মহিউদ্দিন রাব্বানি
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। শুরু হয় ইংরেজ শাসন। ক্ষমতায় এসেই তারা শিক্ষা, সংস্কৃতির দিকে বিশেষ নজর দেয়। তারা জানতো টেকসই ক্ষমতার জন্য এগুলো অপরিহার্য।
অন্যদিকে রাজত্ব, শাসন ক্ষমতা, সামাজিক মর্যাদা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি হারিয়ে বাংলার মুসলিম সম্প্রদায় গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। বন্ধ হয়ে যায় ইসলামী শিক্ষার কেন্দ্রসমূহ। যার ফলে বাংলার মুসলিম জনগোষ্ঠী পিঁছিয়ে পড়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে।
জাতির এ ক্রান্তিলগ্নে ইসলামি শিক্ষা, সংস্কৃতি ও তাহযিব-তামাদ্দুন রক্ষার জন্য কয়েকজন মুসলিম শিক্ষাবিদ ১৭৮০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ভারতীয় বড় লাট স্যার ওয়ারেন হেস্টিংস-এর সাথে সাক্ষাৎ করে কলকাতায় একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন। যাতে এ মাদরাসার শিক্ষার্থীগণ সরকারি অফিস-আদালতে জজ, এম.এস.আর (member service representative) ইত্যাদি পদে নিয়োগ পেতে পারেন পারেন।
ফোর্ট উইলিয়ামের গর্ভনর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিসং (বড় লাট) তাদের প্রস্তাবে সম্মত হলেন। কলকাতার বৈঠকখানা রোডে মাসিক একশ' টাকা ভাড়া বাড়ীতে ১৭৮০ সালে একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। যা শুরুতে কলকাতা আলিয়া মাদরাসা, পরবর্তীতে ঢাকা আলিয়া মাদরাসা নামে পরিচালিত হয়।
মাদরাসার প্রথম পরিচালক ছিলেন মওলানা মজদুদ্দীন ওরফে মোল্লা মদন রহ.। তার মাসিক বেতন ধার্য হয় তিনশ' টাকা। ১৭৮০ সালের অক্টোবর থেকে ১৭৮১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত মোট সাত মাস ভাড়া করা বাড়িতে মাদরাসাটি চলতে থাকে।
ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে স্থান সংকুলান না হওয়ায় কলকাতার পদ্মপুকুর লেনে একখণ্ড জমি ক্রয় করে বড় লাট মাদরাসার জন্য একটি দালান নির্মাণ করেন। এর নাম রাখা হয় মোহামেডান কলেজ।
১৭৮৫ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির যাবতীয় ব্যয় নির্বাহের দায়িত্ব সরকারের উপর ন্যস্ত করেন। ১৮২৪ সালের জুলাই মাসে মাদরাসার ওয়েলেসলি স্ট্রিটে নতুন ভবনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন গভর্নর জেনারেল।
১৮১৯ থেকে ১৮৫০ সাল পর্যন্ত একজন ইংরেজ সেক্রেটারি ও একজন মুসলমান সহকারি সেক্রেটারির অধীনে ‘বোর্ড অব গভর্নরস’ দ্বারা পরিচালিত হয়। ১৮৫০ সালে আলিয়া মাদরাসায় অধ্যক্ষের পদ সৃষ্টি হলে ড. এ. স্প্রেংগার মাদরাসার প্রথম অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ১৮৫০ সাল থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত ইংরেজ কর্মকর্তাগণ এ পদ অলঙ্কৃত করেন।
১৮২৯ সালে আলিয়া মাদরাসায় ইংরেজি বিভাগ খোলা হয়। ১৯০৭ সালে মাদরাসায় তিন বছর মেয়াদি কামিল কোর্স চালু হয়।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হওয়ার পর আলিয়া মাদরাসা কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। ঢাকায় আলিয়া মাদরাসার প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন খান বাহাদুর মাওলানা জিয়াউল হক। ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে কবি নজরুল কলেজ)-এ মাদরাসার কার্যক্রম চলতে থাকে।
তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান ১৯৫৮ সালের ১১ মার্চ ঢাকার বখশীবাজারে মাদ্রাসার চারতলাবিশিষ্ট নতুন ভবন ও ছাত্রাবাসের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। হলটি বর্তমানে আল্লামা কাশগরী রহ. হল নামে পরিচিত। ১৯৬১ সালে মাদরাসা লক্ষ্মীবাজার থেকে বখশীবাজারে স্থানান্তরিত হয়।
বাংলাদেশের মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনায় ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে মাদরাসা শিক্ষা অধ্যাদেশ মাদরাসা বোর্ড স্থাপিত হয়। এই বোর্ড কর্তৃক ২০০৬ সাল পর্যন্ত দাখিল, আলিম, ফাযিল, কামিল পরীক্ষা পরিচালিত হয় এবং ছাত্র-ছাত্রীদের ফলাফলের ভিত্তিতে বোর্ড কর্তৃক পরীক্ষাগুলোর সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়।
২০০৬ সালে ঢাকা আলিয়া মাদরাসা ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়।
লেখক: শিক্ষার্থী, মাদরাসা-ই আলিয়া ঢাকা, ঢাকা
আরএম/