মুফতি ওমর ফারুক সন্ধীপি। প্রবীণ আলেম। মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও ওয়ায়েজ। শাইখুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফীর খলিফা। ওয়াজের ময়াদানে যার কেটেছে দীর্ঘ ৫০ বছর। এখনো যিনি কুরআনের কথা এবং হাদিসের বাণী নিয়ে ছুটে চলেন দেশের আনাচে কানাচে। তার সঙ্গে বর্তমান ওয়াজের হাল হাকিকত নিয়ে কথা বলেছেন আওয়ার ইসলামের বিশেষ প্রতিনিধি মাহমুদুল হাসান ।
আওয়ার ইসলাম: ওয়ায়েজদের কেমন হওয়া উচিত?
মুফতি ওমর ফারুক সন্ধীপি: সাধারণত কুরআন ও হাদিসের গভীর জ্ঞান থাকা বক্তাদের জন্য জরুরি। কুরআনের সারগর্ভ মূলক আলোচনা করতে পারে সেই যোগ্যতা থাকা। বর্তমান যুগের তিনটা ফিতনা- রাষ্ট্রীয় ফিতনা, বেদাতিদের ফিতনা, ভন্ড পীর-ফকিরদের ফিতনা।
আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহ. ইমাম বুখারীর উস্তাদ ছিলেন ইমাম আবু হানিফার ছাত্র ছিলেন। বিখ্যাত মুহাদ্দিসদের মধ্যে হতে তিনিও ছিলেন অন্যতম। তিনি বলেছেন, ইসলামের শক্রু তিন ধরনের-
১. অধিকাংশ সময়ে ক্ষমতাসীন লোকেরা ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় অথবা তাদের গদি ঠিকিয়ে রাখার জন্য ইসলামকে ব্যবহার করে।
২. আর যারা বেদাতি মৌলভির উলামায়ে ছু তারা ইসলামের অপব্যাখ্যা দিয়ে মানুষদেরকে পথভ্রষ্ট করে।
৩. আর পীর-ফকির, দরবেশ ভন্ডরা সিলসিলার নাম দিয়ে মানুষদের পথভ্রষ্ট করে।
আরও অন্যান্য অনেক ফিতনা যা এই তিনটার মধ্যেই আছে। কাদিয়ানীদের ফিতনা, লা মাজহাবীদের ফেতনা, এমন আরও অনেক৷ বক্তাদের উচিত এ ফেতনা সম্পর্কে সাধারণ মানুষদেরকে এ বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতন করা।
ওয়াজে অনেক সময় কিসসা কাহিনি বলে থাকেন অনেকেই। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় অধিকাংশ কিসসা-কাহিনি বানোয়াট। যা মানুষদেরকে হাসানোর জন্য, কাঁদানোর জন্য করে থাকেন। তাও ঠিক নয়। এমন ওয়াজ করা প্রয়োজন, যার মাধ্যমে সমাজের গঠনমূলক পরিবর্তন আসবে৷ ওয়াজ মানে নাসিহাহ। আর এটা এমন হওয়া উচিত যেটা মানুষের ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবনে পরিবর্তন আনতে পারবে।
আওয়ার ইসলাম: ওয়াজে অতিরিক্ত হাসি-তামাশা কতটুক যুক্তিযুক্ত? এ ক্ষেত্রে ওয়ায়েজদের করণীয় কী?
মুফতি ওমর ফারুক সন্ধীপি: আসলে এমনটি আমাদের বুজুর্গানে দীনদের মধ্যে ছিল না। তারা যখন ওয়াজ করতেন তাদের চোখে পানি থাকত। মনের আন্তরিক আবেগ নিয়ে তারা আল্লাহ এবং রাসুলের কথা শুনাতেন। হাসি তামাশা এগুলি আমাদের আকাবীরদের আদর্শের খেলাফ। এ জন্য তাদের ওয়াজের দ্বারা মানুষের যে ফায়দা হতো তা এখন আর হয় না।
আওয়ার ইসলাম: এ ক্ষেত্রে বক্তারা পড়াশোনা করার জন্য কেমন বই নির্বাচন করতে পারেন?
মুফতি ওমর ফারুক সন্ধীপি: সীরতের উপর যদি কেউ বয়ান করতে চান তাহলে তার জন্য মহানবী সা. জীবন নির্ভর কিতাব পড়া উচিত। এ ক্ষেত্রে হজরত মাওলানা ইদ্রিস কান্দলভী রাহ. এর 'সীরাতুন্নবী' নামক কিতাব পড়তে পারেন।
এ ছাড়া আহকাম নিয়ে কেউ ওয়াজ করতে চাইলে তার জন্য উচিত থানভী রাহ. এর কিতাব 'আহকামে জিন্দেগী' এ সমস্ত কিতাব যেগুলো বয়ানের জন্য মৌলিকতার স্থান রাখে তা বেশি পড়া৷
আমাদের বুজুর্গানে দীনের মধ্যে মাওলানা শিব্বির আহমদ উসমানি রহ. মাওলানা আতাউল্লাহ শাহ বুখারী রহ. উনাদের বয়ান খুৎবা সকলের কাছে সর্বযুগে সমাদৃত। বক্তারা যদি তাদের বয়ানকে অনুসরণ করেন এবং যে ফেৎনা সম্পর্কে তারা মানুষদের সতর্ক করেছেন সেই ফেৎনা নিয়ে সচেতন করেন সবাইকে, তবে সমাজ সুন্দর হবে।
এ জন্য আকাবীরদের নকশার উপর থেকে কেউ যদি বয়ান করে এবং যে কোন একজনকে নিজেদের আইডল মনে করেন তাহলে ভালো ওয়াজ করা আজও সম্ভব।
আওয়ার ইসলাম: বয়ানের ভাষা ও কথা বলার ভঙ্গি কেমন হওয়া উচিত?
