আবদুস সাত্তার আইনী ♦
মালয়শিয়াতে বিয়ের আগে প্রত্যেক ছেলেমেয়েকে বিবাহ-পরবর্তী জীবন সম্পর্কে ট্রেনিং কোর্স করতে হয় এবং বিয়ের সময় এই কোর্সে অংশগ্রহণের সনদ প্রদর্শন করতে হয়। তা না হলে বিয়ে করা যায় না।
বাংলাদেশেও এমন ট্রেনিং কোর্স চালু করা এখন সময়ে দাবি। যে-হারে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটছে তা আগামী প্রজন্মের জন্য ভয়ানক শঙ্কা তৈরি করছে। দাম্পত্য জীবনে বোঝাপড়াটা না-হওয়াই বিবাহবিচ্ছেদের প্রধান কারণ। আনুষঙ্গিক আরও অনেক কারণ রয়েছে। আমি আমার যাপিত অভিজ্ঞতা থেকে এখানে কিছু বিষয় শেয়ার করবো।
১. দাম্পত্য জীবনে তৃতীয় পক্ষ
দাম্পত্য জীবনে তৃতীয় পক্ষ মানুষ যেমন হতে পারে, তেমনি মানুষ ছাড়া অন্যকিছু হতে পারে। তবে ৯৮% ক্ষেত্রেই এই তৃতীয় পক্ষ মানুষ। দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রী ছাড়া বাকি সবাই তৃতীয় পক্ষ। মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন সবাই। মানুষ ছাড়া অন্য তৃতীয় পক্ষ হলো শখ বা হবি - যা স্বামী বা স্ত্রীর বা উভয়ের থাকতে পারে।
দাম্পত্য জীবনে যখন মানুষ তৃতীয় পক্ষের অযাচিত অনুপ্রবেশ ঘটে তখন তাতে ফাটল সৃষ্টি হয়। তৃতীয় পক্ষের ফুসলানো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পরস্পরের প্রতি বৈরী মনোভাব তৈরি করে।
‘এই ছেলেকে তোমার/তোর স্বামী হিসেবে একদমই মানায় না’, ‘আমার পরামর্শ না শুনে ভুল করেছ / করেছিস’, ‘তুমি / তুই এই মেয়ের সঙ্গে কীভাবে ঘরসংসার করবে/ করবি তা আমি ভেবে পাই না’ ইত্যাকার পরামর্শ ও উসকানি স্বামী-স্ত্রীর মনের মধ্যে বিতৃষ্ণার সৃষ্টি করে।
বিয়ের পর তৃতীয় পক্ষ থেকে আরও নানা ধরনের কানকথা আসতে থাকে এবং দাম্পত্য জীবনে একটি গুমোট অবস্থার সৃষ্টি হয়। এসব ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীকে সচেতনভাবে তৃতীয় পক্ষের কানকথা এড়িয়ে যেতে হবে।
তৃতীয় পক্ষ হবি বা শখ হলে তা সাময়িক উত্তেজনার সৃষ্টি করে। ‘বই পড়া’, ‘গান গাওয়া’, ‘রেস্টুরেন্টে ঘন ঘন খাওয়া’, ‘ঘোরাঘুরি করা’ ইত্যাদি শখ থাকতে পারে স্বামী-স্ত্রীর একজনের বা উভয়ের। এসব ক্ষেত্রে অতিরঞ্জন হয়ে গেলে মানোমালিন্য তৈরি হতে পারে। তাই সচেতন থাকতে হবে।
আমার এক বন্ধুর লেখালেখির শখ ছিলো; কিন্তু লেখালেখি করে যে টাকা আয় করবে সেই সামর্থ্য তার নেই। তাই তার স্ত্রীর কঠিন নিষেধাজ্ঞার মুখে সে লেখালেখি বাদ দিয়েছে। এখন সে মনমরা থাকে।
২. দাম্পত্য জীবনের সমস্যায় পরমর্শ চাওয়া
দাম্পত্য জীবনে নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে। এই ক্ষেত্রে কোন কোন সমস্যার সমাধান আপনি নিজে করবেন আর কোন কোন সমস্যায় পরমার্শ চাইবেন চাবেন তা গুরুত্বপূর্ণ। কার কাছে পরামর্শ চাইবেন তা আরও গুরুত্বপূর্ণ।
দাম্পত্য জীবনের যেসব সমস্যার সমাধান স্বামী-স্ত্রীতে মিলে করা যায় তা আর অন্য কাউকে না-জানানোই ভালো। সাধারণ মান-অভিমান এমনিতেই দূর হয়ে যায়। অন্যদের জানালে তা আরও বড় হতে পারে।
