তানভীর সিরাজ ♦
জিলহজের প্রথম দশরজনীতে বিভিন্ন আমলের কথা আমরা শুনি। উলামা, ফুকাহা আর মুহাদ্দিসগণ এ আমলগুলো হাদিস থেকে বর্ণনা করেছেন। আমল যেহেতু আমাদের উদ্দেশ্য তাই ভূমিকা লম্বা না করে কেবল আমলসমূহের আলোচনায় চলে যাচ্ছি।
চাঁদ দেখা
যিলহজ্জের চাঁদ উঠছে কিনা সতর্ক থাকা। কারণ এ চাঁদ উঠা না উঠার ওপর ভিত্তি করে শরিয়তের গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়। সঠিক সময়ে চাঁদ দেখতে যদি অবহেলা করা হয় তা হলে হজ, রোজা আর কুরবানি ইত্যাদি আমল একদিন আগেপরে হয়ে যাবে। তাই অনেক আলেম চাঁদ দেখাকে ওয়াজিব বা আবশ্যক বলেছেন।
চাঁদ দেখে দেখে আমরা যে দোয়া পড়ব। ‘হে আল্লাহ্! আপনি এ চাঁদ আমাদের ওপর উদিত করুন কল্যাণ ও ঈমানের সঙ্গে এবং নিরাপত্তা ও ইসলামের সঙ্গে। আমার প্রতিপালক ( হে নতুন চাঁদ!) তোমার প্রতিপালক আল্লাহ। তিরমিজি: ৩৪৫১।
হজ আদায় করা
যাদের উপর হজ ফরজ হয়েছে তারা ফরজ হজ আদায় করবো। আর এটিই হল জিলহজের প্রথম দশ দিনের শ্রেষ্ঠ আমল। আল্লাহ্ যাকে তাওফিক দান করেছেন সুতরাং সে হজ আদায় করে নিবে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, আর (হে ইবরাহিম) মানুষের মাঝে আপনি হজের ঘোষণা দিন, যাতে তারা আসে পায়ে হেঁটে এবং প্রত্যেক বাহনে করে, যেগুলি আসবে প্রত্যেক দূর-দূরান্তের পথ হতে, যাতে তারা উপস্থিত হতে পারে তাদের উপকারলাভের বিভিন্ন স্থানে। (সূরাতুল হজ্ব-২৭-২৮)
এরশাদ হয়েছে মানুষের মধ্যে যারা সেখানে পৌঁছার সামর্থ্য রাখে তাদের উপর আল্লাহর জন্য এ ঘরের হজ করা ফরজ। কেউ এটা অস্বীকার করলে আল্লাহ তো বিশ্ব জগতের সমস্ত মানুষ হতে বেনিয়ায। (সূরা আলি ইমরান-৯৭)
আর হজের ফজিলত হিসেবে রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- বলেছেন, যে ব্যক্তি হজ করল, আর (তাতে) কোনোরূপ অশ্লীলতা করল না ( অর্থাৎ কোনো অশ্লীল কাজ করল না, অশ্লীল কথা বলল না) এবং কোনো পাপাচার করল না সে ঐ দিনের মত (নিষ্পাপ অবস্থায়) ফিরবে যেদিন তার মা তাকে জন্মদান করেছেন। (বুখারি, ১৫২১, মুসলিম, ১৩৫০)
তিনি আরও বলেছেন- ‘তোমরা বারবার হজ্ব ও উমরা আদায় কর, কারণ কর্মকারের ও স্বর্ণকারের আগুন যেমন লোহা ও সোনা-রূপার ময়লা মুছে ফেলে তেমনিভাবে এ দুই ইবাদত দারিদ্র্য ও পাপ মুছে ফেলে। আর পুণ্যময়-পরোপকারময় হজ্বের একমাত্র পুরস্কার হলো জান্নাত। তিরমিজি, আস-সুনান ৩/১৭৫, ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ২/৯৬৪, নাসাঈ, আস-সুনান ৫/১১৫, ইবনু খুযাইমা, আস-সহীহ ৪/১৩০।
চুল, নখ ইত্যাদি পশম কাটাছাটা
জিলহজ মাসের আরেকটি মুস্তাহাবি আমল হল, চাঁদ উঠার আগে নখ, চুল আর পশমাদি কাটাছাটার প্রয়োজন হলে কেটেছেটে ফেলা এবং কুরবানির দিন পশুর গলায় ছুরি দেয়ার আগ পর্যন্ত এসবে হাত না দেয়া।
এতে করে উক্ত আমলকারী কুরবানি করার ছুয়াব পায়। সুতরাং যারা কুরবানি করলনা তারা কুরবানি করার নেকি পাইল আর যারা কুরবানি করল, তারা কুরবানির দ্বিগুণ নেকি পাইল। তবে সামর্থ্যবান ব্যক্তি যদি কুরবানি না করে ওয়াজিব তরকের গুনাহ হবে।
