সম্প্রতি শরীফ মুহাম্মদের একটি দীর্ঘ আত্মজৈবনিক সাক্ষাৎকার নেন জহির উদ্দিন বাবর। সেই সাক্ষাৎকারটির অংশবিশেষ প্রকাশিত হয়েছে লেখা ও লেখকের কথা নিয়ে প্রকাশিত লেখকপত্রের তৃতীয় সংখ্যায়। এখানে পুরো সাক্ষাৎকারটি পর্যায়ক্রমে গদ্য আকারে প্রকাশিত হবে। আজ প্রকাশিত হলো প্রথম পর্ব-
আমার জন্মের ও শিশুবেলার শহর ময়মনসিংহ। কিশোরকাল ও যৌবনকালেরও বড় একটা সময় কেটেছে এই শহরে। নিজের শহর নিয়ে অন্য সব মানুষের মতো আমার নিজেরও অনেক স্মৃতি। তবে স্মৃতির চেয়েও বড় ব্যাপার হলো মায়া। এমনিতেই মফস্বল শহর, আর সেই সত্তরের দশক, আশির দশকের ছড়ানো-ছিটানো একটা শহর; আধা গ্রাম, আধা শহর।
যে এলাকায় আমাদের বাসা ছিল- গলগন্ডা, সেই এলাকা এবং আব্বার দোকান ছিল ছোটবাজার, শহরের মাঝখানে; নানার বাসা ছিল নওমহল; এই তিনটা জায়গাকে কেন্দ্র করে পুরো শহরটাই ঘোরাঘুরি হতো। অদ্ভুত ভালো লাগতো। মায়া লাগতো। শহরে খেলাধুলার স্মৃতি যেমন আছে, ঘোরাঘুরির স্মৃতিও আছে, ছোটকালে আব্বার সঙ্গে বড় বড় মাহফিল-মজলিসে যাওয়ার সেই স্মৃতিগুলোও আছে।
আমার মনে পড়ে, আমি খুব ছোট তখন। চার-পাঁচ বছর বয়স। আমাকেসহ আব্বা-আম্মা চরপাড়া বেড়াতে গেলেন। সেখানে মাওলানা আতহার আলী সাহেবের বাসা। ওই সময়ের কথা খুব একটা মনে আছে, এমন না। তবে এখন ধূসর স্মৃতির ছবি মনে পড়ে। আম্মা একটা বাসায় গিয়ে উঠলেন। আর আব্বা আমাকে নিয়ে গেলেন। জামিয়া ইসলামিয়া মাদরাসার পূর্ব দিকের যে ভবনটা, যে ভবনটায় এখন অফিস-দফতর, পেছনে একটা পুকুর দেখা যাচ্ছিল। বড় বড় জানালা। হজরত মাওলানা আতহার আলী সাহেব রহ. সম্ভবত আমাকে ডেকে নিয়ে কোলে বসিয়েছিলেন। এমন একটা স্মৃতি আমার মনে আছে। তিনি আব্বাকে খুব স্নেহ করতেন। সেই সুবাদেই আমাকে আদর করলেন।
ময়মনসিংহ পুরো শহরজুড়েই আমাদের আত্মীয়-স্বজন। অনেক স্মৃতি। এজন্য এখনও এই শহরের প্রতি একটা আলাদা মায়া, আলাদা টান আমি সবসময় অনুভব করি। প্রকৃতিগতভাবেই ময়মনসিংহের মানুষের মধ্যে শিল্প-সাহিত্য জড়িয়ে আছ -এমনটা শোনা যায়। প্রায় এক শতাব্দী বা তারও আগ থেকে যদি দেখা যায়, এমন একটা নজির কিন্তু পাওয়া যাবেও। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির সঙ্গে ময়মনসিংহের আলাদা একটা সম্পর্ক রয়েছে।
ময়মনসিংহ বলতে বৃহত্তর ময়মনসিংহ; এর মধ্যে কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, শেরপুর, জামালপুর, টাঙ্গাইলও আছে। এই অংশটাতে গত একশ বছরে অনেক লেখক-সাহিত্যিক আমরা পাবো। হয়তো অন্যান্য এলাকায়ও ব্যাপকসংখ্যক সাহিত্যিক আছেন। তবে নানা কারণে এই শব্দটা বা বাক্যটা ময়মনসিংহের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। আমি যখন এটা শুনি তখন মনে হয় এটা আল্লাহ তায়ালার দান। শিল্প-সাহিত্যের যে ক্ষেত্রটা সেটা ইসলামের দিকে ভারী হলে আমাদের নতুন প্রজন্ম এটা থেকে আরও বেশি উপকৃত হতে পারবে। তাহলে আমরা আল্লাহর এই দানটার যথাযথ কৃতজ্ঞতা বা শোকরিয়া আদায় করতে পারবো।
