শরীফ মুহাম্মদ ।।
[সম্প্রতি বিশিষ্ট লেখক শরীফ মুহাম্মদের একটি দীর্ঘ আত্মজৈবনিক সাক্ষাৎকার নেন জহির উদ্দিন বাবর। সেই সাক্ষাৎকারটির অংশবিশেষ প্রকাশিত হয়েছে লেখা ও লেখকের কথা নিয়ে প্রকাশিত লেখকপত্রের তৃতীয় সংখ্যায়। আওয়ার ইসলামে পুরো সাক্ষাৎকারটি পর্যায়ক্রমে গদ্য আকারে প্রকাশিত হচ্ছে। আজ প্রকাশিত হলো একাদশ পর্ব]
দরকার ও স্বপ্ন এই জায়গা থেকে বললে মনে হয় আলেম-উলামাদের দ্বারা মিডিয়া হওয়া সম্ভব এবং উচিত। কিন্তু বাস্তবতা আবার আরেক কথা বলে। বাস্তবতা হলো, আলেম-উলামার যারা প্রভাবশালী অংশ, যাদের দ্বারা বড় কোনো প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করা সম্ভব, তারা একটি মিডিয়ার জন্য শুরুতে একটি বড় বিনিয়োগ এবং পরে ভর্তুকি খাত জেনেও ধারাবাহিক বিনিয়োগ করে যাওয়া-এটার জন্য যে পরিমাণ মানসিক প্রস্তুতি থাকা দরকার আমি এখনও সেটা দেখিনি।
এক সময় আমরা প্রভাবশালী মিডিয়া বলতে দৈনিক পত্রিকাকে বুঝতাম। আমি বলব, এখন যদি ভালো তিনটা অনলাইন পোর্টাল করা হয়, একটা টোয়েন্টিফোর আওয়ার, একটা সাপ্তাহিক, একটা ভিউজ টাইপ, একটা ভালো প্রিন্ট ম্যাগাজিন সাপ্তাহিক, তাহলেও একটা প্রভাবশালী মিডিয়াগ্রুপ হয়ে যেতে পারে।
আমরা এখন যেভাবে করছি, আমি আমাদের ইসলাম টাইমস-এর কথা বলছি, এটা প্রশিক্ষণ বা অনুশীলনের পর্যায়ে আছে। অন্তত আলেম-উলামাদের কেউ যদি এমন করেন যে, শুরুতে ১৫/২০ লাখ টাকা নিয়ে নামেন আর মাসে ২/৩ লাখ টাকা গচ্চা দেয়ার মানসিকতা থাকে; দশ বছর লাগলে দশ বছর এই গচ্চা দেব; একটা মাদরাসায় তো এর চেয়ে বড় ফান্ড খরচ করা হয়, এভাবে নামলে সফল, ইফেক্টিভ, পাওয়ারফুল এবং লড়াকু মিডিয়া বাংলাদেশের আলেমদের করা সম্ভব।
তরুণরা অনেকেই তৈরি হয়ে আছে, অনেকে তৈরি হতে চাচ্ছে, যদি মুরব্বিরা ইনভেস্ট করেন তাহলে অনেক কিছুই সম্ভব। স্বপ্ন ও বাস্তবতার মধ্যে মিল ঘটলে এটা হবে। তা না হলে এটা আমার কাছে একটু দূরের ব্যাপারই মনে হয়।
গণমাধ্যমের বর্তমান সামগ্রিক চিত্র নিয়ে বলতে চাইলে দেশের রাজনীতি এবং অন্য অনেক ক্ষেত্রের কথাই চলে আসে। অনেক জায়গাতেই এখন একধরনের ধূসরতা বিরাজ করছে। যে জিনিসটা যে রকম থাকা উচিত সেটা ওইরকম নাই। গণমাধ্যম নিয়ে মানুষের ভেতরে নব্বইয়ের দশকে যে একটা স্বপ্ন ছিল এবং শূন্য দশকেও, নানা কারণে সে স্বপ্নের জায়গায় গণমাধ্যম নেই। বরং এখনকার সাংবাদিকতাকে ভদ্র ভাষায় যদি বলা হয় তাহলে বলা যেতে পারে ‘কেরানি সাংবাদিকতা’ চলছে।
সাংবাদিকরাও এখন বোঝেন এতটুকু বলা যাবে, তিনি এতটুকুই বলেন। যতটুকু লেখা যাবে ততটুকুই লেখেন। এটা রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রেও, এটা ভিউজেরও ক্ষেত্রেও। সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয় যাই বলেন, কেউ এখন ঝুঁকি নেয়ার জায়গায় যেতে পারেন না। এটা মূল সাংবাদিকতার ধারাটিকে বা সাংবাদিকতার যে একটা ধারালো রূপ তাকে খর্ব করেছে। সাংবাদিকতার যে একটা ‘ভয়ংকর সৌন্দর্য’, যে সৌন্দর্যটা সমাজে প্রভাব বিস্তারকারী সেই সৌন্দর্যটা এখন আর নেই। সাংবাদিকতার সৌন্দর্যটা এখন ম্রিয়মান। সাংবাদিকতায় এখন একটা ফ্যাকাসে মুখ বিরাজ করছে।
