শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


বিপন্ন মানবতা ও প্রাণশক্তির ঈদ : নতুন পৃথিবীর তাকবীর

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুসা আল হাফিজ, কবি ও গবেষক


মিথ্যার কোলাহল থামিয়ে দাও, হিংসার হলাহল সরিয়ে দাও, ধ্বংসের বিভীষিকা নিভিয়ে দাও, প্রতারক মরীচিকা খেদিয়ে দাও—এখন ঈদের সংগীত শুরু হবে। আমাদের আকাশে চিত্তজয়ের চাঁদ উদিত হচ্ছে। এগিয়ে আসছে জীবনের গতিময় ছন্দধারা, ঈদে শোনা যায় তার হর্ষিত হাসি। ভেঙে যাচ্ছে স্থবিরতার বন্ধ কারা, ঈদে শোনা যায় তার পরাজিত গোঙানি।

ঈদ মানেই নবজীবনের স্পন্দন, সম্প্রীতির বন্ধন। ঈদ মানেই পশুত্বের ক্রন্দন, মানবিক নন্দন। ঈদ মানেই যে শক্তি আত্মাকে মহীয়ান করে, সেই শক্তির পরাক্রম। মানুষের আনন্দ আর পশুত্বের আনন্দের মধ্যে ভেদরেখা টেনে দেয় ঈদ, জাহেলিয়াত আর আসমানী হেদায়েতের পার্থক্য জানিয়ে দেয় ঈদ।  আত্মপূজারি আর স্রষ্টাপূজারির ভিন্নতা জানিয়ে দেয় ঈদ। আত্মপ্রতারক আর জীবনসাধকের স্বাতন্ত্র্য জানিয়ে দেয় ঈদ। ভোগের অন্ধত্ব আর ত্যাগের আনন্দের ভিন্নতা ব্যক্ত করে ঈদ। কিন্তু ঈদকেই তো এখন ভোগের মহোৎসব বানাতে চায় বহুজাতিক স্বার্থপর।

ঈদকেই তো এখন আদর্শবর্জিত বাণিজ্যমেলায় রূপ দেওয়ার তোড়জোড় চালায় পুঁজির খেলোয়াড়। ঈদকেই তো এখন অশ্লীল কামনার আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার ইন্ধন জোগায় মিডিয়ার তস্কর। কিন্তু তবু ঈদ আসে। বিরল আনন্দের সূর্যরশ্মিতে কুসুমেরা হাসে। বৃক্ষের শিরে শিরে ছড়িয়ে পড়ে নতুন চাঁদের পয়গাম। দিগন্তের তীরে তীরে জেগে ওঠে জীবনের সুবাতাস। হর্ষের পাখিরা গেয়ে ফেরে মিলনের সংগীত। ঘরে ঘরে নেমে আসে সুললিত কুহুতান।

পরিশুদ্ধির আবেগে আন্দোলিত হয় চারপাশ। ভ্রাতৃত্বের সুরভিতে মৌ মৌ করে ঈদগাহ। সাম্যের ছবি জাগ্রত হয় অমোঘ স্বপ্নের মতো। পাঁচতলার আয়েশিজন একাকার হয় গাছতলার রিক্তজনের সাথে। যতো গান আছে জীবনে ছড়ানো, যতো প্রীতি আছে হৃদয়ে জড়ানো, যতো গীতি আছে আনন্দ ভরানো, সবই ছলকে ওঠে। ঝলকে উঠে বিদ্যুতের মতো।

ছন্দময় নদীর মতো ভালোবাসা জাগে। আনন্দময় মদির মতো নেচে ওঠে সুন্দরের প্রজাপতি। স্বাচ্ছন্দ্যময় হৃদির মতো প্রস্ফুটিত হয় অনুভাবের নতুন গোলাপ। গোলাপটি প্রত্যেক মুমিনের মনে মনে। তার ছায়ায় লুকিয়ে আছে অজানা এক মায়ার কায়া। হঠাৎ প্রাণের তরঙ্গ তুলে তার চারপাশে জেগে ওঠে উৎসব। কিন্তু তা ক্ষণিকের জন্য। তা সামান্য সময়ের দুর্বার আনন্দমাত্র। সেই আনন্দ জীবনকে করতে পারে না সুরভির গুলশান।

