আল ফাতাহ মামুন
দার্শনিক আল বেরুনি ভারত ভ্রমষ শেষে কাশ্মীর সম্পর্কে মন্তব্য করে লিখেছে, ‘দ্য প্যারাডাইস অব দ্য আর্থ। পৃথিবীর স্বর্গ।’ আফসোস! ভূস্বর্গের মানুষের কপালে স্বর্গ সুখ হারিয়ে গেছে ভারত ভাগের সময় থেকেই।
সম্প্রতি কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল হওয়ায় দুঃখের পাল্লায় আরো কিছু পাথর জমা হলো। আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন, এ ভূস্বর্গের মানুষের জীবনে কখনো স্বর্গ সুখ মেলবে কি না।
মানুষ মাত্রই তার দেশকে ভালোবাসে। কেউ কম কেউ বা বেশি। কিন্তু কাশ্মীরীদের দেশপ্রেম অতুলনীয়। এর কিঞ্চৎ চিত্র ফুটে ওঠেছে অধ্যাপক বুলবুল সরওয়ারের কাশ্মীর সফরনামা ‘ঝিলাম নদীর দেশে’।
কাশ্মীরের গাড়িতে ওঠে এক তরুণীর সঙ্গে পরিচয় হয় বুলবুল সরওয়ারের। পাশের সিটে বসা তরুণীর হাসি দেখেই মন সায় দিয়েছিলো, মেয়েটি মুসলিম। এতটুকু লিখে বুলবুল সরওয়ার মন্তব্য করেন, বিশ্বাসের আলাদা একটি ভূগোল আছে, যা রাজনৈতিক সীমানার চেয়ে অনেক বিস্তৃত। তার হাসিতে জেগে ছিলো সেই চিহ্ন।’
মনের বিশ্বাস এবার সত্যি হয়ে ধরা দিলো। মেয়েটি নিজ থেকেই জানতে চাইলো, ‘মেরি আন্দাজ, আপ মুসলিম হ্যায়...। বুলবুল সরওয়ারের মন্তব্য যে অক্ষরে অক্ষরে সত্য, তা আবার প্রমাণিত হলো। বিশ্বাসের ভূগোল দেখে মেয়েটিও বুঝে নিয়েছে, পাশের যাত্রী আমার ভাই। মুখে জিজ্ঞেস করা ছিলো আরো ঘনিষ্ঠ হওয়ার উপলক্ষ্য মাত্র।
তরুণীর নাম নাজনীন। দিল্লি ইউনিভার্সিটির ইসলামিক স্টাডিজ ডিপার্টমেন্টের ছাত্রী। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে। আর মেয়েটি তার ঈগলের ডানার মত টান টান ভ্রু নাচিয়ে কাশ্মীরের গল্প শুনিয়ে যাচ্ছে বুলবুল সরওয়ারকে।
নাজনীন বলল, কাশ্মীর হলো পৃথিবীর গোলকের উপর রাখা একটি উঁচু বাটি। এর চারদিকে পাহাড় ঘেরা। অনেকটা মালভূমির মত। জম্বু থেকে মাত্র দেড়শো কিলোমিটারের পথ। কিন্তু যেতে লাগে পাক্কা বারো ঘন্টা। কারণ, বিশাল পাঁচিলের মত পাহাড়ের পর পাহাড় অতিক্রম করে যেতে হয় শ্রীনগরে। অথচ এর দিগুণ দূরত্বে অবস্থিত লাহোরে পৌঁছুতে সময় লাগে মাত্র ছ’ ঘন্টা।
বুলবুল সরওয়ার বলেন, নাজনীন এক মনে তার জন্মভূমির গল্প বলে যাচ্ছিলো। কেনো যেনো বারবার মনে হচ্ছিল, এত প্রাণবন্ত মিষ্টি স্বরের ফাঁক গলে এক দু’ ফোঠা কষ্টের শিশিরও ঝরে পড়ছে। ঝরে পড়ারই তো কথা। মোঘল আমল থেকেই কাশ্মীর স্বমহিমায় উজ্জল একটি ভূখন্ড। অথচ পৃথিবীর ভাগ্যহত নিরীহ ভূখন্ডের মত তার এ মহিমা বারবার লুণ্ঠিত হয়েছে।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তার এক আশ্চর্য সুন্দরী নায়িকা সম্পর্কে যে মন্ত্য করেছেন, কাশ্মীরের সঙ্গে তা হুবহু মিলে যায়। তার মন্তব্যটি ছিলো এরকম- জগতের সব নিষ্ঠুরতা বুঝি অপূর্ব সুন্দরীদের সঙ্গেই ঘটে!
গল্প শুনতে শুনতে বুলবুল সরওয়ারে গাড়িটি একটি টানেলের সামনে এসে দাঁড়াল। টানেলের বিশাল ফটকে বড় বড় অক্ষরে লেখা, ‘ওয়ান ওয়ে এন্ট্রি : জবাহেরলাল নেহরু টানেল।’ টানেলটি দেখেই নাজনীনের চোখে মুখে আনন্দ খেলে গেলো। অস্বাভাবিক গর্বিত স্বরে বলল, দু মাইলের এই টানেল পেরুলেই- মেরা জমিন! মেরা ওয়াতান!
ন’ মিনিট পর গাড়ি এসে থামল কাশ্মীরের সীমান্তে। সূর্যের তীব্র আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে গেলো বাংলাদেশি অধ্যাপকের। হাত উঁচু করে পরিষ্কার ইংরেজি নাজনীন বলল, ‘লুক অ্যাহেড। রিড দ্যা সাইনবোর্ড।’
বুলবুল সরওয়ার দেখলেন, একটি সাইনবোর্ডে বড় বড় অক্ষরে লেখা: ‘দ্য প্যারাডাইস অন আর্থ। ওয়েলকাম টু কাশ্মীর।’
লেখক : সাংবাদিক