মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন । ।
তখন ফরিদাবাদ মাদরাসায় শরহে বেকায়া জামাতে পড়ি। আমার একটা অভ্যাস ছিল কিতাবে যা পড়েছি তা নিজের মতো করে বোঝা এবং লেখা। নুরুল আনওয়ার কিতাবে যেখানে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বের বর্ণনা করা হয়েছে সেই বিষয়টি আমি আমার মতো করে কয়েক পৃষ্ঠায় লিখলাম। আমাদের উস্তাদ ছিলেন বিশিষ্ট লেখক মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সাহেব। তিনি আমাদেরকে মাকামাতে হারিরি কিতাবটি পড়াতেন।
আরবি সাহিত্যের এই কিতাবটি তিনি উর্দুতেই পড়াতেন, তবে মাঝে মাঝে অনেক কঠিন কঠিন বাংলা শব্দ বলতেন। সেই শব্দগুলো আমরা খাতায় লিখে মুখস্থ করতাম। আমার সেই হুজুরকে লেখাটি দেখালাম। তিনি খুব খুশি হলেন। বললেন, তোকে মাওলানা মুহিউদ্দীন খান সাহেবের কাছে নিয়ে যাবো একদিন। যারা হুজুরকে চিনেন তারা জানেন, এই বিষয়টি হুজুরের স্বভাববিরুদ্ধ। তিনি সাধারণত এমনটা করেন না।
একদিন ছুটি হওয়ার পর ওবায়দুল সাহেব হুজুর আমাকে ডাকলেন। বললেন তোকে মুহিউদ্দীন খান সাহেবের কাছে নিয়ে যাবো বলেছিলাম, চল। লেখাটি সঙ্গে নিতে বললেন। রিকশা নিয়ে সোজা বাংলাবাজারে মুহিউদ্দীন খান সাহেবের অফিসে। খান সাহেব ময়মনসিংহের কাউকে পেলে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতেন।
ওবায়দুল্লাহ সাহেব যেহেতু ময়মনসিংহের তাই তারা আঞ্চলিক ভাষায় অনেক কথাবার্তা বললেন। এক পর্যায়ে জানতে চাইলেন, কেন এসেছেন, আপনারা তো সাধারণত আসেন না। তিনি চাইতেন আলেম-উলামা যেন তাঁর কাছে যাতায়াত করে।
ওবায়দুল্লাহ সাহেব আমাকে দেখিয়ে বললেন, ছেলেটি শরহে বেকায়া জামাতে পড়ে। সে একটি লেখা লিখেছে। খান সাহেব আমার লেখাটি চাইলেন। আমি দিলাম, তিনি পুরোটা পড়লেন।
পরে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি লিখেছ? আমি বললাম, হ্যাঁ আমিই লিখেছি। বললেন, খুব সুন্দর লিখেছ। তবে লেখার যে বিষয়বস্তু তা তোমার পড়া এবং বয়সের সঙ্গে যায় না। তুমি আগামী বছর কী পড়বা? আমি বললাম, হেদায়া। বললেন, তাহলে হেদায়া কিতাব এবং এর লেখকের ওপর একটি লেখা তৈরি করে নিয়ে এসো।
সেদিনের মতো বিদায় নিয়ে চলে এলাম। খান সাহেবের নির্দেশনা মতো লেখা তৈরিতে লেগে গেলাম। লাজনা করার কারণে সেই সময়ে অনেক কিতাবাদি কিনেছিলাম। অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করে একটি লেখা তৈরি করলাম। প্রথমে ওবায়দুল্লাহ সাহেবকে দেখলাম। তিনি দেখলেন এবং দুই-এক জায়গায় একটু ঠিক করে দিলেন।
ফ্রেস কপি নিয়ে একদিন খান সাহেব হুজুরের অফিসে গেলাম। তিনি লেখাটি রেখে দিলেন। আর বললেন, তুমি এক কাজ করবে, যখনই সময় পাবে চলে আসবে। এখানে যারা কাজ করে তাদের কাছ থেকে প্রুফটা শিখে নেবে। এটা তোমার লেখালেখিতে অনেক কাজে আসবে। তবে বিকালবেলায় ব্যক্তিগত পড়াশোনা আর প্রুফ না বোঝার কারণে তা শিখতে আর বাংলাবাজার যাওয়া হয়নি।
এর কয়েক মাস পরের কথা। ফরিদাবাদে তখন উস্তাদ হয়ে এসেছেন মুফতি আবু সাঈদ সাহেব। তিনি আমাদের উস্তাদ। একদিন একটি কিতাবি বিষয় বুঝতে হুজুরের কাছে গেলাম। তাঁর টেবিলে একটি মাসিক মদীনা রাখা। আমি বারবার উঁকি দিয়ে পত্রিকাটি দেখছি দেখে হুজুর বললেন, মাসিক মদীনার এই সংখ্যায় আমার একটি লেখা এসেছে। আর তোর নামে একটি লেখা এসেছে। এটি আসলে কে? আমি পত্রিকাটি হাতে নিয়ে দেখলাম আমার সেই লেখাটি এসেছে। হুজুরকে বললাম, এটা আমারই লেখা।
তখন মাসিক মদীনায় লেখা আসা মানে অনেক বড় বিষয়। হুজুর খুশি হলেন। এভাবেই মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ.-এর সঙ্গে সম্পর্কের সূচনা। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেই সম্পর্ক অটুট ছিল। দীর্ঘ ১০ বছর তাঁর সান্নিধ্যে থেকে কাজ করেছি। তিনি আমার লেখালেখির অন্যতম উস্তাদ।
[লেখা ও লেখকের কথা নিয়ে প্রকাশিত লেখকপত্রের সৌজন্যে। জুলাই ২০১৯ সংখ্যায় প্রকাশিত আত্মজৈবনিক সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন: জহির উদ্দিন বাবর]