শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


লেখালেখিতে আসা তরুণরা স্বপ্নটাকে যেন ওঁম দিয়ে রাখে

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

শরীফ মুহাম্মদ ।।

[সম্প্রতি বিশিষ্ট লেখক শরীফ মুহাম্মদের একটি দীর্ঘ আত্মজৈবনিক সাক্ষাৎকার নেন জহির উদ্দিন বাবর। সেই সাক্ষাৎকারটির অংশবিশেষ প্রকাশিত হয়েছে লেখা ও লেখকের কথা নিয়ে প্রকাশিত লেখকপত্রের তৃতীয় সংখ্যায়। আওয়ার ইসলামে পুরো সাক্ষাৎকারটি পর্যায়ক্রমে গদ্য আকারে প্রকাশিত হচ্ছে। আজ প্রকাশিত হলো ত্রয়োদশ পর্ব]

পাঠের অভ্যাস কমে যাওয়াটা একটা বড় সংকট। এতে জ্ঞান কমে যায়, মানুষের ভেতরে মূর্খতা বেড়ে যায় এবং কেউ যদি লেখে বা বলে তার কথায় প্রজ্ঞার ছাপটা তখন কম থাকবে। এখনকার তরুণ বলতে তরুণ এবং লেখক সবার মধ্যে যদি পাঠের অভ্যাস কমে যায় তাহলে ব্যাপারটা আরও দুশ্চিন্তার। আমার মনে হয়, এটা প্রযুক্তির একটা ধাক্কা। যেমন ফেসবুক, হোয়াটসআপ, ম্যাসেঞ্জার এগুলো যে মানুষের কাছ থেকে সময় নিয়ে নিচ্ছে, এই ধাক্কাটায় সম্ভবত আরও এক দেড় বছর যাবে। এই ধাক্কাটা চলে যাওয়ার পর মানুষ আবার গ্রন্থমুখি হবে এটা আমার কাছে মনে হয়।

মানুষ আসলে অস্বাভাবিক কোনো জিনিসের প্রতি মুগ্ধ হয়ে বেশিক্ষণ থাকে না। মনে করুন, কেউ খেলা দেখতে পছন্দ করে। তাকে সারাদিন খেলা দেখতে লাগিয়ে দেন। তাকে যদি দশ দিন পাল্লা দিয়ে খেলা দেখান তাহলে সে বলবে আমি আর খেলা দেখব না। একজন মানুষ যদি বাজে ছবি দেখে, বাজে কাজ করে, সেও ক্লান্ত হয়ে যাবে একসময়। এতে করে সম্ভাবনাময় অনেক ছেলে হারিয়ে যেতে পারে সেটা একটা আতঙ্কের জায়গা, আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। আমার কাছে মনে হয়, আমরা যদি একটু পরিচর্যাও করি, লক্ষ্যও রাখি, এই আসক্তি থেকে তরুণদের বের করার চেষ্টা করি তাহলে যারা হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে তারাও হারাবে না। আর অটোমেটিকলি এক দুই বছর পরে মানুষের মধ্যে আবার গ্রন্থমুখিতা তৈরি হবে ইনশাআল্লাহ।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসামাজিক হয়ে যাওয়ার প্রবণতাটাই এখন বেশি দেখা যাচ্ছে। অসামাজিক বলতে কথিত অর্থের অসামাজিক না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটাকে বলা হয় এজন্য যে ওই প্রোগ্রামটার মাধ্যমে, ওই অ্যাপসটার মাধ্যমে দেশ-বিদেশের বহু মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ হয়, কথাবার্তা বিনিময় হয়। কিন্তু দেখা যায় এতে মানুষের কাছের জগতের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়ে যাচ্ছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ডুবে থাকার কারণে পরিবারের লোকদের পর্যন্ত সময় দেয় না। বন্ধুকে সময় দেয় না। রিকশা দিয়ে যেতে থাকলে তার চোখ নিচের দিকে থাকে। গাড়ি দিয়ে যাওয়ার সময়, ট্রেনে চড়ে এখন আর মানুষ প্রকৃতি দেখে না, এখন সবাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বুঁদ হয়ে থাকে। এজন্য অনেকে এটা নিয়ে শঙ্কিত। তারপরেও যেহেতু এটা বিরাজমান, চলমান এবং কোনো লেখক যদি এটার সঙ্গে যুক্ত থাকেন; আমার ধারণা ৯০ ভাগই এটার সঙ্গে যুক্ত; এক্ষেত্রে প্রথম কথা হলো যত কম সময় দেয়া যায়।

দ্বিতীয় কথা হলো, যত পজেটিভ থাকা যায়। তৃতীয় কথা হলো, যারা আলোচক এবং লেখক তারা এখানে যতক্ষণ থাকেন ধৈর্য নিয়ে যেন থাকেন। কারণ বিশ্রি অনেক জিনিসের চর্চা এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হচ্ছে। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ চলে। এটা আগে মানুষের মধ্যে এতোটা ব্যাপক ছিল না। মানুষ বিবেচনা করত আমি তাকে গালি দেব কি দেব না, সামাজিক যোগযোগ মাধ্যম পথটাকে সহজ করে দিয়েছে। বড় একজন মানুষকে অনেক ছোট একজন মানুষ গালি দিয়ে দিচ্ছে।

