সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


আরাফার রোজা কখন রাখতে হয়?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাওলানা যাকারিয়া আব্দুল্লাহ ♦

জিলহজ্বের প্রথম দশ দিন অনেক ফজিলতপূর্ণ। এ দশদিনের আমল ও ইবাদত আল্লাহর কাছে অতি প্রিয়। বিখ্যাত সাহাবী আবু হুরায়রা রা. আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লামের ইরশাদ বর্ণনা করেছেন-

ما من أيام العمل الصالح فيهن أحب إلى الله من هذا الأيام، قيل : ولا الجهاد في سبيل الله؟ قال : ولا الجهاد في سبيل الله إلا من خرج بنفسه وماله فلم يرجع من ذلك بشيء.

অর্থাৎ- এমন কোনো দশক (দশদিন) নেই, যার নেক আমল আল্লাহর কাছে এই দিনগুলোর চেয়েও বেশি প্রিয়। আরজ করা হল,আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও কি নয়?

বললেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও নয়, তবে যে তার প্রাণ ও সম্পদ নিয়ে বের হয়েছে এবংকোনো কিছু নিয়েই ফিরে আসেনি (অর্থাৎ শাহাদাত বরণ করেছে)। আলমুসনাদ, আহমদ, হাদিস: ১৯৬৮
হাদিসটি সহিহ বুখারিতে আছে। (হাদিস: ৯৬৯, কিতাবুল ঈদাইন); ফতহুল বারী, ইবনে রজব ৬/১১৩।

এ হাদিসে যিলহজ্বের দশ দিনের আমল-ইবাদতের ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। রোজাও একটি নেক আমল। তবে যেহেতু ঈদের দিন রোজা রাখা নিষেধ তাই ঈদের দিন বাদ দিয়ে তার আগের নয় দিন রোজা রাখাও এ হাদীসের অন্তর্ভুক্ত।

আল্লামা ইবনে হায্ম জাহেরী রাহ.ও এই হাদিসের কারণে জিলহজ্বের প্রথম নয়দিন রোজা রাখা মুস্তাহাব বলেছেন।

তো যারা ঈদের আগের দিন রোজা রেখেছেন (যা ছিল নয় যিলহজ্ব) তারা হারাম কাজ করেছেন বলে দাবি করা উপরোক্ত হাদিসের সরাসরি বিরোধী।

তেমনি ‘ইয়াওমে আরাফা’র রোজা সম্পর্কে প্রশ্নে যে বক্তব্য উদ্ধৃত হয়েছে তা-ও সঠিক নয়। এ বিষয়ে প্রসিদ্ধ হাদীসে- (صيام يوم عرفة أحتسب على الله أن يكفر السنة التي قبله والسنة التي بعده)

‘ইয়াওমে আরাফার রোজার বিষয়ে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী, তিনি এর দ্বারা এর আগের এক বছরের ও পরের একবছরের গোনাহ মাফ করবেন।-সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১১৬২।

‘ইয়াওমে আরাফা’ অর্থ নয় জিলহজ্ব। এটিই সঠিক ব্যাখ্যা। কারণ এই রোজা আরাফা বা উকুফে আরাফার আমল নয়; তা ঐতারিখের আমল। ‘ইয়াওমে আরাফা’ হচ্ছে ঐ তারিখের (নয় যিলহজ্বের) পারিভাষিক নাম।

যেহেতু ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ রোকনহজ্বের প্রধান রোকন উকুফে আরাফা ঐ স্থানের তারিখ হিসাবে নয় যিলহজ্বে আদায় করা হয় তাই এ তারিখেরই নাম পড়ে গেছে‘ইয়াওমে আরাফা’।

একারণে যেসব আমল আরাফা বা উকূফে আরাফার সাথে বিশেষভাবে সংশ্লিষ্ট নয়; বরং যিলহজ্বের নয়তারিখের সাথে সংশ্লিষ্ট, সেগুলোকেও ‘ইয়াওমে আরাফা’র আমল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। উদ্দেশ্য, নয় তারিখে বা ঈদেরআগের দিন আমলটি করতে হবে।

এ প্রয়োগের কারণে (নয় যিলহজ্বকে ‘ইয়াওমে আরাফা’ বলা) আরাফা ও তার নিকটবর্তী অঞ্চলে তো কোনো বিভ্রান্তি হয় না,কিন্তু দূরত্বের কারণে ঐ অঞ্চলের সাথে যেসব অঞ্চলের তারিখের পার্থক্য হয় সেখানে-যারা এই প্রয়োগের সঠিক অর্থ সম্পর্কেঅবগত নয় তাদের-বিভ্রান্তি ঘটে। যেমনটা প্রশ্নোক্ত ক্ষেত্রে ঘটেছে।

