আমাদের সমাজে এরকম অনেক মানুষ আছেন যারা আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়েও আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে নেই। তারা নামাজ পড়তে দাঁড়িয়েছে ঠিক, কিন্তু তাদের মন অন্য জায়গায়। এ মর্মে পবিত্র কোরআনের আয়াতও নাজিল হয়েছে।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'য়ালা বলেন,
فَوَيْلٌ لِّلْمُصَلِّينَ الَّذِينَ هُمْ عَن صَلَاتِهِمْ سَاهُونَ
তরজমা: দুর্ভোগ সেসব নামাযীর, যারা তাদের নামাজ সম্পর্কে বে-খবর। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাজে মনোনিবেশ করার একটি পদ্ধতি আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, তোমরা এমন ভাবে নামাজ আদায় করো যে তোমরা আল্লাহকে দেখছো। আর যদি তোমরা আল্লাহকে নাও দেখো তাহলে অবশ্যই তিনি তোমাদেরকে দেখছেন।
সুতরাং মনের ভিতর যদি এই অবস্থা তৈরি করা যায় যে, আমি আল্লাহকে দেখছি, অথবা আল্লাহ আমাকে দেখছেন, আমি আল্লাহর সামনে উপস্থিত, তাহলে মনের ভেতর খুশু-খুযু বা একাগ্রতা আসতে বাধ্য।
যখন বান্দা এ কথা মনে করবে, আমি আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে আছি, তখন তার মনের অবস্থা পরিবর্তন হয়ে যাবে। তার ভেতর একাগ্রতা চলে আসবে। অন্য সকল বিষয় থেকে তার মন আল্লাহর দিকে রুজু করবে। নামাজে মনোনিবেশ হবে।
আমাদের সমাজে ইদানিং কাল সিসি ক্যামেরা দেখা যাচ্ছে। যা সর্বক্ষণিক মানুষের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে। এজন্য মানুষ যখন সিসি ক্যামেরার সামনে দিয়ে যায়, অথবা তার সামনে সিসি ক্যামেরা ফিট করা থাকে, তখন সে দুনিয়াবী নানা রকম অপকর্ম থেকে বিরত থাকে। সে ভয় পায় যে আমার যাবতীয় কর্মকান্ড তো সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে পর্যবেক্ষিত হচ্ছে। সুতরাং এই অন্যায় আমার দ্বারা করা সম্ভব নয়।
ঠিক এমনিভাবে যখন কোন বান্দা নামাযে দাঁড়াবে, এবং মনে মনে এ কথা স্মরণ করবে আল্লাহ আমাকে দেখতেছেন, আল্লাহর দৃষ্টিশক্তি তো সিসি ক্যামেরার চেয়ে লক্ষ-কোটি গুণ বেশি। তিনিও তো আমার সকল কার্য রেকর্ডিং করছেন- এরকম অবস্থা মনের ভেতর তৈরি করতে পারলে নামাজের ভিতরে খুশু-খুযু তৈরি হবে।
আল্লাহ পাক তাঁর হাবীব কে লক্ষ করে বলেন, আপনি যখন নামাজে দাঁড়ান, আপনি যখন রুকু করেন, আপনি যখন সেজদায় মাথা অবনত করেন, কিভাবে নামাজে দাঁড়িয়েছেন, কিভাবে রুকু করছেন এবং কিভাবে সেজদা আদায় করছেন এসকল আমি লক্ষ্য করি।
এইজন্যই আল্লাহর হাবিব বলেন, এমন ভাবে নামাজ আদায় করো যেন তোমরা আল্লাহকে দেখছ। আর যদি তোমরা আল্লাহকে নাও দেখো মনে রাখবে আল্লাহ কিন্তু তোমাদেরকে দেখছেন।
কোন এক বুজুর্গ ব্যক্তিকে তার জনৈক সাগরেদ জিজ্ঞেস করলেন, হুজুর আমি যখন নামাজে দাঁড়াই আমার মন এদিক-সেদিক করে। নামাজে একাগ্রতা আসে না। খুশু-খুযুর সাথে নামাজ আদায় করতে পারি না। হুজুর আপনারও কি এরকম হয়?
বুজুর্গ ব্যক্তি তখন উত্তর দিয়ে বললেন, শুধু তো নামাজের মধ্যে নয় নামাজের বাইরেও আমি আল্লাহর নজরের বাইরে যাই না।অর্থাৎ আমি সর্বাবস্থায় মনে করি এবং মোরাকাবা করি যে আল্লাহ আমাকে দেখতেছেন। সুতরাং দুনিয়ার সকল প্রকার অন্যায় পাপাচার থেকে আমাকে বিরত থাকতে হবে।
নামাজ তো অল্প সময়ের জন্য। কিন্তু এর বাহিরেও আমি মনের ভিতরে এ কথা গেঁথে রাখি আল্লাহ আমাকে সর্বদা দেখছেন।
প্রিয় বন্ধুরা, এটা হচ্ছে প্র্যাকটিস বা অনুশীলন। আমি আর আপনি একটু চেষ্টা করলেই এটা হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। আপনি যখন মনে মনে এ কথা ভাববেন- আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে আপনি নামাজ পড়ছেন আল্লাহকে আপনি দেখছেন, অথবা আল্লাহ আপনাকে দেখছে ,তখন অটোমেটিকেলি আপনার নামাজের মাঝে একাগ্রতা চলে আসবে।
আম্মাজান আয়েশা রা. বলেন, আল্লাহর রাসূল যখন নামাজে দাড়াতেন তখন আমার শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করতো। কি সুন্দর করে দিন নামাজে দাঁড়াতেন! কি সুন্দর করে তিনি রুকু করতেন! সেজদা করতেন!। দেখে মনে হতো একজন সাধারন দাস তার মহান মনিবের দরবারে দাঁড়িয়েছে।
আল্লাহর হাবিবও তাঁর সাহাবাদের মাঝে এই বিষয়টি এমনভাবে গেঁথে দিয়েছেন যে, একবার হযরত আব্বাদ ইবনে বিশর রা. নামাজে দাঁড়ালেন। পেছন থেকে তিনবার তাকে বল্লম দ্বারা আঘাত করা হলো। কিন্তু লাগাতার তিনটি আঘাত ও রক্তক্ষরণের পরেও তিনি নামায ছেড়ে দেননি। তিনি অনুভব করছিলেন কেউ একজন আঘাত করছেন।
তার কষ্ট অনুভব হচ্ছিলো। এমনকি যখন বললাম তা বের করা হয় তখনও তিনি বুঝতে ছিলেন। কিন্তু তবুও তিনি নামায ছেড়ে দেননি। নামাজ শেষে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন, বিষয় তুমি নামাজ তাড়াতাড়ি শেষ করলে না কেন?