লেখালেখির জগৎ ও গণমাধ্যম নিয়ে একট সময় অনেক ভাবতাম। এখন মাঝে মাঝে মনে হয় বয়স অনেক হয়ে গেছে। স্বপ্ন দেখার বয়স মনে হয় শেষ হয়ে গেছে। ক্লান্তি ও অসুস্থতার কারণেও এটা মনে হয় অনেক সময়। কিন্তু আবার নিজের মধ্যে আরেকটা জিনিস জেগে উঠে, সেটা হলো, স্বপ্ন কি সব নিজেকে জড়িয়েই দেখতে হবে! এখন আমি আমার ছেলেকে বলি এবং আমার অনুজদের বলি, এটা হয়তো আমি করে যেতে পারবো না, আমি শুরু করি, তোমরা দেখবা। এমন করে অনেক স্বপ্ন এখনও দেখি।
আমার মনের মধ্যে একটা স্বপ্ন, হয়তো আমি পারবো কি না জানি না স্বপ্নের যৌবনটাকে স্পর্শ করতে। কিন্তু স্বপ্নের বীজটাকে স্পর্শ করতে চাই। স্বপ্নের শৈশবটাকে অন্তত স্পর্শ করে যেতে চাই। সেটা হলো, আলেম একঝাঁক দৃঢ় হাতের লেখক যারা নানা বিষয় নিয়ে লেখবে। শুধু ইলমি বিষয় নিয়ে লেখবেন, শুধু গল্প লিখবেন, শুধু ফিচার লিখবেন এমন না। আমাদের এমন একটা সমৃদ্ধ জগৎ গড়ে উঠবে যাদের বয়স এখন ন্যূনতম পঁচিশ কিংবা বাইশ-তেইশ আর উপরে পঞ্চাশ বা এর চেয়েও বেশি।
আগামী পাঁচ বছর-দশ বছরের মধ্যে কথাসাহিত্যে, গল্পে বা গদ্যে, কোনো প্রভাবশালী অঙ্গনে যেন আমাদের অনুপস্থিতি না থাকে। আমার কাছে কেন জানি মনে হয়, আমাদের তরুণরা যদি লেগে থাকে তাহলে পাঁচ বছর পরে হোক, সাত বছর পরে হোক আমি এর চেয়ে বেশি বলবো না, আমার মনে হচ্ছে দশ বছরের আগেই ইনশাআল্লাহ ওই জায়গাটিতে আমাদের তরুণরা চলে যাবে। ওই সময়টা দেখতে ইচ্ছা করে। অন্তত ওই সময়ের লক্ষণটা দেখতে ইচ্ছা করে।
এটা স্বপ্নের একটা অংশ। আর স্বপ্নের আরেকটা অংশ হলো, আমাদের অনেক সাংবাদিক যারা দেশের স্রোতের গতি ঘুরিয়ে দিতে পারে, চিন্তার মোড় পাল্টে দিতে পারে; এমন কিছু মিডিয়া এবং এমন কিছু মিডিয়াবিদ, সংবাদকর্মী দেখতে চাই। এমনভাবে দেখতে চাই যে, তাদের সঙ্গে আমারও সম্পর্ক জড়িয়ে আছে। কোনো না কোনোভাবে আমি তাদের কিছু সেবা করেছি, তাদের খেদমত করেছি। কিংবা আমি না পারি অন্য আরেকজন করেছে।
আমার স্বপ্নের এটা আরেকটা অংশ, একশ হোক, দু’শো হোক, পাঁচশ হোক, সারা বাংলাদেশের সবগুলো উপজেলায় এমন আলেম সাংবাদিকের একটি ঝাঁক দাঁড়িয়ে যাবে, যাদেরকে ওভারটেক করে, যাদেরকে অতিক্রম করে অন্তত জাতীয়, ইসলামি এবং দেশের গুরুত্বপূর্ণ কোনো ইস্যুতে কোনো নিউজ ও মতামতকে ঘোরানো না যায়, স্বপ্নের কথা বলছি। জোর করে যেন অন্যেরা কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে না পারে। এমন কিছু প্রভাবশালী মিডিয়া, ইনস্টিটিউশন এবং সংবাদকর্মী আমি দেখে যেতে চাই। এ জাতীয় প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকতে চাই, সাধ্যমতো সেবা দিতে চাই।
আগের পর্ব পড়তে - আল কাউসারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার দীর্ঘ স্মৃতি
আরএম/