তানভীর সিরাজ
প্রতিটি কাজের একটি গঠনতন্ত্র থাকা বাঞ্ছনীয়। এটি দ্বীনি আর দুনিয়াবি যেই নিষয় হোক না কেন। পরিকল্পনা না করে কোনো কাজ সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন হওয়া দুরূহ ব্যাপার।
এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিভিন্নধরণের হিসাবনিকাশ খুব জরুরী। সেটি কিতাবখানা হোক, কিংবা হিফজখানা। আজ ইনশাআল্লাহ হিফজখানা নিয়ে কিছু লিখার চেষ্টা করছি।
১, দৈনিক: হিফজখানায় প্রতিদিন যে কাজগুলো করতে হবে; ক. হাজিরা: প্রতিজন ছাত্রছাত্রীর হাজিরা ডাকা। কে এসেছে আর কে আসেনি এবং অনাবাসিক হলে কেনইবা আসেনি তার খবরাখবর নেওয়া। প্রয়োজনে মাসিক একটি ব্যালেন্স-বিল মাদরাসা থেকে এর জন্য ধার্য্য করা।
খ. ছবক পরিকল্পনা: দাওর, হিফজ আর নাজেরা বিভাগের শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন ৩ বার করে ছবক নেওয়া। মুখস্থ না হলে এক একটি পৃষ্টাকে মন দিয়ে ১০০বার পড়তে বলা।
গ. মশকের ব্যবস্থা করা: এক্ষেত্রে সুন্দর পদ্ধতি নির্বাচন করা। এই জন্য প্রতিজন উস্তাদ এক একজন অভিজ্ঞ হাফিজ কারী রাখার চেষ্টা করা।
২, সাপ্তাহিক: হিফজখানায় প্রতি সপ্তাহে যেসব কাজ করতে হবে
ক. হিসাব: দাওর থেকে নাজিরা বিভাগের প্রত্যেকটি ছাত্রের সারা সপ্তাহের হিসাব করা, কে কতটুকু পড়ার কথা কতটুকু পড়েছে।
এ জন্য সপ্তাহের শুরুতে প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে সারা সপ্তাহের পরিমাণ শুনিয়ে দেওয়া, যাতে সে সতর্কতার সাথে নিজেকে প্রস্তুত রাখে। তবে এক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীর মেধার প্রতি উস্তাদকে খেয়াল রাখতে হবে, যাতে তার উপর চাপসৃষ্টি না হয়। প্রতি সপ্তাহে পরিমাণটি বাড়ানোর চেষ্টা করা।
খ. পরিচর্যা: নক, চুল আর দাঁত এবং বিছানা প্রতি সপ্তাহে তদারকি করা। পরিচ্ছন্নতার প্রতি শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করা। সেইসাথে উস্তাদ নিজেকেও পরিপাটি রাখবেন।
গ. পাক্ষিক ছুটি: দুই সপ্তাহ অন্তর অন্তর বৃহঃবার বিকেলবেলা ছুটি দিবে আর জুমাবার বিকেলবেলা চলে আসবে। অভিভাবককে সন্তানের ধোঁকায় না পড়ার জন্য সচেতন করতে হবে, রাখতে হবে, পারলে লাভক্ষতি বুঝিয়ে বলা।
৩, মাসিক: হিফজখানায় প্রতিমাসে যে কাজগুলো করতে হবে।
ক. শফিনা: দাওর থেকে নাজিরা বিভাগের প্রত্যেকটি ছাত্রের পুরামাসে যাই পড়েছে তার জন্য শফিনার ব্যবস্থা করা। প্রয়োজনে ১/২দিন সময় দেয়া যেতে পারে।
খ. পারিবারিক বিসাহ: ছাত্রছাত্রী সারা মাসে কতটুকু পড়েছে তার একটি হিসাব নোটিশ আকাঁরে তার পরিবারে দেওয়া ছুটির সাথে। তাহলে অবশ্যই অভিভাবক সন্তানের ধোঁকায় পড়বে না, আগেরচেয়ে সচেতন হবে মাতাপিতা ও অভিভাবক।
গ. পরিচালক: যিনি পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন তিনি প্রতিমাসে উক্তবিষয়ে অডিট করবেন তাহলে সকলে খেয়ানত থেকে বাঁচা সহজ হবে, ইনশাআল্লাহ।
ঘ. বেতন: নির্ধারিত সময়ের আগে বেতনবাবত কল করা হবে। সুন্দর ভাষায় বার্তা পৌঁছানো হবে। কারো অপারগতার সত্যতা যাচাই করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। পরিবারের টাকা যদি হারাম উপার্জনের হয় তাহলে নরমগরমে সাবধান করা।
