ছাত্র রাজনীতি। এ দেশ সৃষ্টির পেছনে যাদের রয়েছে অতুলনীয় ভূমিকা। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের আন্দোলন ও বিশেষ করে একাত্তরে বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে এ দেশের ছাত্র সমাজের প্রশংসনীয় ভূমিকা রয়েছে। তবে দুই যুগ ধরে ছাত্র রাজনীতি নিয়ে বোদ্ধামহলে চিন্তার ভাঁজ কপালে। ছাত্র রাজনীতি বন্ধ ও সংশোধনে পক্ষে বিপক্ষে মত অভিমত দিচ্ছেন অনেকে। কিন্তু আদর্শিক কোনো পরিবর্তন সেভাবে লক্ষ্য করা যায়নি। যার ফলে অনেকেই ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি তুলেছেন।
বিশেষ করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যার পর ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবিদারদের কণ্ঠে জোরালো বক্তব্য এসেছে। তারা মনে করছেন ছাত্র রাজনীতি বন্ধ না করা গেলে হত্যা-খুন ধর্ষণ এগুলো চলতেই থাকবে। চলমান এ সকল বিষয় নিয়ে আমরা কথা বলেছি বিশিষ্ট লেখক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, আলোচক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের প্রফেসর ড. আব্দুল লতিফ মাসুমের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারে নিয়েছেন আওয়ার ইসলামের বিশেষ প্রতিবেদক সুফিয়ান ফারাবী।
আওয়ার ইসলাম: একজন শিক্ষক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির বিষয়টি কীভাবে দেখেন?
ড. আব্দুল লতিফ মাসুম: বাংলাদেশ সৃষ্টিতে ছাত্র রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। দেশের রাজনৈতিক শক্তি সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে ছাত্র রাজনীতির ইতিবাচক ভূমিকা ছিল। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অর্জন হয়েছে এই ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে। তা অস্বীকার করা যায় না।
কিন্তু ইদানীং ছাত্র রাজনীতির যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, এটা ছাত্র রাজনীতির জন্য খুবই খুবই খুবই নেতিবাচক দিক। এর কারণ হচ্ছে শাসকদল ছাত্র সমাজকে তাদের ক্ষমতার বাহন এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। এটি শুধুমাত্র ক্ষমতাসীন দলের ক্ষেত্রে নয় বরং অতীতেও সকল সরকার ক্ষমতায় যাওয়া ও ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এই কাজটি করেছে।
ব্যাতিক্রম অবশ্য প্রেসিডেন্ট এরশাদ। ভদ্রলোক ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চাপের মুখে তিনিও একটি ছাত্র সংগঠন তৈরি করেছিলেন। যদিও সেটা ছিল তার মতের বিরুদ্ধে। যেহেতু তিনি একজন সামরিক সরকার ছিলেন তাই তার সকল কার্যক্রমকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়েছিল। ফলে তার এই সদিচ্ছাকেও মানুষ মেনে নিতে পারেনি। তিনিও ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করতে পারেননি।
তৃতীয় বিশ্বের মাত্রায় এবং বাংলাদেশের কনটেস্টে বিষয়টি বিচার করতে হবে। ইতিপূর্বে আমরা বলেছি বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির সোনালী একটা ইতিহাস আছে। ৫২, ৬৯ ও ৯০ সহ নানা সময়ে ছাত্র রাজনীতি দেশের স্বার্থে আন্দোলন করে ১৬ কোটি মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তখন ছাত্রদের মাঝে গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা ছিল, মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা ছিল। যার কারণে নানা সময়ে জাতির নানান কল্যাণে তারা যুক্ত ছিল।
কিন্তু এখন বিষয়টি এমন আছে বলে আমি মনে করি না। ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে ছাত্রদের কীভাবে ক্ষমতার বাহন বা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কিভাবে তারা তাদেরকে সন্ত্রাসী বানিয়ে ফেলে,বিপুল অর্থায়ন করে একে অন্যের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়।
যেকোনো একজন সাধারন মানুষকে আপনি জিজ্ঞাসা করেন শতকরা ৯০ পার্সেন্ট মানুষ ছাত্র রাজনীতির বিপক্ষে মত পোষণ করবে। প্রেসিডেন্ট শাহাবুদ্দিন ছাত্ররাজনীতি বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেখানে আমারও সামান্য ভূমিকা ছিল। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো তখন রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে বলা হলো- যদি “ক” তাদের সংগঠন থেকে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করে তাহলে আমরাও নিষিদ্ধ করব।
আবার “খ” বললেন যদি “ক” তাদের সংগঠন থেকে ছাত্র রাজনীতি বিলুপ্ত করে, তাহলে আমরাও ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করব। কিন্তু “ক” যখন ক্ষমতায় ছিল “খ” তখন তা করেনি।
আর “খ” যখন ক্ষমতায় ছিল “ক” তা করেনি। এতে বুঝা যায় সংগঠনগুলো তাদের ক্ষমতার হাতিয়ার ও বাহন হিসেবে ছাত্র রাজনীতিকে ব্যবহার করতে চায়। বিএনপি'র আমলেও আমরা দেখেছি ছাত্ররাজনীতির হিংস্রতা। সুতরাং বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় আমি বলবো আজ এই সময়ে কোনভাবেই ছাত্র রাজনীতি অব্যাহত রাখার সুযোগ নেই। ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হওয়া দরকার।
আওয়ার ইসলাম: আবরার ফাহাদ হত্যার পর থেকে প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি জোরালো হয়েছে , আপনি এই দাবি সমর্থন করেন কি?