এ প্রয়োগের (ইয়াওমে আরাফা অর্থ নয় যিলহজ্ব) আরেকটি দৃষ্টান্ত ‘তাকবীরে তাশরীক’। এটি আরাফা বা উকুফে আরাফারবিশেষ আমল নয়।

এটি শুরু হয় নয় যিলহজ্ব ফজর থেকে, অথচ যে দলীল দ্বারা নয় তারিখ থেকে তাকবীরে তাশরীক শুরু হওয়াপ্রমাণিত তাতেও ‘ইয়াওমে আরাফা’ শব্দই আছে। দলীলের আরবি পাঠ এই-
عن علي رضي الله عنه : أنه كان يكبر بعد صلاة الفجر يوم عرفة، إلى صلاة العصر من آخر أيام التشريق، ويكبر بعد العصر. رواه ابن أبي شيبة في مصنفه وإسناده صحيح كما في الدراية.
আলমুসান্নাফ, ইবনে আবী শাইবা, হাদিস: ৫৬৭৭, ৫৬৭৮ এখানেও কি ‘ইয়াওমে আরাফা’ অর্থ নয় যিলহজ্ব করা ভুল?।

দ্বিতীয়ত, গোটা মুসলিম উম্মাহর ইজমা আছে যে, ইয়াওমে আরাফার পরের দিনটিই ইয়াওমুন নাহর।

এটি প্রমাণ করে, ‘ইয়াওমে আরাফা’ একটি তারিখের নাম, আর তা হচ্ছে নয় যিলহজ্ব, যেমন ‘ইয়াওমুন নাহর’ একটি তারিখেরনাম, আর তা হচ্ছে দশ যিলহজ্ব।

কোনো অঞ্চলের অধিবাসীরা যদি ঐ অঞ্চলের তারিখ অনুযায়ী ইয়াওমুন নাহরের অর্থ দশজিলহজ্ব ধরে ইয়াওমে আরাফার এমন কোনো অর্থ করেন, যদ্বারা সেখানের তারিখ হিসেবে তা হয়ে যায় আট যিলহজ্ব, তাহলেসেটা হবে এক উদ্ভট, হাস্যকর ও ইজমা বিরোধী কথা।

কারণ ইয়াওমে আরাফা ও ইয়াওমুন নাহরের মাঝে আরেকটি দিনস্বীকার করে নেওয়া ইজমার সরাসরি বিরোধী।

তো এ জাতীয় বিচ্ছিন্ন চিন্তা ও বক্তব্য আরো কিছু ক্ষেত্রেও বিচ্ছিন্নতাকে অনিবার্য করে তুলবে, যা নিয়ে এই সংক্ষিপ্ত পরিসরেআলোচনার অবকাশ নেই।

উল্লেখ্য, যদি শুক্রবার দিন ৯ জিলহজ হয়ে থাকে তবে শুক্রবারকে রোযার জন্য নির্দিষ্ট না করার হাদীসটিও কেউউদ্ধৃত করতে পারেন। সহিহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, বাইতুল্লাহর তাওয়াফকালে হযরত জাবির রা.কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ‘শুক্রবারে রোযা রাখতে কি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন।’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, এই ঘরেরমালিকের কসম!’।

এ হাদিসে শুধু নিষেধের কথা বর্ণিত হয়েছে। তার ক্ষেত্র, পর্যায় ও তাৎপর্য সঠিকভাবে বুঝতে হলে এ হাদীসের অন্যান্য বর্ণনাএবং এ বিষয়ের অন্যান্য হাদীস সামনে রাখতে হবে। কিছু হাদীস লক্ষ্য করুন।

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমরা কেউ জুমুআর দিন রোযা রেখোনা তবে যদি তার আগের বা পরের দিন রোযা রাখো (তাহলে অসুবিধা নেই)।

لا يصم أحدكم يوم الجمعة إلا أن يصوم قبله أو يصوم بعده. رواه البخاري ومسلم واللفظ له.
-সহীহ বুখারি, হাদিস : ১৯৮৫; সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১১৪৪/১৪৭, কিতাবুস সিয়াম।