প্রতি উত্তরে তিনি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ আমি আল্লাহর সাথে বিশেষ অবস্থায় ছিলাম। নামাজের ভেতর আমার এত পরিমান একাগ্রতা চলে এসেছিল ইচ্ছে করছিলো না নামাজ ছেড়ে দেই। আমার শরীরে আঘাতের পর আমার কষ্ট হচ্ছিল কিন্তু আমি নামাজে একাগ্রতা পাওয়ার কারণে এই পরিমাণ সুখ অনুভব করলাম যে সুখের কাছে সেই কষ্টটা একেবারেই তুচ্ছ। এজন্য আমি নামাজ ছেড়ে দেই নি।
কোন একদিন এক রাখাল জঙ্গলে বকরি ছড়াচ্ছিলেন। তখন সে পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর। পথিমধ্যে তিনি নাস্তা করার জন্য বসলেন, এবং ইবনে উমর সেই রাখালকেও ডাকলেন। বললেন আসো, আমার দস্তরখানার মেহমান হও!। রাখাল ছেলেটি উত্তর দিলেন, আনা সায়িম। অর্থাৎ আমি রোজাদার।
বিষয়টি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমরের মনে ধরল। তিনি ভাবলেন রাখাল ছেলে সারাদিন কষ্ট করে। মাঠে-ময়দানে বকরির পাল নিয়ে চষে বেড়ায়, অথচ এত কষ্টের পরেও তিনি রোজা রেখেছেন! হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর তার ইখলাস ও মায়িয়ত পরীক্ষার জন্য তাকে একটি অবৈধ প্রস্তাব দিলেন।
বললেন দেখো এই জঙ্গলের মাঝে তুমি আর আমি ছাড়া কেউ নেই। এখানে তো অনেকগুলো বকরি। তুমি যদি এখান থেকে একটি বকরি বিক্রি করে দাও, তোমার মালিক জানতেও পারবেনা। কেউ জানতে পারবে না শুধু আমি আর তুমি বিষয়টি অবগত থাকবো। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর লক্ষ করলেন এই প্রপোজাল দেয়ার সময় রাখাল ছেলেটির মুখ রাগান্বিত হয়ে গেল।
তিনি বললেন এখানে কেউ নেই তা আমি জানি, এখান থেকে দু একটি বকরি সরিয়ে ফেললে আমার মালিক বুঝতে পারবে না এটাও আমি মানি। হয়তো দুনিয়ার কেউ আমাকে দেখছে না। কিন্তু আমার সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ তো দেখছেন!
তখন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর বললেন তোমাকে আমি পরীক্ষা করছিলাম তোমারে ইখলাস ও তোমার আল্লাহপাকের সঙ্গে মায়িয়তের পরীক্ষা নিচ্ছিলাম। তুমি পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তির্ণ হয়েছ।
প্রিয় বন্ধুগণ, এ সমস্ত হাদীস থেকে আমরা এটাই বুঝতে পারি যখন কোন মানুষ একাগ্রতার সাথে নামাজ আদায় করতে চায় তখন তার মনের ভিতরে এই অবস্থাটা তৈরি করা জরুরি- আমি আল্লাহকে দেখতে পাচ্ছি অথবা আল্লাহ আমাকে দেখতে পাচ্ছেন।
আমার সঙ্গে সর্বদা আল্লাহ আছেন। তিনি আমাকে দেখছেন। তিনি আমার সকল কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করছেন। সুতরাং আমাকে সকল প্রকার অপকর্ম থেকে বেঁচে থাকতে হবে।
কোন মুসল্লী যখন নামাজের ভেতর এই বিষয়টি কল্পনা করবে তখন তার নামাজের ভিতরে একাগ্রতা চলে আসতে বাধ্য। এটাই হচ্ছে নামাজে মনোনিবেশ লাভের কার্যকরী একটি কৌশল। পবিত্র কুরআন এবং হাদীসের আলোকে আমরা এই কার্যকরী কৌশল টি পেয়েছি।
আর যখন কোন বান্দা একাগ্রতার সাথে খুশু-খুযুর সাথে নামাজ আদায় করতে পারবে তখন তার নামাজ তার জন্য ইহকাল ও পরকালে মুক্তির জরিয়া হয়ে যাবে। আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে খুশু-খুজু ও একাগ্রতার সহিত নামাজ পড়ার তৌফিক দান করুন। নামাজে পূর্ণ মনোনিবেশ করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
শ্রুতি লিখন: মাওলানা সুফিয়ান ফারাবী