মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মালেক
বর্তমানে যারা লেখালেখির কাজ করেন বা এর মাধ্যমে দাওয়াহর কাজ করেন তাদের জন্য শিক্ষণীয় একটি ঘটনা। মুফতি আল্লামা তাকি উসমানির এ ঘটনা থেকে অনেক কিছুই শেখার রয়েছে। লেখার ক্ষেত্রে আমরা সাধারণত এসব ভুলগুলো করে থাকি।
আইয়্যুব খানের সামরিক শাসন চলছিল তখন। মুসলিম আইনকে পাশ কাটিয়ে তিনি একটি পারিবারিক আইন জারি করেছিলেন। স্থানীয় অধিকাংশ আলিমগণ এর বিরোধিতা করেছিলেন। তবে এক লোক এই পারিবারিক আইনের প্রতি সাফাই গেয়ে একটি বই রচনা করে। বইটিতে কুরআন-সুন্নাহর দলিলের অপব্যাখ্যা করে এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয় যে জারি করা পারিবারিক আইন কুরআন-সুন্নাহ পরিপন্থী নয়।
তখন তাকি উসমানিকে তাঁর বাবা বিচারপতি শাফি উসমানি (রহিমাহুল্লাহ) সেই বইয়ের বিরুদ্ধে একটি জবাব লেখার আদেশ দেন। যুবক বয়সের জোশে পূর্ণ মাওলানা তাকি উসমানি তখন বই ও লেখকের প্রতি ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ ও তীব্র আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার করে একটা সমালোচনাপূর্ণ বই লেখেন। লেখককে অনেক উপহাসও করা হয় এই বইটিতে। বইটি প্রকাশের পূর্বে তিনি তাঁর বাবাকে দেখতে দেন।
তাঁর বাবা তখন বলেন, “বাবা! তুমি তো সাহিত্যের বিচারে খুব সুন্দর কিতাব লিখেছ। এর সাহিত্যমান অনেক উন্নত। কিন্তু আমাকে বল, তুমি কি এটা এজন্য লিখেছ যে, যারা আগে থেকে তোমার পক্ষে আছে তারা বাহবা দিবে এবং বলবে, বাহ! কত চমৎকার দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছে! কী শক্তিশালী কায়দায় প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা হয়েছে। যদি তাদের এমন প্রশংসা লাভের জন্য লিখে থাক তাহলে তোমার এ কিতাব খুবই সফল একটি কিতাব। তোমার পক্ষের লোকেরা এই কিতাব পড়লে পঞ্চমুখে তোমার প্রশংসা করবে।
কিন্তু উদ্দেশ্য যদি এই হয় যে, যারা ওই কিতাব পড়ে গোমরাহ হয়েছে তাদেরকে পুনরায় চিন্তা-ভাবনা করতে উৎসাহিত করা এবং তাদেরকে সঠিক পথে আনার চেষ্টা করা তাহলে তোমার এই রচনার কানাকড়িও মূল্য নেই। কারণ তুমি শক্ত ভাষায় আক্রমণ করে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে প্রথমেই তাদেরকে বীতশ্রদ্ধ করে দিয়েছ।
প্রথমেই তারা এটা ভাববে যে, এ তো আমাদের বিপক্ষের কেউ লিখেছে। আমাদের সঙ্গে দুশমনি করে লিখেছে। তাই এই কিতাব থেকে তারা কিছু গ্রহণ করতে পারবে না। সুতরাং এই কিতাব লেখার উদ্দেশ্য যদি আল্লাহকে সন্তুষ্ট করা এবং মানুষের হেদায়াতের পথ সুগম করা না হয়ে থাকে তাহলে তোমার এই কিতাবের এক পয়সাও দাম নেই।”
তারপর বললেন, “দেখ, আল্লাহ যখন হযরত মূসা আ. এবং হযরত হারূন আ. কে ফেরাউনের কাছে পাঠালেন তখন তাদেরকে বলেছিলেন, [ভাবার্থ] ‘ফেরাউনের সঙ্গে তোমরা নরম ভাষায় কথা বলবে। হতে পারে সে নসীহত গ্রহণ করবে। হতে পারে তার অন্তরে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি হবে।’ “অথচ আল্লাহ আগে থেকেই জানতেন, সে নসীহত গ্রহণ করবে না…”
আব্বাজান বললেন, “তুমি মূসা আ.-এর চেয়ে বড় মুসলিহ (আন্তরিক) দাঈ হতে পার না আর তোমার প্রতিপক্ষও ফেরাউনের চেয়ে বেশি গোমরাহ নয়। সুতরাং তাঁদেরকেই যখন নরম ভাষায় কথা বলার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে তাহলে আমি আর তুমি কোন কাতারে শুমার হব? সুতরাং যদি কারো হেদায়েতই উদ্দেশ্য হয় তাহলে দাওয়াতের ওই পয়গাম্বরী পন্থা অবলম্বন করা ছাড়া আল্লাহ সন্তুষ্ট হবেন না।”
তাকি উসমানি বলেন, “…[এরপর] পুরো কিতাব পুনরায় লিখেছি এবং তাতে আক্রমণাত্মক ও ব্যাঙ্গাত্মক যেসব কথাবার্তা ছিল তা সম্পূর্ণ বাদ দিয়েছি।” তাঁর বাবা তাঁকে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন: “…একসময় তো অবশ্যই আসবে যখন আহকামুল হাকিমিনের [আল্লাহর] আদালত কায়েম হবে এবং সেখানে অবশ্যই তোমাকে জবাবদিহি করতে হবে। যে কথাই তোমার যবান থেকে বের হচ্ছে তা সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর কাছে রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে। তাই যে কথাই বল চিন্তা করে বলো।”
আমরা যারা অনলাইনে কিংবা অফলাইনে উঠতি দাঈ, তাদের জন্য উপরের ঘটনা থেকে অনেক কিছু শেখার ও বুঝার আছে। যারা নতুন লেখালেখি করেন তাদেরও শেখার আছে। অধিকাংশ সময়ই দেখা যায় আমাদের লেখায় গালি গালাজে ভরপুর থাকে, সেখানে তথ্য ও যুক্ত থাকে নগন্য। এসব এড়িয়ে চলা উচিত এবং লেখায় যথাযথ যুক্তি উপস্থাপন করা উচিত। আল্লাহ তাওফিক দান করুন।
[তথ্যসূত্র: তালিবানে ইলম : পথ ও পাথেয়, মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মালেক, মাকতাবুল আশরাফ, ঢাকা: ২০১১, পৃষ্ঠা: ২৮১-২৮৩]
আরএম/