আরেকটা ব্যাপার হলো, খারাপ ধারণার প্রকাশ ঘটানো। একজন সম্পর্কে একজন একটা ধারণা করে ফেলেছে যে, উনি দালাল হয়ে গেছে, উনি পথচ্যুত হয়ে গেছে, ধারণা লালন করার পর থেকেই তিনি মনে করছেন আমি আমার ক্রিয়েটিভিটি এখানে প্রয়োগ করে ফেলি। বিপ্লবী একটা স্ট্যাটাস দিয়ে দিই। হয়েছে কী! একজন সম্পর্কে খারাপ ধারণা এবং অপবাদের একটা বাজার গরম হয়ে যায়। যার বিরুদ্ধে লিখলেন তার মন খারাপ হয়ে গেল, এটা হলো ভয়ংকর খারাপ দিক। আর যিনি লিখলেন কিছুদিন বাহবা পেলেন। কিন্তু ইনিও আরেকদিন আক্রান্ত হলেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নেতিবাচক এই জায়গাগুলো থেকে যেমন গিবত, অপবাদ, খারাপ ধারণা, অতি বীরত্বের ভাব, অন্যকে দায়ী করার প্রবণতা, মুরব্বিদের সঙ্গে টিজ করা অথবা মুরব্বিদের অহেতুক অপমান করার প্রবণতা সৃষ্টি হয়, এগুলো থেকে বাঁচার চেষ্টাও করতে হবে। তাহলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দ্বারা উপকার হবে। তা না হলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কেবলই ক্ষতি বয়ে আনবে, ফায়দা কিছু হবে না।

তরুণদের পাঠের ক্ষেত্রে আমি নাম ধরে বইয়ের কথা বলব না। তরুণদের মধ্যে আমি দুইটা ভাগ করি। তরুণদের মধ্যে যারা একদম নবীন, মাদরাসায় পড়াশোনা করছে অথবা মাত্র পড়াশোনা করে বের হয়েছে। সাহিত্য বা লেখালেখির জগতের যে নানামাত্রিক চিন্তাভাবনা থাকে এর সঙ্গে এখনও পরিচিত হয়নি। তাদেরকে বলব শুরুতে নিরাপদ বইপত্র পড়তে। আমাদের আলেমদের মধ্যে যারা শক্তিশালী লেখক তাদের লেখাগুলো আগে পড়ুক তারা। যারা আলেম নন, কিন্তু লেখায় বড় কোনো ঝামেলা নেই, তাদের লেখাও পড়া যায়। উল্টাপাল্টা যুক্তিতর্ক যাদের লেখায় থাকে নবীনদের তাদের লেখা পড়তে মানা করবো।

আর যারা একটু পরিণত হয়েছেন, মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন, সাংবাদিকতা করেন, প্রচুর লেখাপড়া করেছেন, ব্লগে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানামাত্রিক অস্থিরতা সম্পর্কে সচেতন; নিজের ভেতরে একধরনের প্রতিরোধপ্রবণতা তৈরি হয়ে আছে, তাদেরকে বলব দরকার হলে আরেকটু বিস্তৃত পরিসরে পড়তে পারেন। ডান এবং বাম, তাদের লেখায় ম্যাসেজ যেরকমই থাক, যাদের লেখার ধার ও ভার আছে, তার লেখা থেকে শেখার চেষ্টা করুন।

যারা লেখালেখি করতে চায়, যারা লেখালেখিতে লেগে গেছে, সেই তরুণদের বলব, স্বপ্নটাকে যেন সবসময় ওঁম দিয়ে রাখে। সেটা যেন ঠান্ডা না হয়ে যায়। লেখালেখির কাছ থেকে শুরুতেই যেন বড় কিছু আশা না করে। লেখালেখি অনেক কিছু চায়, সেটা দেয়ার জন্য প্রস্তুত যেন থাকে। বলব ধৈর্য লাগবে। প্রচুর পড়তে হবে। আর লেখালেখির সঙ্গে জীবনব্যাপী একটা সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। লেখালেখির অঙ্গনে অনেক রকম নেতিবাচক পরিবেশ আসে, ব্যক্তির মাধ্যমে আসে, রচনার মাধ্যমে আসে, যারা নবীন তাদের কাজ হচ্ছে নেতিবাচক ক্ষেত্র, ব্যক্তি ও পরিবেশ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখে ইতিবাচকতার সঙ্গে থাকা। তাহলেই একটা পথে গিয়ে সে উঠতে পারবে। একদিন একটা পথ সে তৈরিও করতে পারবে।

আরএম/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