ড. আব্দুল লতিফ মাসুম: আমি অবশ্যই সমর্থন করি। শুধুমাত্র প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নয় বরং জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা উচিৎ। আর সেটা না করলে আরো হত্যা, আরো খুনাখুনি, আরো রক্তারক্তি হবে এত কোন সন্দেহ নেই।
আওয়ার ইসলাম: ছাত্রলীগের এ জাতীয় কর্মকান্ডগুলো কি শুধুমাত্র অতি উৎসাহ নাকি এর পেছনে সরকারি দলের পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে?
ড. আব্দুল লতিফ মাসুম: আমি আগেই বলেছি, আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ও ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার জন্য ছাত্ররাজনীতিকে বাহন ও হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে।
আওয়ার ইসলাম: আবরার হত্যার বিচার হবে বলে মনে করছেন কি?
ড. আব্দুল লতিফ মাসুম: আবরার হত্যার বিচার হবে না। আমি একটি উদাহরণ দেই- বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে কিনা এ নিয়ে বিবিসি বাংলা একটি আয়োজন করেছিল। সেখানে তৎকালীন আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম ও আমি ছিলাম। উপস্থাপক মন্ত্রী সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন, বিশ্বজিৎ হত্যার বিচার হবে?- মন্ত্রী সাহেব বললেন, অবশ্যই হবে।
তারপর আমাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, আপনি কি মনে করেন বিশ্বজিৎ হত্যার বিচার হবে? আমি তখন বলেছিলাম, না বিচার হবে না। মন্ত্রী সাহেব সরকারের লোক তিনি সরকারি ভাষায় কথা বলতে বাধ্য এবং বলবেনই। এজন্য তিনি বলেছিলেন, বিচার হবে।
আপনারা লক্ষ্য করেছেন কীভাবে বিশ্বজিৎ হত্যার বিচার হয়েছে! হত্যার অধিকাংশ আসামি ছিল পলাতক। তাদেরকে ধরা হয়নি। তাদের কাউকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে অধিকাংশকেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মজার ও বিস্ময়ের বিষয় হলো এই- যাদের ব্যাপারে ফাঁসির রায় হয়েছিল তাদেরকে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ক্ষমা করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতির আদেশে তাদেরকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। আবরার হত্যার বিচারও এরকমই হবে।
আপনারা রেকর্ড করে রাখেন, ছয় মাস পর দেখা যাবে ইশতেহারে যাদের নাম দেয়া হয়েছে পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ উপস্থিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। যার ফলে তাদেরকে বেকসুর খালাস দিয়ে দেওয়া হবে। অথবা কারও কারও স্বল্পমেয়াদী কারাদণ্ড হতে পারে। এরচে’ বেশি কিছু হবে না।
আওয়ার ইসলাম: বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভিন্নমত চর্চার পরিবেশ তৈরি করার উপায় কী; এবং এ বিষয়ে কাদের ভূমিকা রাখতে হবে?
ড. আব্দুল লতিফ মাসুম: প্রথমত যে বিষয়টা দরকার সেটা হচ্ছে সরকারের সদিচ্ছা। যেহেতু সরকারের অনুগ্রহে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলে সুতরাং তাদেরকে এ বিষয়ে নিরপেক্ষ থাকতে হবে এবং যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে হবে।
এ বিষয়ে দ্বিতীয়তঃ ভূমিকা রাখতে পারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। এখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের যথেষ্ট শক্তি থাকে। তারা চাইলে ক্যাম্পাসগুলোতে ভিন্ন মত চর্চার পরিবেশ তৈরি করতে পারেন। সুতরাং সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন উভয়কেই এক্ষেত্রে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে হবে।
আওয়ার ইসলাম: আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য আপনার প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।
ড. আব্দুল লতিফ মাসুম: আপনাকেও ধন্যবাদ।
আরএম/