মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন । ।
কুমিল্লার দাউদকান্দির ঢাকারগাঁও মাদরাসায় নাহবেমির পর্যন্ত পড়েছি। সেই সময় এই মাদরাসার অনেক সুনাম ছিল। ঢাকা থেকেও অনেক ছাত্র সেখানে পড়তে যেতো। সেখানে জালালাইন ও মিশকাত একসঙ্গে পড়ানো হতো। এজন্য অনেকেই সেখানে যেত। লালবাগ ও যাত্রাবাড়ী থেকে কিছু ছেলে গিয়েছিল পড়তে।
সেই সময় আমি খুব চঞ্চল ছিলাম। ক্লাসে বসতাম খুব কম। তবে পরীক্ষা খুব ভালো হতো। মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে আমার একটি ‘বদনাম’ ছিল সে একবার পড়লে বা শুনলে মুখস্থ করে নিতে পারে। আশপাশের স্কুল-কলেজের ছাত্ররাও আমাকে দেখিয়ে বলত, সে পড়ে না কিন্তু পারে। এসব কারণে ঢাকা থেকে যারা গিয়েছিল তাদের কয়েকজন আমাকে শক্তভাবে উদ্বুদ্ধ করল- তুমি শহরে গিয়ে পড়, তুমি ভালো করবে।
শহরে যাওয়ার ব্যাপারে আব্বার সঙ্গে পরামর্শ করলাম। যেহেতু তাঁর একটি ছেলেই মাদরাসায় পড়ে এবং বাড়ির বাইরে থাকে তাই আমার যেকোনো আবদার পূরণের চেষ্টা করতেন। তখন শহরে আমাদের কেউ থাকতো না। তবুও আব্বা বললেন, দেখ তুমি ভালো মনে করলে যাও।
প্রথমে লালবাগ মাদরাসায় এসে ইন্টারভিউ দিলাম। সঙ্গত কারণেই ওই উস্তাদের নাম বলতে চাচ্ছি না। তিনি আমাকে অনেক কঠিন কঠিন আটটি প্রশ্ন করলেন। আমি মোটামুটি সাড়ে সাতটি প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবে দিতে পারলাম। কিন্তু তিনি আমাকে দিলেন ৭৫ নম্বর।
আমার পরীক্ষা চলাকালেই এক লোক এসে ঢুকলেন। তার গায়ে লম্বা পাঞ্জাবি, কাঁধে রুমাল। হাতে একটি প্লেট, এর মধ্যে কয়েকটি বিস্কুট, একটি কোকাকোলার বোতল আর একটি পান। এগুলো সেই শিক্ষকের সামনে রাখলেন। তিনি এগুলো খেতে খেতে বললেন, কী ব্যাপারে, কীসের জন্য এসেছ? তখন ওই লোক একটি ফরম সামনে এগিয়ে দিলেন। তার ভাগিনা না কে যেন ভর্তি হবে। হুজুর জিজ্ঞেস করলেন, পড়বে তো? তিনি বললেন, হ্যাঁ পড়বে। পরে তাকে ফরমে নাম্বার দিলেন ৮০।
গ্রাম থেকে এলেও বিষয়টি আমি গভীরভাবে লক্ষ্য করলাম। আমাকে এতো কড়া কড়া প্রশ্ন করলেন আর যথাযথ উত্তর দেয়ার পরও দিয়েছেন ৭৫ নাম্বার, আর ওই ছেলেকে কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস না করেই দিয়েছেন ৮০ নাম্বার! আমার কাছে এটি চরম অন্যায় মনে হলো। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম এখানে ভর্তি হবো না। যারা আমাকে লালবাগে নিয়ে গিয়েছিলেন তারা অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোনো কাজ হলো না। আমি সিদ্ধান্তে অনড় লালবাগে ভর্তি হবো না।
