শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


দুশ্চিন্তায় ভুগে নিজেকে নি:শেষ করবেন না : শাইখ আরিফী

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

শাইখ আব্দুর রহমান আরিফী
আরব আলেম ও স্কলার

ভার্সিটিতে 'সাদ' নামে আমার একজন ছাত্র ছিলাে। একবার পূর্ণ এক সপ্তাহ অনুপস্থিত থাকার পর সে উপস্থিত হলে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, 'সাদ! সব ঠিকঠাক আছে তাে? সে বললাে, “তেমন কিছু না, একটু ব্যস্ত ছিলাম।” অথচ তার চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট প্রতিভাত হচ্ছিলাে।

আমি বললাম, 'কী হয়েছে? সে বললাে, 'আমার ছেলে অসুস্থ। ওর লিভারে সমস্যা। কিছুদিন আগ থেকে আবার ব্লাড পয়জনিং (রক্তদূষণ) শুরু হয়েছে। এই গতকাল হঠাৎ চিকিৎসক জানালেন, জীবাণুর সংক্রমণ মস্তিষ্ক পর্যন্ত গেছে।'

আমি বললাম, 'লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইলা বিল্লাহ! ভাই! ধৈর্য ধরাে। দোয়া করতে থাকো, আল্লাহ যেন ওকে সুস্থ করে দেন। আর তাকদীরের চূড়ান্ত ফায়সালা হয়েই থাকলে দোয়া করাে, আল্লাহ যেন কেয়ামতের দিন ওকে তােমার জন্য সুপারিশকারী বানান। সে বললাে, 'সুপারিশকারী! স্যার! আমার ছেলে তাে ছােট নয়।' ‘কত ওর বয়স?' ‘সতেরাে বছর। ‘আল্লাহ ওকে সারিয়ে তুলুন। ওর ভাই-বােনদেরও সুস্থ রাখুন।

ধীরে ধীরে মাথা নুইয়ে সে বললাে, স্যার! ওর কোনাে ভাই-বোন নেই। আমার এই একটিই সন্তান। ওরও এই অবস্থা হয়ে গেলাে! ছাত্রটির অবস্থা সত্যিই বেদনাদায়ক ছিলাে। তবুও আমি নিজেকে শক্ত রেখে বললাম, ‘সাদ! পরিস্থিতি যাই হােক, ভেঙ্গে পড়াে না। আল্লাহ যা অবধারিত রেখেছেন, তাই হবে।' এরপর তাকে কিছুটা সান্ত্বনা দিয়ে চলে এলাম।

হ্যা, আপনিও কখনাে দুশ্চিন্তায় ভেঙ্গে পড়বেন না। কেননা, দুশ্চিন্তা কখনােই সমস্যার পূর্ণ কিংবা আংশিক সমাধান করতে পারে না। মনে পড়ে, কিছু দিন আগে আমি মদীনায় গিয়েছিলাম। সেখানে খালিদের সঙ্গে দেখা হলাে। সে বললাে, 'চলাে, ডা, আবদুল্লাহর সঙ্গে দেখা করে আসি।' আমি বললাম, “কেন? কী হয়েছে?' সে বললাে, 'সমবেদনা প্রকাশের জন্য।'

তার বড় ছেলে পরিবারের সবাইকে নিয়ে পাশের শহরে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। ভার্সিটিতে জরুরী কাজ থাকায় তিনি একাই শুধু মদীনায় রয়ে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে মর্মান্তিক এক সড়ক-দুর্ঘটনায় তারা সকলেই নিহত হন। পরিবারের এগারােজন সদস্য সকলেই!

ডা. আব্দুল্লাহ সৎ ও নিষ্ঠাবান একজন ব্যক্তি। পঞ্চাশটি বছর পেরিয়ে গেছে তার জীবন থেকে। বয়সের ভারে ন্যুজ ও ক্লান্ত হলেও তিনি তাে একজন মানুষ। তারও আবেগঅনুভূতি আছে, বক্ষপিঞ্জরে একটি অন্তর আছে, অশ্রুসজল দুটি চোখ আছে। তার হৃদয়ও আনন্দে আপুত হয়, দুঃখে ব্যথিত হয়।

তিনি এমন একটি হৃদয়বিদারক খবর শুনলেন। তাদের জানাযাও পড়লেন। এরপর নিজ হাতে এক এক করে মাটিতে রাখলেন কলিজার এগারােটি টুকরা। তার বাড়ির ভেতর থমথমে পরিবেশ। তিনি হতবুদ্ধির মত পায়চারি করেন ঘরের ভেতর। বিক্ষিপ্ত পড়ে থাকা খেলনাগুলাের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কত দিন হয়ে গেলাে খালুদ ও সারা এগুলাে নিয়ে খেলায় মেতে ওঠে না। ওরা যে আজ আর নেই।