মুফতি ওমর ফারুক সন্ধীপি: সবচেয়ে উত্তম হচ্ছে প্রাঞ্জল ভাষায় কথা বলা। সাধু হোক চলিত হোক, যে ভাষাতেই কথা হোক না কেনো শ্রোতা যাতে সুন্দর করে বক্তার কথা বুঝেন। কোন কোন বক্তা এমন আছেন- যারা আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন। আমি মনে করি তাদের আঞ্চলিক ভাষা পরিহার করা উত্তম। তাহলে সব ধরনের লোক ওয়াজ বুঝতে পারবেন এবং এর দ্বারা ফায়দা হাসিল করতে পারবেন।
আওয়ার ইসলাম: শিশু, ২৬ ইঞ্চি বক্তা নিয়ে আপনি কী বলবেন?
মুফতি ওমর ফারুক সন্ধীপি: এটা কিয়ামতের আলামত এবং বড় ফিৎনা বলা যায়। যারা এটাকে মুজেজা বা কারামত মনে করেন তারা এর হাকিকত বুঝেন না। ইসলামের চৌদ্দশত বছরের জীবনে এ ধরনের বক্তাদের আবির্ভাব ছিল না। একজন লোক বারো-পনেরো বছর ইলমে দীন হাসিল করেন, বড়দের সোহবতে থাকেন, সুলুকের উপর কাজ করেন আরও অনেক কিছু। একজন ভালো মাপের বক্তা হওয়ার জন্য অনেক মুতাআলা এবং মেহনতের প্রয়োজন।
শিশু বক্তাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় বয়স মাত্র সাত-আট বছর, তাহলে সে কুরআন হাদিস পড়লো কিভাবে? তারা দু’ একটা ওয়াজ মুখস্ত করে তারপর তা শুনিয়ে দেয়। মানুষ হেই হৈ করে৷ এই আরকি৷ এটা ফিৎনা ছাড়া কিছুই না।
আওয়ার ইসলাম: শিশু বক্তাদের দাওয়াত করে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজক উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন কি?
মুফতি ওমর ফারুক সন্ধীপি: উত্তম হলো শিশু বক্তা নামের কিছু ইসলামে নেই৷ সাহাবের স্বর্ণযুগে তাবেইন তাবেতাবিইন এর যুগে কোন শিশু বক্তা ছিল না। এটা একটা ভেল্কিবাজি ছাড়া কিছুই না৷ আমাদের এই লাইনে যে যত প্রবীণ হয় তার কথা ততো দামী হয়। বুজুর্গদের যত বেশি বয়স হয়েছে তার দ্বারা ততো বেশি লাভ হয়েছে।
আওয়ার ইসলাম: অনেকেই নামের শুরুতে ‘আল্লামা’ লেখেন অথচ তাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় তাদের কুরআন তেলাওয়াত শুদ্ধ নয়। এটা কি ঠিক?
মুফতি ওমর ফারুক সন্ধীপি: অযোগ্য ব্যক্তি যারা ‘আল্লামা’ লেখেন এরা আইন দিয়ে আল্লামা নয় আলিফ দিয়ে আল্লামা৷ এই আল্লামা অর্থ হলো কষ্টদানকারী। দেখা যায় যে ছোট খাট কিতাব পড়াতে পারে না সেও আল্লামা উপাধি লাগিয়ে দেয়। এটা একটা একটা পোস্টার সন্ত্রাস ছাড়া কিছুই না। নিজদের কিছু ফায়দা হাসিলের জন্য এ কাজটা করে থাকেন৷
আওয়ার ইসলাম: আল্লামা শব্দের প্রয়োগের ব্যাপারে যদি বলতেন?
মুফতি ওমর ফারুক সন্ধীপি: আল্লামা উপাধি সবার জন্য নয়৷ সর্ব শীর্ষস্থানীয় আলেমকে আমরা আল্লামা ডাকতে পারি।
আওয়ার ইসলাম: তরুণ ওয়ায়েজদের ব্যাপারে আপনার কোন পরামর্শ...
মুফতি ওমর ফারুক সন্ধীপি: তরুন ওয়ায়েজদের গঠনমূলক ওয়াজ করা উচিত। ভিত্তিহীন বানোয়াট কাহিনি ছেড়ে যে ওয়াজের দ্বারা মানুষের আমলের প্রবণতা বাড়বে, সমাজের মানুষেরা ইসলাম সম্পর্কে সচেতন হবেন, সে ধরনের ওয়াজ করাই উচিত।
আরএম/