সতর্কতা: বগল আর নাভির নিচের কেশ যদি কাটতে ছাটতে ৪০ দিনের বেশি দেরি হলে বা আপনি ভুলে গেলেন কাটতে, আবার এদিকে কুরবানির চাঁদ উদয় হয়ে গেছে। এমন যদি হয় তাহলে চাঁদ উদয় হলেও আপনি যা কাটার তা কাটতে ছাটতে পারবেন।
নারী পুরুষের অভিন্ন হুকুম। কারণ ৪০ দিনের বেশি হয়ে গেলে নামায ইত্যাদি মাকরূহে তাহরিমী হয়। যা পূর্বেকার মুস্তাহাবি আমলের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
প্রতি রাতই শবেকদর
সহজভাষায় বলি, যিলহজ্বের প্রথম দশ রজনী প্রত্যেকটি এক এক শবেকদর সম। আল্লাহ্ বলেন,‘বান্দা আমার রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না’ কারণ আমার রাগের উপর দয়ার প্রাচীর।
তাই বলি, আমরা না হয় আমাদের অপরাধের কারণে একটি লাইলাতুলকদর হারিয়েছি, কিন্তু পেয়েগেছি সুনিশ্চিত আরও দশ লাইলাতুলকদর আর তা হল, যিলহজ্জের প্রথম দশরজনী। আলহামদুলিল্লাহ্। এরশাদ হয়েছে- আশেকে রাসুল আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- বলেছেন, এমন কোনো দিন নেই যাতে ইবাদত বন্দেগী আল্লাহ্র কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয়, আছে, তবে তা হলো যিলহজ্বের প্রথম দশদিন।
যার প্রত্যেকদিনের রোযা এক এক বছর (নফল) রোযা সমতুল্য আর এক একটি রাত লাইলাতুলকদর সমপরিমাণ নেকি! খাদেমুর রাসূল আনাস র. থেকে বর্ণিত আছে যে, যিলহজ্বের প্রতিটি দিন একহাজার দিনের সমতুল্য আর আরাফার দিন একদিনই দশহাজার দিনের সমতুল্য। (বাইহাকি, লাওয়াকিহুল আনওয়ার : ৯২, ফাহমুল মুরাম শারহে ফায়যুল কালাম: ২৯৭, তিরমিজি, ইবনে মাজা, মিশকাত)
জিলহজের ৯ রোজা
রাসুুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর কোনো এক আহলিয়া বলেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- জিলহজের ৯ রোযা, আশুরার রোজা আর প্রত্যেক মাসে তিনটি করে রোযা করতেন। ইমাম আহমদ, আবু দাউদ ও ইমাম নাসায়িসহ অনেকে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। বিশ্ববিখ্যাত হাদিস ব্যাখ্যাকার ইমান নববি রহ. ৯ রোজার কথা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, তা কঠিন মুস্তাহাব, অসাধারণ মুস্তাহাব।
নাসায়ি শরিফের এক হাদিসে এসেছে রোজা ঢাল সরূপ। যা মানুষকে পরনিন্দা, গীবত ও মিথ্যাচার থেকে রক্ষা করে। শয়তানের কুমন্ত্রণা আর জাহান্নামের আগুন থেকেও বাঁচিয়ে রাখে। একইভাবে ব্যাখ্যা করেছেন শায়খুল হাদিস আল্লামা যাকারিয়া কান্দলবি রহ.।
আরাফার দিনে বিশেষ রোজা
খাদেমুর রাসুল আনাস র. থেকে বর্ণিত আছে যে, জিলহজের প্রতিটি দিন একহাজার দিনের সমতুল্য আর আরাফার দিন একদিনই দশহাজার দিনের সমতুল্য। (বাইহাকি, লাওয়াকিহুল আনওয়ার : ৯২, ফাহমুল মুরাম শারহে ফাইযুল কালাম : ২৯৭।)
সহিহ মুসলিমের প্রসিদ্ধ একহাদিসে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- বলেছেন, আরাফাতের দিনে (চাঁদ দেখা হিসেবে ৯ তারিখ) জিলহজের রোজা রাখার ব্যাপারে আমি ধারণা করি যে, আল্লাহ তায়ালা রোজাদারের একবছর আগের ও পরের (ছোট) গুনা ক্ষমা করে দিবেন।
