সুলতান মাহমুদ বিন সিরাজ ♦
মহান আল্লাহ তায়ালার রাস্তায় সবকিছু বিসর্জন দেয়ার এক আহ্বান নিয়ে প্রতি বছর আমাদের মাঝে হাজির হয় পবিত্র ঈদুল আজহা। মানব সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে কুরবানির রেওয়াজ চলে আসছে। হযরত আদম আলাইহিস সালাম-এর দু’সন্তান হাবিল ও কাবিল কুরবানি করেছিলেন।
হাবিল ঐকান্তিক আগ্রহ ও নিষ্ঠার সাথে উৎকৃষ্ট জিনিস কুরবানি করলে তা আল্লাহর দরবারে গৃহীত হয়। পক্ষান্তরে কাবিল অনাগ্রহ ও নিকৃষ্ট জিনিস উৎসর্গ করলে তা প্রত্যাখ্যাত হয়। কুরবানি মানব সমাজে সবসময়ই কোন না কোনভাবে চালু ছিল।
বর্তমান মুসলিম সমাজে চালুকৃত কুরবানি মূলত হযরত ইবরাহীম আলাইহি সালাম ও তাঁর পরিবারের চরম আত্মত্যাগের স্মরণ হিসেবেই চলে আসছে।
কুরবানি ইতিহাস কারোই অজানা নয়। একবার নিজেকে প্রশ্ন করি, কেন আল্লাহ তায়ালা ইবরাহিম আ. কে নিজ সন্তানকে আল্লাহর নামে কুরবানি করার হুকুম দিলেন? আবার কেনই বা ইসমাঈল আলাইহি সালাম-এর পরিবর্তে বেহেশত থেকে দুম্বা এনে তা জবেহ করালেন? উত্তরটা সহজ।
প্রথমত, দুনিয়ার নিয়মে যেমন সনদ দেয়ার আগে পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্যতা যাচাই করে নেওয়া হয়, তেমনি খলিলুল্লাহ বা আল্লাহর বন্ধু উপাধি দেওয়ার আগে আল্লাহ হযরত ইবরাহিম আ.এর ও একটা কঠিন পরীক্ষা নিলেন।
আর পুত্রের বদলে দুম্বা কুরবানি করিয়ে আল্লাহ তার পরবর্তী বান্দাদেরও এই বিশাল পরীক্ষায় অংশগ্রহনের সাওয়াব দান ও রাহে খলিলুল্লাহ-এ চলার আসান ব্যবস্থা করে দিলেন। সুতরাং, কুরবানির তাৎপর্য বর্ণনা করতে আর শব্দ খরচ করার প্রয়োজন পড়ে না।
আল্লাহ পাক বলেন,এগুলোর রক্ত ও গোশত আল্লাহর কাছে পৌছে না, পৌছে তোমাদের তাকওয়া। (সূরা হজ্জ-৩৭)
আল্লাহ সামর্থ্যবান মুসলমানদের ওপর কুরবানি ওয়াজিব করেছেন। তবে আমরা যদি কুরবানি বলতে শুধু পশু-জবাই বুঝি, তাহলে ভুল করবো। কুরবানি শুধুই পশু জবাই নয়। ইসলামের অন্যান্য ইবাদতের মত কুরবানির মধ্যেও রয়েছে অনেক শিক্ষা। ফলে যেমন আমরা পশু-কুরবানি করার প্রতি গুরুত্ব দেই, তেমনি আমাদের কোরবানির শিক্ষার প্রতিও মনোযোগ দিতে হবে।
কুরবানির নানা শিক্ষা ও তাৎপর্য রয়েছে, অল্পসময়ে, অপ্রাতিষ্ঠানিক আলোচনায় সামগ্রিক ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। আমরা কোরআনের উল্লিখিত দুই আয়াতের আলোকে সংক্ষিপ্ত আলোকপাতের চেষ্টা করবো।
এক. কুরবানি আমাদের ত্যাগ ও উৎসর্গ শিক্ষা দেয়। আমাদের উপর ইসলামের যে বিধানই আবশ্যক হোক, আমাদের পালন করতে হবে। আল্লাহর রাজি-খুশির জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা চালাতে হবে।
দুই. কুরবানি আমাদেরকে এছলাহে নিয়ত ও তাকওয়া শিক্ষা দেয়। আসলে নিয়ত ছাড়া সবকিছুই ভালো-খারাপ হতে পারে। নিয়তের গুণেই কাজ ভালো বা খারাপ হয়। আপনি অনেক টাকা দান করলেন, মাদরাসা বানালেন বা শহীদ হলেন, যদি আপনার এর দ্বারা দুনিয়াবি উদ্দেশ্য থাকে তাহলে এগুলো ভালো কাজ হিসেবে গণ্য হবেনা।
তিন. কুরবানি আমাদেরকে সাম্য,সামাজিকতা ও আলাপ-আলোচনা করতে শিক্ষা দেয়। আসলে আমরা যেমন বলেছি, ইসলাম ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, তো, ইসলাম কীভাবে সমাজ পরিচালনা করতে চায়? সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে ইসলাম সাম্য, সামাজিকতা ও আলাপ-আলোচনার গুরুত্ব দেয়।
দুনিয়ার সামান্য জীবনের বিনিময়ে আখিরাতে অনন্তকালের জান্নাতি সুখ অবশ্যই ত্যাগ ও কুরবানির বিনিময়েই অর্জন করতে হবে। বান্দাহর পরীক্ষা গ্রহণ আল্লাহর এক স্থায়ী নিয়ম। তাঁর ভাষায় ‘আমরা অবশ্যই তোমাদেরকে ভয়-ভীতি, অনশন, জানমালের ক্ষতি ও আমদানি হ্রাসের দ্বারা পরীক্ষা করবো।
বিপদ-মুছিবত উপস্থিত হলে যারা ধৈর্য ধারণ করে ও বলে যে, আমরা আল্লাহরই জন্য এবং তাঁর কাছেই ফিরে যাব। তাদের জন্য সুসংবাদ’ (বাকারা ১৫৫-১৫৬)
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজকের সমাজে কুরবানির মতো মহান ইবাদতকে আভিজাত্য প্রকাশের উপায় বানানো হচ্ছে। কুরবানির পশু কেনা নিয়ে চলে প্রকাশ্য প্রতিযোগিতা।
যখন আল্লাহ বান্দাকে জিজ্ঞেস করবে, তোমাকে কি কুরবানির বিধান এজন্যে দেওয়া হয়েছিলো যে, তুমি তোমার আভিজাত্য অন্যকে প্রদর্শন করো, তখন বান্দা কি উত্তর দিবে?
সূরা আন-আমের ১৬২নং আয়াতে আল্লাহ ইরশাদ করেন ‘বলুন (হে নবি সা., আমার সালাত, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু শুধুমাত্র বিশ্ব জগতের প্রতিপালক মহান রব্বুল আলামিনের জন্যেই।’
আমাদের প্রত্যেকের জীবনে এ শ্বাশত আয়াতের তাৎপর্য বাস্তবায়ন হোক, কুরবানির শিক্ষা আমাদের আলোকিত করুক। দুআ কবুলের জন্যে সর্বোত্তম এ মাসে এটা আমাদের দুআ, আমিন।
-এটি