রত হয় না- এটাই আফসোস! তার পরও মহব্বত আলীরা লড়ে চলে দিবানিশি। তারা ভাবে না, মানুষ মানুষকে ভালোবাসবে, পরস্পরের কল্যাণে হাত বাড়িয়ে দেবে- এটাইতো স্বাভাবিক। তা না করে, বেপরোয়া আচরণ, সুচিন্তা বিকাশের পথ সংকোচন, অনাকাঙ্ক্ষিত বিরোধিতার মুখে নতুন প্রজন্ম কী শিখবে? ফালতু বিষয়ে আমাদের মরণযুদ্ধের মানসিকতা ও লড়াই দেখে তারা কীভাবে গড়ে উঠছে? মানবিক সমাজ ও সভ্যতা বিনির্মাণ বিষয়ে তারা কী অর্জন করছে?
আমাদের এটা মনে করার কোনো কারণ নেই, আমি আমার ঘরে, গণ্ডিতে, দলে, সংগঠনে যত বড়ই হই না কেন, অন্যের এটা দেখার সময় নেই। অন্যরা দেখবে আমার ভালো কাজ, ভালো নীতি, ভালো আদর্শ ও কল্যাণীয় চিন্তা। এই বাইরে সব ফাঁকা। সুতরাং পরস্পরে অস্থিরতা নয়, দরকার সদ্ভাব; আশাবাদী আচরণ।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম
আরএম/