কারণ, ঈদে আমরা পশু কুরবানী করি বটে, কিন্তু মনের পশুটাকে তোয়াজ করতে করতে নিজে পশুর চরিত্র ধারণ করে বসে আছি। আমাদের ঈমান গোটা জীবনকে প্লাবিত করতে পারে না আপন আলোয়। আমাদের সালাত পর্যবসিত হয়েছে নিষ্প্রাণ প্রথায়। আমাদের প্রার্থনা পরিণত হয়েছে ব্যক্তিগত রোদনে। আমাদের নিয়ত পচে যাচ্ছে ফরমালিনের দূষণে।

আমাদের ইবাদত জীবনকে পারছে না পরিশুদ্ধ করতে। ফলে আমদের জায়নামাজের দিকে এগিয়ে আসে কাপালিক। আমাদের মসজিদের খতীব হয়ে যায় মীর জাফরের গোত্রভাই। আমাদের আসমানী কিতাবকে বিদ্রুপ করে আঁধারের বাদুড়। আমাদের প্রিয়তম হাবীবকে অপমান করে আবু লাহাবের প্রেতাত্মা। আমাদের কলিজায় চেপে বসে হিন্দার স্বৈরাচার।

আমাদের শাসনতন্ত্র থেকে নির্বাসিত হয় বিশ্বাসের বরাভয়। আমাদের চারপাশে জিহ্বা ব্যাদান করে লোভার্ত সারমেয়। আমাদের ঐশ্বর্য লুটে নেয়া লুটেরা হার্মাদ। আমাদের চারপাশে দুর্নীতির মচ্ছব। আমাদের জীবনে দারিদ্র্য বুভুক্ষার, তৃষ্ণার, বুকফাটা বেদনার বাঁশরি বাজায়। আমাদের মানচিত্র ভাসছে সান্ত¡নাশূন্য অশ্রু আর প্রতিকারহীন রক্তের তীব্র স্রোতে। আমাদের জীবনকে বানিয়ে দেয়া হচ্ছে বীভৎস বধ্যভূমি। গুম, খুন, অপহরণ আর আইনহীনতা আমাদের প্রহরগুলো করে তুলছে আতঙ্কের ভুতুড়ে রাত। বিদ্বেষের বিষবাষ্পে আমাদের আবহাওয়া হয়ে উঠেছে বিপজ্জনক।

জিঘাংসার তা-বে আমাদের জনপদগুলো হয়ে আছে অস্থির, প্রকম্পিত। প্রতিহিংসা, প্রতিশোধপরায়ণতা, হানাহানি, নিষ্ঠুরতা, নির্মমতার বর্বর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে জাতীয় জীবন। অশ্লীলতার কাছে পরাজিত হচ্ছে শ্লীলতার দাবি। নৈতিকতার চারাবৃক্ষকে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে দানবিক বুলডোজার।

সত্যের ক্রন্দন, সুন্দরের হাহাকার, কল্যাণের গোঙানি, মঙ্গলের বুকচাপড়ানি, শিষ্টাচারের দুর্ভিক্ষ, শ্রেয়বোধের মরণদশা, আইনের নির্বাসন আমাদের বর্তমানকে নিয়ে যাচ্ছে আইয়ামে জাহেলিয়াতের দিকে। অসাম্য ও আত্মপরতা, ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে দাঁড় করিয়েছে বিভেদের প্রাচীর-প্রাকার।

