[সম্প্রতি বিশিষ্ট লেখক শরীফ মুহাম্মদের একটি দীর্ঘ আত্মজৈবনিক সাক্ষাৎকার নেন জহির উদ্দিন বাবর। সেই সাক্ষাৎকারটির অংশবিশেষ প্রকাশিত হয়েছে লেখা ও লেখকের কথা নিয়ে প্রকাশিত লেখকপত্রের তৃতীয় সংখ্যায়। আওয়ার ইসলামে পুরো সাক্ষাৎকারটি পর্যায়ক্রমে গদ্য আকারে প্রকাশিত হচ্ছে। আজ প্রকাশিত হলো দ্বিতীয় পর্ব]
আমার পড়াশোনার হাতেখড়িটা অন্য দশজনের মতোই। আমাদের এলাকার যে মসজিদ, যে মসজিদের নাম এখন বায়তুন নূর মসজিদ, সেখানে যে মক্তব এতেই আমার পড়াশোনার হাতেখড়ি। ওই মসজিদের ইমাম সাহেবের থাকার জায়গাটি ছিল আমাদের বাসার কাচারিঘরে। আমাদের মহল্লাটি ছিল আধা গ্রাম, আধা শহর। শহরের পাশে একটি গ্রাম। খোলা মাঠ ছিল। ধানক্ষেত ছিল। সেই মসজিদেই পড়তাম প্রথম দিকে।
মক্তবে পড়ার সময়ই ময়মনসিংহ ছেড়ে কিশোরগঞ্জে চলে যাই। সেটারও একটা গল্প আছে। আমি যখন মক্তবে বিক্ষিপ্তভাবে পড়া শুরু করলাম তখন আব্বা বাসায় একজন শিক্ষক নির্ধারণ করে দিলেন বাংলা পড়ার জন্য। বাংলা, অংক, ইংরেজিটা বাসায় পড়েছি। এভাবে কয়েক বছর যাওয়ার পরে আনুষ্ঠানিক লেখাপড়ার দরকারটা আব্বাও খুব তীব্রভাবে অনুভব করলেন। আমি যেহেতু শিশু, আমার ভেতরে এটা নিয়ে কোনো তলব বা পেরেশানি ছিল না।
জামিয়া ইসলামিয়া মাদরাসায় তখন নূরানি ক্লাস শুরু হয়। এটা তখন উলামায়ে কেরামের সমাজে একটা নতুন পদ্ধতি। প্রথম বছর আমি জামিয়া ইসলামিয়া, তখন দারুল উলূম চরপাড়া বলা হতো, সেখানে পড়ি। সেখানে পড়ার সময় আব্বার ভেতরে একটা জযবা এলো, আমার লেখাপড়ার বিষয়গুলো তাঁর খুব ভালো লাগল।
আমার তেলাওয়াত, শ্লেটে লেখা; এগুলো দেখে আব্বার একটা জযবা উঠল আমাকে এই ধারার মাদরাসার আরও উপরের মাদরাসায় ভর্তি করাবেন। তখন যেহেতু আমাদের ওই উস্তাদ এসেছিলেন কিশোরগঞ্জ থেকে; আর বৃহত্তর ময়মনসিংহে নূরানির কেন্দ্র ছিল বাগে জান্নাত শোলাকিয়া কিশোরগঞ্জ; আব্বা সেখানে যোগাযোগ করলেন। একবার নিজেই গিয়ে ঘুরে এলেন।
এরপর একদিন আব্বার সঙ্গে বাক্স-পেট্রাসহ ট্রেনে চড়ে গেলাম কিশোরগঞ্জে। নূরানি মাদরাসায় দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তি হলাম। সেখানে একবছরেরও কম সময় ছিলাম। সেটা ছিল একাশি-বিরাশি সনের মাঝামাঝি সময়। যতদূর মনে পড়ে, সেখানে কিছু নাজেরা পড়েছি, কিছু উর্দু পড়েছি। সে মাদরাসায় হজরত মাওলানা রহমতুল্লাহ সাহেব রহ. সরাসরি আমাদের উস্তাদ ছিলেন। আর হজরত মাওলানা বেলায়েত হোসাইন সাহেব রহ. তখন মাসে দুই-তিন দিনের জন্য শোলাকিয়া বাগে জান্নাতে আসতেন।
তিনি মসজিদে বসে যে মশকটা করাতেন সেখানে আমরাও শামিল হতাম। এ হিসেবে আমাদের সৌভাগ্য, আমরা তাঁরও ছাত্র। নূরানি মাদরাসায় ময়মনসিংহে যিনি আমাকে পড়িয়েছেন হজরত হাফেজ কারি সোহরাব সাহেব, ইন্তেকাল করেছেন; কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরের দিকে তাঁর বাড়ি; তাঁর অবদান আমার ওপরে অনেক বড়। এখন মাখরাজ বোঝা, উচ্চারণ বোঝা, যতটুকুই বুঝি তাঁর মেহনতটা ছিল অনেক বড়।