তাকবিরে তাশরিক
তাকবিরে তাশরিক হল, যে তাকবির জিলহজের ৯ তারিখ ফজর থেকে ১৩ তারিখ আছর পর্যন্ত পড়া হয়। যে কারণে এই দিনগুলোকে আইয়্যামে তাশরিক বা তাশরিকের দিন বলা হয়। দিন হিসেবে পাঁচদিন হয়।
পুরুষদের পড়তে হয় বড় আওয়াজে আর মহিলাদের পড়তে হয় ছোট আওয়াজে। তাকবীর যদিও ওয়াজিব কিন্তু, মহিলাদের আওয়াজ ছতর হিসেবে ছোট আওয়াজে পড়াই বাঞ্ছনীয়।
এই তাসবীহ কেবল একবার পড়া ওয়াজিব, তিনবার পড়া ওয়াজিব নয়।
এ মর্মে হযরত আলী ও আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস র. থেকে বর্ণিত আছে যে, আরফার দিন ফজর থেকে তের তারিখ আছর পর্যন্ত। (অর্থাৎ কুরবানিত ৩য় দিন আছর পর্যন্ত।)
তাকবিরে তাশরিক নিচে দেয়া হল।
হযরত ওমর ও আবদুল্লাহ বিন মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত তাকবিরে তাশরিক এই,
আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়াল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর, ওলিল্লাহিল হামদ।
জিকির: আমরা একটি কথা বারবার শুনে থাকি। ভাই, যিকিরে ফিকিরে চলি। আসলে কথাটি ছোট বড় সবার জীবনে বেশ রেখাপাত করে। এবং সুন্দর জিন্দেগীর জন্যও বেশ দরকারি।
ঈদের রাতে ইবাদতে রাত জাগা
দীনে ইসলামের বড় বড় পাঁচরাতের মধ্যে দুই ঈদের রাত অন্যতম। সামনে আসছে কুরবানির ঈদ। দিনের বেলা আমরা গরুছাগল আল্লাহ্র ওয়াস্তে কুরবানি দিবো, এ তো তার ঠিক আগের রাতটি ঈদের রাত,আর তা দেবো আল্লাহকে। ওলামারা বলেন, মাগরিব, এশা আর ফজর যদি অন্তত জামাতের সাথে পড়ি তাহলেও আমরা সেই ফযিলত পেরে পারি।
হাদিসে আছে এই দুইরাতকে যে ব্যক্তি জীবিত রাখবেন, কিয়ামত দিবসে তাকে আল্লাহ্ তাকে জীবিত রাখবে। হতে পারে মাফ করে দিবেন বা তার প্রতি বিশেষ রহমত করবেন ইত্যাদি। কারণ আনন্দঘন রাতে সে যেমন আল্লাহকে ভুলেনি, আল্লাহ কি করে কঠিন মুহূর্তে তার প্রিয় বান্দাকে ভুলবেন! সুবহানআল্লাহ।
কুরবানি করা
কুরবানির দিন ফরজ ইবাদতের পর কুরবানি করা হল সবচে’ বড় ইবাদত এবং আল্লাহ্র কাছে অনেক বেশি প্রিয়।
আম্মাজান আয়েশা র. থেকে বর্ণিত আছে যে, নবী কারীম সা. বলেছেন, ঈদুল আজহার দিন কুরবানির চে’ আল্লাহর কাছে বনি আদমের আর কোন আমল এত অধিক প্রিয় নয়। কিয়ামত দিবসে তার শিং, পশম আর নক ইত্যাদি কোলে করে নিয়ে হাযির হবেন কুরবানি করেছেন যে ব্যক্তি, আর নিশ্চয় কুরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহর দরবারে কুরবানি করাটা কবুল হয়ে যায়, সুতরাং খুশি মনে (আল্লাহ্ ওয়াস্তে) কুরবানি করো। -তিরমিজি, ইবনে মাজা,মিশকাত :১২৮, ফায়যুল কালাম ২৯৬ পৃ।
তাই আসুন, আমরা আল্লাহ্র জন্য নেক আমল করি। সুনামের জন্য যদি করি তাহলে মহাপ্রলয়ে আল্লাহ্ সুন্দর প্রতিদান দিবেন না। তাই ষোলআনা যেন আল্লাহর জন্য হয়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাওফিক দান করেন। আমিন।
লেখক: ফাযেলে দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী
-এটি