অদ্ভুত এক আঁধার ঢেকে ফেলেছে সারা বিশ্বকে। অন্ধরা এখন পথপ্রদর্শক। যারা মনুষ্যত্বহীন, তারা ঠিকাদার সেজে আছে মানবতার। যারা বিবেকবর্জিত, তারাই বিবেকের বাণী ফেরি করছে চারদিকে। সমস্ত নিষ্ঠুরতা ও পশুত্ব নিয়ে তারা হামলে পড়েছে মানবতার গৌরবের সবগুলো উদ্যানে। জটিলতা ও কুটিলতায় পৃথিবীকে হাঁকিয়ে নিচ্ছে ধ্বংসের কিনারায়।

আজ পৃথিবীতে সবচেয়ে নিপীড়িত তারাই, যারা আল্লাহর অঙ্গীকারের সাথে প্রতারণা করেনি। যারা ঈমানকে বিক্রি করে দেয়নি স্বার্থ ও প্রতিপত্তির কাছে। আজ পৃথিবীতে সবচেয়ে জুলুমের শিকার হচ্ছে সত্য, সবচেয়ে অপবাদের শিকার হচ্ছে সত্যসেবী, সবচেয়ে বেইনসাফির শিকার হচ্ছে ইনসাফের বাণী। আজ পৃথিবীতে যে সুন্দর মানুষকে মানুষ বানায়, সেই সুন্দরকে দাঁড় করানো হয়েছে কাঠগড়ায়। যে জীবনবোধ মানুষকে মানবিক করে, তাকে করা হচ্ছে পরিত্যাগ।

কিন্তু যে অবক্ষয় পশুত্বকে অনিবার্য করে, তাকে জানানো হচ্ছে সমাদর। যে বিশ্বাস জীবনকে ঐশ্বর্য দেয়, তাকে বলা হচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীলতা। যে উন্নাসিকতা জীবনকে দায়িত্বহীন করে, তার মাথায় পরানো হচ্ছে প্রগতিশীলতার মুকুট। সংশয় ও অস্বীকৃতির প্রান্তরে ডেরা গেড়েছে জ্ঞানপাপী।

মিথ্যা ও প্রোপাগান্ডার বেসাতি করছে মিডিয়ার ক্যানভাসার। নাস্তিক্য ও হীনতার ভাগাড়ে ঘুতঘুত করছে পথভ্রষ্ট বুদ্ধিজীবী। আলোকে কালো বলে ঘেউঘেউ করছে অজস্র সারমেয়। সুরের কণ্ঠ চেপে ধরেছে অসুর। সুস্থতার বুকে চেপে বসেছে কদাকার ডাইনোসর। সেই পরিস্থিতিতে ঈদ এসেছে। ঈদ এসেছে যখন শহিদী রক্তে বার বার জনপদ ভিজে গেলেও বিজয়কে আমরা আলিঙ্গন করতে পারছি না।

যখন মিল্লাতের মিলিত তাসবীহকে ছিন্নভিন্ন করে দানাগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিয়ে আমরা ঐক্যের প্রতিপক্ষ হয়ে আছি, তখন ঈদ এসেছে। যখন দ্বীনের দাবিকে পদদলিত করে কামনার দাবিকে আমামা বানিয়ে আমরা লাঞ্ছিত হচ্ছি, তখন ঈদ এসেছে। যখন সাহসের সমুদ্রনাবিক হতে আমরা আগ্রহ হারিয়ে ভীতির গর্তে মুখ লুকিয়ে নিজেদের বাহাদুর ভাবছি, তখন ঈদ এসেছে।

যখন যামানার তুফানকে মোকাবেলার পরিবর্তে চোখ বন্ধ করে বসে বসে ভাবছি, অন্ধ হয়ে থাকলেই প্রলয় বন্ধ হয়ে যাবে, তখন ঈদ এসেছে। যখন ঈদের প্রাণশক্তিকে ধারণ করার বিশালতা হারিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত ক্ষুদ্র হচ্ছি, তখন ঈদ এসেছে। যখন স্বপ্নের চাঁদকে রাতজাগা শকুনেরা ক্ষত-বিক্ষত করছে বাঁকা ঠোঁটে, তখন ঈদ এসেছে।