তিনি বিছানার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। বিছানাটি এলােমেলাে পড়ে আছে। তার স্ত্রী ‘উম্মে সালেহ' তাে আর নেই। ইয়াসিরের সাইকেলের কাছে গিয়ে দাঁড়ান। সেই কবে থেকে নিশ্চল পড়ে আছে। এটি যে চালাতাে, সেও তাে আজ বেঁচে নেই।

লক্ষ্যহীন পদক্ষেপে একসময় বড় মেয়ের কামরায় প্রবেশ করেন। ঘরটা বিরান পড়ে আছে। বিয়ের লাগেজগুলাে গুছিয়ে রাখা। কাপড়গুলাে বিছানায় পড়ে আছে। সেও তাকে ফেলে চলে গেলাে! সে তাে বিয়ের সাজে সজ্জিত হচ্ছিলাে! সুবহানাল্লাহ! ধৈর্য তাে আল্লাহর দান! এত বড় ঝড়-ঝাপটার পরও কী আশ্চর্য ধৈর্য তার! কী দৃঢ় মনােবল তার!

মেহমানরা আসতে নিজেরাই সঙ্গে চা-কফি নিয়ে আসছেন। কারণ বাড়িতে তার কোনাে খাদেম বা সাহায্যকারীও নেই। আশ্চর্যের বিষয় হলাে, সমবেদনামূলক কিছু বলতে গেলে তিনিও আপনাকে সায় দিবেন। তিনিও সমবেদনার শব্দ বলতে শুরু করবেন। অবস্থা দেখে আপনার মনে হবে, তিনি হয়তাে সমবেদনা জানাতে আসা মেহমানদের একজন আর এত বড় ট্রাজেডি ও দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তিটি অন্য কেউ।

তিনি বারবার বলছেন, “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন! যা দিয়েছেন, যা নিয়েছেন সবই তাে আল্লাহর দান! দেয়া ও নেয়া তাে তারই শান! প্রত্যেক বিষয়ের জন্যই তার ইলমে আছে নির্দিষ্ট সময়-নির্ধারিত ‘আজাল।'

বস্তুত এটাই হচ্ছে প্রকৃত বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। যদি তিনি এমন না করতেন, চিন্তায় ও দুশ্চিন্তায় নিজেও শেষ হয়ে যেতেন। আমার পরিচিত এক লােক, যখনই তাকে দেখি, সুখী বলে মনে হয়।

সংক্ষেপে যদি তার অবস্থা বর্ণনা করি, তবে তা এমন: খুবই অল্প বেতনের চাকুরী ... ছােট্ট একটি ভাড়া বাসা ...।  পুরােনাে একটি গাড়ি ... অনেকগুলাে ছেলেমেয়ে ... এরপরও তিনি সব সময় হাসি-খুশী, সকলের প্রিয়। ভালােই চলছে তার জীবন।

তাে দুশ্চিন্তায় ভুগে নিজেকে কুঁড়ে কুঁড়ে শেষ করবেন না। নিজের সমস্যার কথা মানুষের কাছে একের পর এক বলতেই থাকবেন না। তাহলে তারা আপনার প্রতি বিরক্ত হয়ে যাবে।

যেমন কারাে একটি প্রতিবন্ধী ছেলে আছে। যখনই আপনার সঙ্গে দেখা হয়, সে বলতে শুরু করে, আমার ছেলেটা অসুস্থ। ওর জন্য আমার খুব কষ্ট হয়। ছেলেটা আমার বড় অসহায়।...' তখন দেখবেন, আপনিও একসময় প্রচণ্ড বিরক্তি বােধ করছেন। আপনার হয়তাে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে, ‘ভাই! অনেক হয়েছে। আমরা বুঝেছি। এবার একটু নিষ্কৃতি দিন!'

অথবা কারাে স্ত্রী হয়তাে সারাক্ষণ তার সঙ্গে ঘ্যানর ঘ্যানর করে, আমাদের বাড়িটা পুরােনাে হয়ে গেছে! গাড়িটা তাে প্রায় ভেঙ্গেই গেছে! এই সব কাপড়ের কি এখনাে দিন আছে?' বলুন তাে, কী লাভ এ ধরণের অভিযােগ করে? শুধু কষ্ট বৃদ্ধি পাওয়া ছাড়া আর কি কিছু হয়?

কবি কত চমকার বলেছেন, হতভাগা! হা-হুতাশ আর দীর্ঘশ্বাসের মাঝেই জীবনটা শেষ করলে! হাত-পা গুটিয়ে আছাে বসে আর বলছে, 'যুগ আমার প্রতিকূলে!' | কে নেবে দায়িত্ব তােমার, তুমি নিজেই স্বেচ্ছায় অগ্রসর না হলে!

(বিশিষ্ট আরবি সাহিত্যিক ও মুসলিম পন্ডিত শায়েখ ড.মুহাম্মদ বিন আব্দুর রহমান আরিফী রচিত 'enjoy your life' গ্রন্থ থেকে নেওয়া)

আরএম/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