মেয়েদের একটা সমস্যা হলো তারা দাম্পত্য জীবনের খুঁটিনাটি ঘটনা পর্যন্ত তাদের মা-বোনদের জানিয়ে থাকে এবং তারা যে-পরমর্শ দেয় তা কাজে লাগাবার চেষ্টা করে। এতে একটি সামান্য ঘটনাও বড় দুর্ঘটনায় রূপ নেয়।
দাম্পত্য জীবনের সমস্যা সমধানে মা-বাবা, ভাই-বোন বা নিকটাত্মীয়কের কাছে পরামর্শ চাইলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা হিতে-বিপরীত হয়।
আপনি আপনার মা বা বড়বোন বা বড়ভাইকে ফোন করে জানালেন যে, আপনার স্ত্রী আপনাকে এই এই কথা বলেছে, খোটা দিয়েছে, অপমান করেছে। আপনার মা বা বোন বা ভাই রেগে গিয়ে বললেন, কী, এত বড় কথা ওর মুখে, এত আস্পর্ধা, আগামী একমাস ওর সঙ্গে কথা বলবি না, মিশবি না।
আপনি আবার এই কথা আপনার স্ত্রীকে জানিয়ে দিলেন। কিন্তু দুই-তিনদিন যাওয়ার পর আর টিকতে পারলেন না। তখন মুখ করুণাবিধুর করে স্ত্রীর অভিমান ভাঙাতে গেলেন। সে মুখ ঝামটা মেরে বললো, তোমার মা / ভাই যা বলেছে সেটাই করো। আমার সঙ্গে কথা বলো না, আমার কাছে এসো না। এভাবে একটি সামান্য ঘটনা অতি বড় ঘটনায় রূপান্তরিত হয়।
আমার মতে, দাম্পত্য জীবনের সমস্যা সমাধানে কল্যাণকামী অভিজ্ঞ বন্ধু বা পরিচিত ব্যক্তি থেকে পরামর্শ নেওয়াই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের পরামর্শ হবে এরূপ : ‘এ আর এমনকি, আমার জীবনে কত ঘটেছে। স্ত্রীর জন্য ছোট একটি উপহার নিয়ে যাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
৩. আপনাকে বধির হওয়ার ভান করতে হবে
ইমাম গাজালি রহ. বলেছেন, ‘যেসব যুবকেরা মনে করে স্ত্রীর কটূ কথায় ধৈর্য ধরতে পারবে না তাদের বিয়ে করা উচিত নয়।’ স্ত্রীর কটূ কথা সহ্য করার ক্ষমতা না থাকলে আপনার বিয়ে করা উচিত হবে না। তারা কটূ কথা বলবেই এটা চিরসত্য। এই সত্য আপনাকে মেনে নিতে হবে।
‘তোমার চেহারা যে মাগুর মাছের মতো তা বিয়ের আগে খেয়াল করি নি। করলে তোমাকে বিয়ে করতাম না।’ স্ত্রীর এই কথা শুনে আপনার ক্ষেপে ওঠা যাবে না। হয় চুপ থাকুন না-হয় বলুন, ‘তোমার মতো চাঁদমুখো স্ত্রী যে আমার কপালে জুটেছে এটা আমার বড় ভাগ্য। আর আমার চেহারা যা-ই হোক, আল্লাহর কোনো সৃষ্টিই নিন্দনীয় নয়।’ কী, বলতে পারবেন না?
৪. বিয়ের আগে ট্রেনিং কোর্স না করলেও অনন্ত দশ-পনেরো জন মানুষ থেকে পরামর্শ নিতে ভুলবেন না। দাম্পত্য জীবন কেন সুখের হয় আর কেন দুখের তা জানুন। সব ধরনের মানুষ থেকে পরামর্শ নিন।
যার দাম্পত্য জীবন স্বর্গের মতো তার থেকে পরামর্শ নিন, এবং যার দাম্পত্য জীবন নরকের মতো তার থেকেও পরামর্শ নিন। যার বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে তার থেকে যেমন, তেমনি যার দাম্পত্য সম্পর্ক ঝুলোঝুলি অবস্থায় আছে তার থেকেও পরমার্শ নিন।
আশা করি, আপনার দাম্পত্য জীবন সুখের হবে। আপনি সুখী হলে আপনার পরিবার সুখী, সমাজও সুখী।
-এটি