যখন ইনসানিয়াতের করুণ চিৎকারে বাতাস শিউরে উঠছে, তখন ঈদ এসেছে। যখন হননের রক্তপাতে ভেসে যাচ্ছে উঠান, তখন ঈদ এসেছে। যখন প্রত্যাশার কফিনে সর্বশেষ পেরেক মেরে দেয়া হচ্ছে, তখন ঈদ এসেছে। যখন মানবাধিকারকে লাশে পরিণত করে তার কবর খোঁড়া হচ্ছে মহাউৎসবে, তখন ঈদ এসেছে। যখন আলোর মুখোশ পরে ছদ্মবেশী অন্ধকার দাপিয়ে বেড়াচ্ছে দিকে দিকে, তখন ঈদ এসেছে।

ঈদ বলছে আবাদ করো প্রেমার্ত পূর্ণিমার। ঈদ বলছে পৃথিবীর গোলায় ভরো সূর্যের সোনা-দানা। ঈদ বলছে মানবতার স্বপ্নধোয়া হৃদয়ে হৃদয়ে চাষাবাদ করো অনিবার্ণ আলো। ঈদ বলছে রোদপোড়া প্রান্তরে নিয়ে আসো সবুজের হিল্লোল। যেখানে মৃত্যুর অমানিশা, সেখানে ভোরের মিছিল নিয়ে ঈদের আগমন। যেখানে শকুনি-গৃধিনীর উল্লাস, সেখানে পিউ-পাপিয়ার কুহুতান নিয়ে ঈদের আগমন।

যেখানে পুঁজি ও প্রতিপত্তির শোষণ-চোষণের অবাধ নৃত্য, সেখানে সাম্য ও সমতার তাকবীর হেঁকে ঈদের আগমন। যেখানে হাহাকারে ভরা দরিদ্র-জীবন, সেখানে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের সুদৃঢ় বন্ধন নিয়ে ঈদের আগমন। যেখানে জীবন তিক্ত ও গতিহীন, সেখানে প্রাণে প্রাণে নতুন সাড়া ও বিচিত্র আলোড়ন নিয়ে ঈদের আগমন। যেখানে সাম্রাজ্যবাদের বিষদন্ত ক্ষত-বিক্ষত করছে শান্তির পৃথিবী, সেখানে শান্তি ও সম্প্রীতির জয়নাদ নিয়ে ঈদের আগমন।

যেখানে অসুস্থতা আর বিকারের ম্যানহুলে কিলবিল করে তন্ত্রমন্ত্রের পোকা, সেখানে সুস্থতার বারিধারা নিয়ে ঈদের আগমন। যেখানে ব্যক্তিগত লোভ ও লালসা ইঁদুরের মতো দাঁত উচিয়ে গিলে খাচ্ছে কল্যাণের বীজ, সেখানে পরার্থপরতার পয়গাম নিয়ে ঈদের আগমন। যেখানে আশাহীনতার ধু-ধু মরুভূমি মূক বেদনায় তড়পায়, সেখানে আবে-হায়াতের শরবত ঢেলে ঈদের আগমন।

সমাজের কুঞ্জে-কুলায়, শাখায় শাখায় প্রেমের মঞ্জু সুর জাগিয়ে ঈদের আগমন। এ যেন হাজার রাতের কান্না শেষে দীর্ঘ দিনের তপস্যায় নতুন উষার জাগরণ। এ যেন নার্গিসের শাখায় শাখায় সুরবেহাগে মাতিয়ে তোলা বুলবুলির ঝংকার। যে বুলবুলি মুকুলদের ঘোমটা খুলে গান জুড়ে দিয়ে গুলবাগিচায় বসন্তের মলয়-সমীর নিয়ে আসবে। বসন্ত! হ্যাঁ, তরুর শাখে শাখে পাখি গান গাইবে, কুসুম ফুটবে, হেসে উঠবে গুলিস্তান।