বাগে জান্নাতে থাকা অবস্থাতেই বটগাছের ইলেকশন, হজরত হাফেজ্জি হুজুরের নির্বাচনে দাঁড়ানো, মাদরাসার পরিচালনাগত কিছু কিছু বিষয়, মাদরাসার পক্ষ থেকে নির্বাচনে যুক্ত হওয়া-না হওয়া, ওই শিশুকালের স্মৃতি ও বুঝ, এটা নিয়ে হয়তো একটা অস্থিরতা হচ্ছিল।
এরপরে রহমতুল্লাহ সাহেব হুজুর এখানে থাকবেন কি থাকবেন না- এটা নিয়েও একটা অস্থিরতা চলছিল। ওই সময়ে কিছুদিন সবক বন্ধ থাকা, মাদরাসা বন্ধ থাকা আবার খোলা, এরকম বিরতিমূলক ব্যাপার হচ্ছিল। যেটা আব্বার চোখে পড়েছে এবং তাঁর কাছে মনে হয়েছে, আমাকে ময়মনসিংহে নিয়ে আসা দরকার। এজন্য তিনি আমাকে আবার ময়মনসিংহে নিয়ে আসেন।
মনে নাড়া দেয়ার মতো অনেক ঘটনা আছে শৈশবের। খুব মজার স্মৃতি অনেক আছে। আবার চোখ ভিজে যাওয়ার মতো স্মৃতিও আছে। আমার কাছে মজার স্মৃতি মনে হয় চরপাড়ায় অথবা কিশোরগঞ্জ থেকে বাসায় আসার স্মৃতি। বৃহস্পতিবার যখন আমাদেরকে কেউ নিয়ে আসত বাসায়, বাসে বা ট্রেনে করে, তখন প্রতিবার আসার সময় বা ফেরার সময়, জানি না অন্য মানুষের কী অনুভূতি; আমার মনে হতো যে হাজার হাজার মাইল দূর থেকে মায়ের কাছে ফিরছি।
বৃহস্পতিবারটা এতো রঙিন মনে হতো, এতো অন্যরকম মনে হতো, সেটার প্রভাব আমার জীবনে এখনও আছে। এখন যখন বৃহস্পতিবার, শুক্রবার,শনিবার ব্যস্ততা বা বিশ্রামের দিক থেকে আলাদা কিছু না তবুও বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকে আমার কাছে অন্যরকম লাগতে থাকে। এখনও ছাত্রজীবনের সেই প্রভাবটা রয়ে গেছে।
শিশুকালে অনেকের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছি। বড় হয়ে কার মতো হবো- একদম শিশুকালে এই অনুভূতিটা না থাকলেও কিশোরকালে সেটা হতো। আমার এমন অনেক লেখক আলেমের দিকে তাকালে এই অনুভূতিটা মনে আসতো। যেমন মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ.-কে দেখে মনে হতো, একসময় আমার একটা অফিস থাকবে, সেখানে বসে লিখব। লেখার অনুভূতির সঙ্গে আমার কিশোরকালটা কেন জানি খুব চাঙা হয়ে উঠতো। মনে হতো,আমি ব্যবসা-বাণিজ্য করবো, কিন্তু লেখালেখির একটা আলাদা জগৎ থাকবে আমার।
কামরাঙ্গীচর মাদরাসায় মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ সাহেব, তাঁকে দেখে মনে হতো তাঁর মতো হবো। আমার ছোটমামা এখনও হায়াতে আছেন সালিম হাসান, তাকে লিখতে দেখতাম; একসময় মনে হতো, উনার মতো হবো।
অনেক সময় আব্বা খুব পছন্দ করতেন কোনো কোনো উলামায়ে কেরামকে। তাদের দেখলে মনে হতো তাদের মতো হবো। আমার এক চাচা আর্মিতে চাকরি করতেন, শিশুকালে তাঁর কথাবার্তা, আচার-আচরণ, আমাদের সঙ্গে চলাফেরা আমাকে খুব মুগ্ধ করতো; অনেক সময় তাকে দেখলে মনে হতো,জীবনযাপনের কিছু ক্ষেত্রে উনার মতো হবো। এরকম বিভিন্ন সময় বিভিন্নজনের দিকে মনটা ঝুঁকে যেত।