আমার জন্ম ১৯৭১ সালের নভেম্বরে। সে হিসেবে বাংলাদেশের সমান। ছোটকালে তো আর গোটা বাংলাদেশকে দেখার সুযোগ ছিল না। তখন তো কেবল আমাদের এলাকাটিকেই দেখেছি। তারপরও আলাদা করে বলতে গেলে বলব, ওই সময়ের বাংলাদেশ ছিল প্রাণবান, ব্যাপকভাবে নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত একটা বাংলাদেশ। মানুষের মধ্যে আন্তরিকতা, ভালোবাসা ছিল। নানারকম দূরত্ব হয়তো রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থকদের মধ্যে ছিল, কিন্তু মানুষের মধ্যে স্বাভাবিক আচার-আচরণের যে একটা উদারতা, একটা সৌন্দর্য, একটা স্নিগ্ধতা-এই জিনিসগুলো দেখেছি। বাংলাদেশটাকে তখন একটা গ্রামীণ বাংলাদেশ বলা যায়। হয়তো আশপাশে তিক্ত অনেক দিক থাকতে পারে, তবে আমাদের শৈশবকে সেটা স্পর্শ করেনি।
এই ময়মনসিংহ শহরেই আমার বেড়ে ওঠা। আমার আব্বা আলেম নন। ইংরেজি শিক্ষিত মানুষ। উনার বিয়ের সম্ভবত দুই-তিন বছর আগে তিনি দীনদারিতে প্রবেশ করেন। এক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা ছিল ময়মনসিংহ বড় মসজিদের সাবেক ইমাম ও খতিব এবং বৃহত্তর ময়মনসিংহের অন্যতম বুজুর্গ হজরত মাওলানা ফয়জুর রহমান রহ.-এর। তিনি থানভি রহ.-এর খুব খাস সোহবতপ্রাপ্ত শাগরেদ ছিলেন। বড় মসজিদ আর আব্বার অবস্থান, দাদার দোকান-বাসা এটা প্রায় এক মহল্লাতেই ছিল। আব্বা সেই সুযোগটা নিতে পেরেছেন।
এর আগে তিনি কথিত অর্থে খুব আধুনিক একজন যুবক ছিলেন। আব্বার শার্ট-প্যান্ট পরা ছবিও একটা দেখেছি পরবর্তী সময়ে। আর আমার আম্মা ছিলেন এক আলেম পরিবারের। আমার নানা ছিলেন শহরের শীর্ষস্থানীয় একজন আলেম হজরত মাওলানা জালালুদ্দিন কুরাইশি সাহেব রহ.। মাওলানা ফয়জুর রহমান সাহেব, আরিফ রব্বানী সাহেব, মিয়া হোসাইন সাহেব, মাওলানা নুরুদ্দিন সাহেব তাদের সমসাময়িক ছিলেন।
আমার নানা নাসিরাবাদ কলেজের আরবির শিক্ষক ছিলেন। তবে তিনি জামিয়া ইসলামিয়ায় হাদিসের দরস দিতেন। মাহফিলগুলোতে যেতেন। আমাদের পরিবারে দীনদারিটা সেখান থেকেই এসেছে। আমার আব্বার মধ্যে এই স্পৃহাটা তীব্রভাবে ছিল, আমার কোনো ছেলেমেয়েকে স্কুল-কলেজে দেব না; মাদরাসায় পড়াবো। আমাদের সবাইকে মাদরাসাতেই পড়িয়েছেন। যদিও আব্বার সেই স্পৃহাটা আমরা ধারণ করতে পারিনি সেভাবে, আমাদের অযোগ্যতার কারণে। আমার আম্মার ইন্তেকাল হয়েছে ১৯৯২ সালে। আর আব্বা এখনও আমাদের ১৪ ভাই-বোনের ওপর ছায়া হয়ে আছেন।
আরএম/