৪, বাৎসরিক: হিফজখানায় প্রতি বছর যেসব কাজ করতে হবে;
ক. দাওরের হিসাব: কতজন ছাত্রছাত্রী এই বছর হাফিন হল হিসাব করা এবং বিদায়ী অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা। সেইসাথে সামনের পথের সুন্দর সন্ধান দেওয়া, যাতে ভবিষ্যৎ অন্তকার না হয়।
খ. হিফজের হিসাব: কোন ছাত্রছাত্রী এই বছরে কতটুকু পড়েছে, তার হিসাবনিকাশ করা এবং এ হিসাব তার অভিভাবককে দেওয়া হবে, যাতে সন্তানের প্রতি তাদের আরও বেশি গুরুত্ব বাড়ে। ১২ মাসের একটি পূর্ণ হিসাব অভিভাবককের হাতে তুলে দেওয়া।
গ. মাদরাসার হিসাব: সি. ফার্ম করা ব্যক্তি দিয়ে মাদরাসা অডিট করা।
ঘ. পরিকল্পনা: সামনের বছর কত ছাত্রছাত্রী নিতে পারবো আর কতজন উস্তাদ নিতে হবে তার চিন্তা করা, কারণ দাওর, হাফিজ আর নাজিরার ১০জন ছাত্রছাত্রীর জন্য ১জন উস্তাদ আবশ্যক।
ঙ, শিক্ষকের বেতন: এসবকষ্ট কর যেসব শিক্ষক করবেন তাঁদের বেতন বা হাদিয়া হবে কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা। এবং সেটি প্রতি মাসের ৫ তারিখের মধ্যে তার হাতে পৌঁছাতে হবে।
৫, শিক্ষক নির্বাচন: শিক্ষক নির্বাচনে আমরা যা চাইবো,
ক. হিফজ: কুরআন শরিফ ইয়াদ আছে কিনা।
খ. অভিজ্ঞতা: হাফিজ সাহেব অভিজ্ঞ কিনা দেখা। কম পক্ষে ৩ বছরের যাচাই করা।
গ. দ্বীনদার: আমল আখলাকে বাস্তব ব্যক্তিকে প্রাধান্য দেওয়া। আখলাকি শেকায়ত থাকলে যতই যোগ্য হন তিনি তাকে না রাখা।
ঘ. যাচাই করা: আগের প্রতিষ্ঠান থেকে কেন চলে এলেন তিনি? সেটি ভালমতো যাচাই করা।
৭, পরিচালক: পরিচালক নির্বাচন,
ক. সময়ের প্রতি হেফাজত: তিনি সর্বদা সময়ের প্রতি লক্ষ রাখবেন যথাসময়ে সবকিছু হচ্ছে কিনা।
খ. মাদরাসায় অবস্থান: মাদরাসার কাজে বাইরে যাবেন, অন্যথায় সবসময় মাদরাসায় অবস্থান করবেন আর তারাক্কির ফিকির করবেন দিবারাত্রি।
গ. খেয়ানত: যেখানে ৫টাকা খরচ করলে হয় সেখানে ১০ টাকা খরচ করবেন না।
যেখানে ছাত্রের ক্ষতি হয় সেখানে যাবেন না। যেখানে পড়ার ক্ষতি হয় সেখানেও যাবেন না। আবার সাময়িক লাভের দিকে তাকিয়ে বড় ক্ষতিতে না যাওয়া।
ঘ. ছুটি: বাকি শিক্ষক আর শিক্ষার্থী যখন বাসায় যান তিনিও তখন বাসায় যাবেন। সময়সুযোগ থাকলেও সবসময় বাসাবাড়িতে না যাওয়ার ফিকির রাখা।
ঙ. আল্লাহর ওপর ভরসা: প্রাথমিকভাবে মাদরাসার সববিষয়ে আল্লাহর ওপর ভরসা করা। দ্বিতীয়ত পরামর্শ করে করে সমাধান বের করা, কারণ একা সিদ্ধান্তে প্রতারিত হওয়ার এবং ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকা থাকে।
সুতরাং পরিচালকবৃন্দের কাছে আমার আবদার এই যে, আপনারা প্রতিটি শিক্ষার্থীর ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে যে যেখানের যোগ্য তাকে সেখানে ভর্তি করানো এবং উস্তাদ রাখার সময় আল্লাহর কাছে খুব দোআ করবেন, যাতে মেধাবী আর দ্বীনদার শিক্ষার্থী ও শিক্ষক আল্লাহ্ তা'আলা জুড়ে দেন। আল্লাহ্ আমাদের আমল করার তাওফিক দান করেন।
লেখক, সাবেক সিনিয়র শিক্ষক, বায়তুস সালাম মাদরাসা চট্টগ্রাম।
-এটি