অন্য বর্ণনায় আবু হুরায়রা রা. থেকে আছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমরা জুমার রাতকেঅন্যান্য রাত থেকে আলাদা করে ইবাদতের জন্য নির্ধারণ করো না। এবং জুমার দিনকে অন্যান্য দিন থেকে আলাদা করে রোযারজন্য নির্ধারণ করো না। তবে তা (জুমার দিন) যদি তোমাদের কারো রোযায় পড়ে যায় তাহলে অসুবিধা নেই।

لا تختصوا ليلة الجمعة بقيام من بين الليالي، ولا تختصوا يوم الجمعة بصيام من بين الأيام، إلا أن يكون في صوم يصومه أحدكم. -সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১১৪৪/১৪৮।

খোদ জাবির রা.-এর হাদীসটির মূল পাঠ, যা নাসায়ীর সুনানে কুবরায় রয়েছে-
محمد بن عباد بن جعفر قال : قلت لجابر : أسمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم ينهى أن يفرد يوم الجمعة بصوم؟ قال : إي ورب الكعبة.

এতে জুমআর দিন রোজা রাখা নয়; বরং শুধু জুমআর দিনকে রোযার জন্য নির্দিষ্ট করে নেওয়াকে নিষেধ করা হয়েছে। (দ্র. আসসুনানুল কুবরা নাসায়ি, হাদিস : ২৭৬০-২৭৬২ ফাতহুল মুলহিম ৩/১৫৪)

এই সকল রেওয়ায়েত ও হাদীসের কারণে সহিহ বুখারির বিখ্যাত ভাষ্যকার ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. বলেন, এসব হাদীসদ্বারা প্রমাণিত হয়, জাবির রা.-এর হাদীসের কোনো বর্ণনায় যে নিষেধ সাধারণভাবে বর্ণিত হয়েছে তা বিশেষ অবস্থার মাঝেসীমাবদ্ধ।

আরো প্রমাণিত হয় যে, যারা জুমার আগের বা পরের দিনও রোযা রাখে, কিংবা জুমার দিনটি পড়ে যায় তার সাধারণ অভ্যাসেররোযার তারিখে, যেমন কারো আইয়ামে বীযের রোযা রাখার অভ্যাস আছে (আর এর কোনো দিন জুমার দিন হল) কিংবা বিশেষকোনো দিবসের যেমন ইয়াওমে আরাফার রোযা রাখার অভ্যাস আছে আর ঐ তারিখটি জুমার দিন হল, তার জন্য এ দিন(আলাদা করেও) রোযা রাখা বৈধ (হারাম নয়)।

তেমনি কেউ মান্নত করল, অমুক যেদিন আসবে কিংবা অমুক যেদিন সুস্থ হবে সেদিন রোযা রাখব আর (ঘটনাক্রমে) দিনটি জুমার দিন হল, তার জন্যও (শুধু) এদিন রোযা রাখা জায়েয।-ফাতহুল বারী ৪/২৭৫(সংক্ষেপিত)।

হাদিস শরিফে জুমার দিনকে রোজার জন্য আর জুমার রাতকে ইবাদতের জন্য নির্ধারণ করতে কেন নিষেধ করা হল-এ বিষয়েআলিমগণ বিভিন্ন তাৎপর্য উল্লেখ করেছেন।

শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রাহ.-এর ভাষায় এর একটি তাৎপর্য হল,শরিয়ত যখন এ দিবসকে বিশেষ কিছু ইবাদতের জন্য নির্ধারণ করেছে এবং এর ফযীলত বর্ণনা করেছে তখন আশঙ্কা ছিলঅতিউৎসাহীরা নিজেদের পক্ষ হতে এদিনের রোযাকেও বাড়িয়ে নিবে।

এই বাড়াবাড়ির পথ বন্ধ করার জন্য এ আদেশ জারিকরা হয়েছে। (এ থেকে জুমার রাতকে ইবাদতের জন্য নির্ধারণ না করার আদেশের তাৎপর্যও বোঝা যায়)। (দ্র. হুজ্জাতুল্লাহিলবালিগাহ; ফতহুল মুলহিম ৩/১৫৫-১৫৬)

পরের আলোচনা থেকে অন্তত এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে যে, ইয়াওমে আরাফা (নয় যিলহজ্বের) রোযার উদ্দেশ্যে যারাএদিন রোযা রেখেছেন তাদের ক্ষেত্রে জুমার দিন রোযা না-রাখার আদেশ সম্বলিত হাদীস প্রয়োগ করার সুযোগ নেই।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