বাসন্তি মেঘ উড়ে উড়ে এসে তাঁবু ফেলবে মাথার ওপর। পাহাড়িকোলের ঝরনা মোহন শিল্পীর মতো মধুর সুর তুলে বইবে। প্রেমের হাটে হাটে বিলানো হবে প্রাণমাতানো শরাব। মিলানো হবে জীবনকে জীবনের সাথে। ঈদ মানেই তো সেই অপূর্ব অমিয় মাহফিল।

কিন্তু না। স্বয়ং ঈদকেই আজ ভোগ ও উপভোগের রগরগে মেলায় পরিণত করার উদ্ধসঢ়;যোগ শুরু হয়েছে। স্বয়ং ঈদকেই আজ অশ্লীলতা ও রতিচর্চার উপলক্ষ বানানোর তোড়জোড় চলছে। ঈদ তাই শুধু ফুলের সুবাস নিয়ে বিকশিত হচ্ছে না; বরং প্রচ- দাহনে সংক্ষুব্ধ। ঈদ তাই সরব ও সচকিত। ঈদ আহ্বান করছে, পবিত্রতার সৈনিকেরা জাগো এবং রুখে দাঁড়াও।

জীবনের প্রতিটি অলি-গলিতে তাকবীর ধ্বনির মতো ছড়িয়ে পড়ছে ঈদের আহ্বান। যখন কল্যাণকে গুদামজাত করে লাভের আশায় পচিয়ে দেয়া হচ্ছে, তখন ঈদ বলছে তাকে বাতাসের মতো ছড়িয়ে দিন। যখন স্যাঁতসেঁতে নির্জনতা আর কুয়াশার প্রতারণাকে আপনার করে নিচ্ছে আলোর প্রহরীরা, তখন ঈদ জীবনে জাগাতে চায় বারুদের উত্তাপ ও সূর্যের প্রচ-তা। যখন পবিত্রতাকে ভেজালে কলুষিত করা হচ্ছে, তখন ঈদ দিচ্ছে পরিশুদ্ধির পুকুরে গোসলের আহ্বান।  ঈদ বলছে এক হাতে আল্লাহর রজ্জু, আরেক হাতে মানবিক সত্তার নির্যাস নিয়ে সারা দুনিয়াকে প্রেমের ঈদগাহ বানিয়ে দাও।

ঈদ বলছে তোমাদের পদ ও প্রত্যয় এঁকে দাও মহাকালের পাতায়। সৃজনের সংগীত বাজিয়ে দাও চরণে চরণে। নিশ্বাসে নিশ্বাসে ছড়াও বিশ্বাসের সুবাস। স্পন্দনে স্পন্দনে জাগাও সামর্থ্যের তাকবীর। দু-চোখকে ছড়িয়ে দাও সত্যের সীমান্ত পাহারায়। দিনরাত জেগে জেগে হয়ে উঠো সূর্যের হৃদপি-। ঈদ বলছে ঐক্যের মোতির মালা গড়ে এগিয়ে চলো মঞ্জিলের পানে। সে মঞ্জিল কোথায়? হ্যাঁ, সে মঞ্জিলের পথ সুদূর।

গ্রহ-তারা সেই যাত্রাপথের ধূলিকণা ছাড়া কিছু নয়। তোমাদের বিশালতা মন্দ্রিত করো ঈমান ও ইহসানে। তোমাদের মহিমা ঝংকৃত করো পবিত্রতার কুরবানীতে। ইব্রাহীমী আত্মত্যাগ ও ইসমাঈলী আনুগত্যকে ধারণ করতে পারলে তোমাদের উচ্চতা হবে লওহে মাহফুজের সমান।

সালাত ও সিয়ামের একাগ্রতাকে জীবনযাত্রায় প্রতিস্থাপিত করো। প্রিয় মালের ভালোবাসা যেভাবে যাকাত ও সদকায় বাধা দিতে পারেনি, সেভাবে স্বার্থের উসকানি যেন মানবকল্যাণ থেকে তোমাকে বিরত না রাখে। সে শিক্ষা না নিলে তোমার ঈদোৎসব ও ঈদগাহে আগমন নিছক বিলাসিতা। তা থেকে যদি মুক্তি হতে পারো, ঈদের তাৎপর্যকে যদি জীবনে প্রতিফলিত করতে পারো, তাহলে তোমাদের বুকে বইবে সেই সীমাহীন পৃথিবীর রোদ, যেখানে নীলিমায় বেজে ওঠে হুরীদের কলরোল।