ঢাকায় এসে কামরাঙ্গীচর মাদরাসায়ে নূরিয়ায় ভর্তি হয়েছি ১৯৮২ সনের দিকে। হাফেজ্জি হুজুর রহ. তখন বার্ধক্যের মধ্যেও একটা টগবগে অবস্থায়। প্রতি বৃহস্পতিবার মাদরাসায় চলে আসেন একটি হুইল চেয়ারে বসে। বয়ান করেন, কথা বলেন। আর মাদরাসার সমস্ত আসাতিজায়ে কেরাম ছিলেন তখন খুবই প্রাণবন্ত।
নবীন বা কম বয়সী উস্তাদ ছিলেন বেশি। ওই সময় বেশি বয়স্ক উস্তাদ ছিলেন কয়েকজন। আর তাঁদের বেশির ভাগই হাফেজ্জি হুজুর রহ.-এর ছাত্র ছিলেন। সারা মাদরাসাজুড়ে গমগম করত ছাত্রে। সাদা পোশাক, পাঁচ কল্লি টুপি। ক্লাসের সময়গুলো তো সবাই যার যার রুমেই থাকত, মসজিদে যাওয়ার সময়ের দৃশ্যটা একটা ভিন্নরূপ ধারণ করতো। আসরের পরে বেড়ানো, খেলাধুলা-এই সময়ের দৃশ্যগুলো আরেক রকম হতো।
আর তখন পুরো কামরাঙ্গীচরটাই ছিল নৈস্বর্গিকভাবে সুন্দর একটা জায়গা। নূরিয়াকে মনে হতো দ্বীপের মধ্যে একটা মাদরাসা। ছড়ানো-ছিটানো ক্ষেত, ফসলের জমি; অনেক দূরে দূরে বাঁশের টংয়ের মধ্যে একেকটা বাসা। মনে হতো চার দিকে সবুজের মধ্যে মাদরাসাটি একটি দুর্গ। খুব ভালো লাগতো। খুব আনন্দ লাগতো।
কামরাঙ্গীচরে মেশকাত পর্যন্ত পড়েছি। মাঝখানে একটা বছর ফরিদাবাদেও পড়েছি। শরহে বেকায়ার বছর আগাগোড়া ফরিদাবাদে পড়েছি। আমার এক ভাই ভর্তি করাতে সাহায্য করেছেন। ওই কারণে বেফাক পরীক্ষাও দেয়া হয়েছিল। ফরিদাবাদের স্মৃতিটাও খুব মধুর ছিল। বিকালে মিল ব্যারাকের যে জায়গাটি সেখানে গিয়ে বসতাম। কোনো কোনো দিন চলে যেতাম গেণ্ডারিয়ার ধূপখোলা মাঠে।
আর ফরিদাবাদ মাদরাসাটিও তখন ছিল এমন যে, মাঝে মাঠ ছিল, এতো উন্নত ছিল না। এক পাশে তিনতলা একটা ভবন ছিল আর চার দিকে টিনশেডের ঘরগুলো ছিল। বড় বড় আসাতিজায়ে কেরাম ছিলেন। মুহাদ্দিস সাহেব হুজুর বলা হয়, মাওলানা আবদুল হাফিজ সাহেব রহ.; তাঁর কাছে সরাসরি সবক পড়িনি, তিনি ছাত্রদেরকে নানাভাবে শাসন করতেন, ধমক দিতেন। তাঁর অস্তিত্বের একটা বহুমুখি প্রভাব ছিল সারা মাদরাসাজুড়ে। প্রবীণ একজন উস্তাদ হওয়ার পরেও তাঁর দুয়েকটা শাসনের মধ্যে পড়ার আমার সুযোগ হয়েছে, সৌভাগ্য হয়েছে।
আর মাওলানা ফজলুর রহমান সাহেব রহ. মুহতামিম ছিলেন তখন। খুব বুজুর্গ মানুষ ছিলেন। তাঁর কাছে আমরা কুরআন তরজমা পড়েছি। ফরিদাবাদে মাওলানা যাইনুল আবিদীন ভাইয়েরা এক জামাত উপরে পড়তেন। তখন থেকেই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ। আরও অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে ওঠে তখন। কামরাঙ্গীচরের বাইরে ঢাকা শহরকেন্দ্রিক একটা যোগাযোগ, ঢাকার ভেতরে এসে ঢোকা; মাঝে মাঝে বৃহস্পতিবার বিকেল-রাতে একটু এদিক-ওদিক যাওয়া, আমার জীবনে এটার কিছুটা সূচনা হয় ফরিদাবাদে আসার পরেই।
আরএম/