আওয়ার ইসলাম: কুরবানি একটি ইবাদত এবং তা ইসলামের অন্যতম নিদর্শন। ইসলামী আদর্শের ইবাদত অংশটিও অতি মহিমান্বিত এবং বৈশিষ্টপূর্ণ। এর প্রধান দুটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাওহিদ ও সুন্নাহ। ইসলামের ইবাদত ও উপাসনা একমাত্র আল্লাহর জন্য। তিনি ছাড়া আর কেউ ইবাদতের উপযুক্ত নয়। তেমনি ইবাদতের নিয়ম-নীতিও সুন্নাহ কর্তৃক নির্ধারিত। সুন্নাহ পরিপন্থী কোনো ইবাদত আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
কুরআনে বিভিন্ন জায়গায় কুরবানির বিধান রয়েছে। সুরা বাকারা: ১৯৬; সুরা মায়েদা: ২, ৯৫; সুরা আনআম: ১৬২; সুরা হজ: ২৭-৩৭ ও সুরা কাউসার। তার মধ্যে সুরাতুল আন’আম ও সুরাতুল কাউসারে সাধারণ কুরবানি আর অন্যান্য সুরায় হজের কুরবানির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
শরিকে কুরবানি: সামর্থ্যবান ব্যক্তির পক্ষে একা কুরবানি করা বিভিন্ন কারণে উত্তম। তবে শরিকে কুরবানির বিধান উম্মতকে দিয়েছে অবকাশ ও প্রশস্ততা। এ প্রশস্ততা আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ এ স্পষ্টভাবে রয়েছে।
জাবির ইবনে আবদুুল্লাহ রা. বলেন, আমরা হজের ইহরাম বেঁধে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে বের হলাম। তিনি আমাদের আদেশ করলেন যেন প্রতিটি উট ও গরু সাতজন করে শরিক হয়ে কুরবানি করি। সহীহ মুসলিম শরীফ: ১/৪২৪।
অন্য বর্ণনায় আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, (একটি) গরু সাতজনের পক্ষ থেকে এবং (একটি) উট সাতজনের পক্ষ হতে (কুরবানি করা যায়)। সুনানে আবু দাউদ: ২/৩৮৮।
এ বিষয়ে ফকিহগণের ফতোওয়া: ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহ. ও ইমাম শাফিঈ রহ. এ বিষয়ে মাসয়ালা দিয়েছেন, সাতজনের পক্ষ হতে একটি গরু অথবা একটি উট কুরবানি করা জায়েজ। সূত্র: যাদুল মা’আদ, ইমাম ইবনিল কাইয়িম আল-জাওঝী হাম্বলী রহ.; তাহকিক: শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহহাব হাম্বলী রহ.; পৃষ্ঠা ১২১।
মুয়াফফাকুদ দ্বীন ইমাম ইবনুল কুদামা মাকদিসী রহ. তার ‘উমদাতুল ফিকহ’ কিতাবেও অনুরূপ মাসআলা উল্লেখ করেছেন, সাতজনের পক্ষ হতে একটি গরু অথবা একটি উট কুরবানী করা জায়েজ রয়েছে। হাতিম আল হাজ এ কিতাবের শারহে সহীহ মুসলিমের উপরে বর্ণিত হাদিসটি উল্লেখ করেছেন। সূত্র: উমদাতুল ফিকহ, ব্যাখ্যামূলকগ্রন্থ: হাতিম আল হাজ; ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৩৮।
আলেম ও ফকিহগণ শরিকে কুরবানি সংক্রান্ত হাদিসের ব্যাপারে বুঝেছেন, শুধু সফর নয়, বরং সর্বাবস্থায় ৭ জন মিলে একটি গরু বা উট কুরবানী দিতে পারেন। এ সংক্রান্ত মাসয়ালায় তারা মোটেও সফরের কথা উল্লেখ করেননি।
তবে শরিক নির্বাচনে সতর্কতা কাম্য। আল্লাহর কাছে কুরবানি কবুল হওয়ার অন্যতম শর্ত হলো হালাল উপার্জন দ্বারা কুরবানি করা। হাদিসে আছে, নিশ্চয় আল্লাহ পবিত্র আর তিনি শুধু পবিত্র বস্তুই গ্রহণ করে থাকেন। সহীহ মুসলিম: ১০১৫।
তেমনি কুরবানি হতে হবে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য ও সন্তুষ্টির জন্য। হাদিস শরীফে বলা হয়েছে, সকল আমল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। সহীহ বুখারী: ১।
যেহেতু সব শরিকের পক্ষ থেকে একটি পশু জবেহ করা হচ্ছে তাই সবার নিয়ত ও উপার্জন শুদ্ধ হওয়া জরুরি। ফকিহদের মতে, কোনো শরিকের পুরা বা অধিকাংশ উপার্জন হারাম হলে কিংবা কেউ শুধু গোশত খাওয়ার উদ্দেশ্যে শরিক হলে কারো কুরবানি সহীহ হবে না। সূত্র: ফাতাওয়ায়ে তাতারখানিয়া ৩/৩৪৯, ৪০০; আলমগিরি ৫/৩৪২; আহসানুল ফাতাওয়া ৭/৫০৩।
কুরবানির সাথে আকিকা: অনেকে কুরবানির সঙ্গে আকিকাও দিতে চান। তবে বিজ্ঞ ফুকাহায়ে কেরাম বিষয়টিকে উৎসাহিত করেননি। কুরবানি ও আকিকা আলাদাভাবেই করা উচিত। তবে কেউ একত্রে করলে কুরবানি ও আকিকা দুটোই আদায় হবে। কারণ আকিকাও এক ধরনের কুরবানি। হাদীস শরীফে আকিকাকেও বলা হয়েছে ‘নুসুক’, যার অর্থ কুরবানি। সূত্র: আল-মুসান্নাফ, আব্দুর রাযযাক: ৭৯৬১; আলমুসনাদ, ইমাম আহমদ: ৬৭১৩, ৬৭২২; আসসুনান, আবু দাউদ (আকিকা অধ্যায়): ২৮৪২; আসসুনান, নাসাই: ৭/১৬২, ১৬৩।
আকিকাতেও পশু জবাইয়ের উদ্দেশ্য আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি। তাছাড়া মৌলিকভাবে এক হওয়ার কারণে আকিকার অনেক বিধান নেয়া হয়েছে কুরবানির হাদিস থেকে। সুতরাং উট ও গরু দ্বারা একাধিক ব্যক্তির কোরবানি আদায় হওয়ার হাদিসগুলোর অন্তর্নিহিত যুক্তি ও ব্যাপকতা কোরবানি ও আকিকা একত্রে আদায়ের অবকাশকেও ধারণ করে।
তাছাড়া বিভিন্ন জনের বিভিন্ন ‘প্রকারের’ কুরবানি যে এক পশু দ্বারা আদায় হতে পারে তা স্পষ্টভাবেই বলেছেন বিখ্যাত তাবেয়ী ইমাম আতা ইবনে আবি রাবাহ রহ.। তিনি বলেছেন, উট ও গরু সাতজনের পক্ষ হতে কুরবানি হতে পারে। আর এতে শরিক হতে পারে কুরবানিকারী, তামাত্তু হজকারী এবং হজের ইহরাম গ্রহণের পর হজ আদায়ে অপারগ ব্যক্তি। সূত্র: সুনানে সায়ীদ ইবনে মানসুর-আল কিরা লি-কাসিদি উম্মিল কুরা পৃ. ৫৭৩।
-এএ