তোমাদের শব্দে জাগাও নববী বিদ্যুৎ, যার স্পর্শে প্রাণ পাবে পৃথিবীর সর্বশেষ আশ্রয়ের আশা। তোমাদের শস্যক্ষেত্রে ফলাও আত্মার সুষমা, যেখানে গচ্ছিত আছে জীবনের আমানত। ঈদ বলছে ঈদগাহ থেকে শুরু করো সেই অভিযাত্রা, যা পৃথিবীকে নারকীয় পরিণতি থেকে টেনে নেবে উদ্ভাসিত ফেরদাউসের দরজায়।

যতো অসুস্থতা জেঁকে বসেছে, যতো পশুত্ব কুর্দন করছে, যতো অশ্লীলতা বেসামাল হয়েছে, যতো স্বেচ্ছাচার আস্ফালন করছে, যতো নীতিহীনতা দাপট দেখাচ্ছে সকল কিছুর কবর রচনা করবে প্রেম ও বিশ্বাসের এই কাফেলা। যাদের শক্তি নিহিত আছে খোদায়ী অনুগ্রহে। যাদের অস্তিত্বে বিরাজ করে আল্লাহর অভয়। যাদের শোণিতে প্রবাহিত শাহাদাতের তৃষ্ণা। যাদের পাঁজরে পাঁজরে খালিদের দৃঢ়তা জমে আছে। যাদের সমগ্র সত্তায় অপার্থিব বিদ্যুৎ, যার রহস্য ও শক্তির কথা কল্পনাও করতে পারে না অন্ধ, খর্ব বা বিকারগ্রস্ত কেউ। এই কাফেলার বন্ধু তাই জলচর, স্থলচর তাবৎ প্রাণীকুল। এই কাফেলার শিকড় তাই নিখিলের সমস্ত সত্তায়। সমুদ্রের মৎস কিংবা গর্তের পিপীলিকা সকলেই এ কাফেলার সুভার্থী- স্বজন।

কে আমাদের ভয় দেখাতে চায়? কে বলে উচ্ছেদ করবে আমাদের সমূলে? সে উন্মাদ। গোটা মানবতার ভিত্তিমূলকে চ্যালেঞ্জ করছে। কোনো উন্মাদের প্রলাপ শোনা আমাদের কাজ নয়। আমাদের অস্তিত্বে নিখিল মানবতা, আমাদের চেতনায় তাবৎ সৃষ্টির আত্মীয়তা, আমাদের অঙ্গীকারে গোটা জাহানের আমানত, আমাদের দায়িত্ব তাই জগতের খেলাফত। সূর্যের পক্ষ থেকে ধ্বনিত হচ্ছে সালাম। সমুদ্রের পক্ষ থেকে উচ্ছল অভিবাদন।

বর্বরতার তিমির, মুন্ডুখসা লাশের বিষাদ আর বিপর্যয়ের পাথরচাপা থেকে পৃথিবীতে আসমানী হেদায়েতের বাসন্তী উদ্যান নিয়ে যাওয়া জিম্মা আমাদের। দ্যাখো, ডানে হায়েনা, বামে ড্রাগন, পেছনে নেকড়ে এবং সামনে গোখরোর ফণা, তবুও কি একটি বারের জন্য আমরা থেমেছি? আমাদের যাত্রা শুরু জীবনের উদ্বোধন থেকে। আর আজকের অভিযাত্রায় মানুষের মহিমার উজ্জ্বল মিনারে খাইরুল কুরুনের আযান হাঁকার আগে আমরা বিরতির কোনো নিশ্বাস নেব না।

লেখক: কবি ও গবেষক 

আরএম/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