এরপর তারা মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন আমাকে গ্রামে পাঠানো ঠিক হবে না। তাই তাদের একজন আমাকে নিয়ে যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় গেলেন। আসরের আজানের একটু আগে আমি যাত্রাবাড়ী পৌঁছালাম। মাওলানা আবদুল মজিদ সাহেব তখন হাতে মেসওয়াক নিয়ে ওজু করতে বের হচ্ছেন। আমাকে যে ছেলে নিয়ে গেছেন তাকে আবদুল মজিদ সাহেব আগে থেকেই চিনেন। জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার? তখন আমার ভর্তি করানোর কথা বললেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন কোন জামাত পড়বে? বললাম, হেদায়াতুন্নাহু।
তিনি ময়মনসিংহের লোক। আমাকে কয়েকটি প্রশ্ন করার পর বললেন, ‘কীরে চেরা তো পারে!’ পরে আবার ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে প্রশ্ন করলেন। তিনি আমার ফরমে নাম্বার দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ওই ছাত্রের হাতে দিয়ে বললেন, এখন যাও অফিসে, আমার কথা বলে ভর্তি করে নাও।
সম্ভবত তখন সময় শেষ হয়ে গিয়েছিল, হুজুরের সুপারিশ আর আমার ফরমে হয়ত বেশি নাম্বার দেখে তাৎক্ষণিকভাবে আমাকে ভর্তি করে নেয়। এটি সেই বছর যে বছর মাওলানা হেদায়াতুল্লাহ ও মাওলানা সালাহউদ্দিন রহ. লালবাগ থেকে যাত্রাবাড়ীতে চলে গিয়েছিলেন। লালবাগের ছাত্রদেরও বড় একটি টিম তখন যাত্রাবাড়ীতে চলে এসেছিল। এজন্য আমাদের ব্যাচটি ছিল মেধাবীদের মিলনমেলা।
যাত্রাবাড়ীতে এক বছরই ছিলাম। সেখানে থাকা অবস্থাতেই ফরিদাবাদ গিয়ে দেখলাম সেখানকার ছেলেরা আসরের পরও পড়ে। এজন্য পরের বছর ফরিদাবাদ মাদরাসায় ভর্তি হয়ে গেলাম। সেখানে পড়লাম চার বছর। পরে সেখান থেকে বারিধারা মাদরাসায় গিয়ে জালালাইন মেশকাত জামাত পড়ি। আর দাওরা ও আরবি আদব পড়েছি দারুল উলুম দেওবন্দে।
ফরিদাবাদে আমাদের একজন উস্তাদ ছিলেন হজরত মাওলানা বশির আহমদ সাহেব। তিনি কলেজে পড়েছেন। ওই সময়ে ঢাকা কলেজ থেকে পাঁচটি বিষয়ে লেটারসহ স্ট্যান্ড করেন। পরে তাবলিগে যাওয়ার পর তাঁর মধ্যে পরিবর্তন আসে এবং মাদরাসায় পড়াশোনা করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি দেওবন্দেও গিয়েছিলেন। তিনি একদিকে ছিলেন কট্টর তাবলিগি আর জীবনে তাঁর স্বপ্নের একটাই জায়গা ছিল সেটা হলো দেওবন্দ।
ক্লাসে ইবারত পড়া, শুদ্ধ বাংলায় কথা বলা বা যেকোনো কারণেই হোক হুজুর আমাকে খুব ভালোবাসতেন। অবসর সময়ে আমরা হুজুরের কাছে যেতাম। যখনই হুজুরের কাছে যেতাম তিনি দেওবন্দের গল্প শুরু করতেন। সত্যিকার অর্থে আলেম হওয়ার জন্য দেওবন্দে যেতে উদ্বুদ্ধ করতেন। মূলত তাঁর কাছ থেকেই দেওবন্দে যাওয়ার প্রেরণা লাভ করেছি।
দেওবন্দে দুই বছর ছিলাম। সেখানকার প্রতিটি দিনই ভালোবাসা ও ভালো লাগার। দেওবন্দের বড় একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সরলতা ও উদারতা। সেখানকার বড় বড় ব্যক্তিত্বদের সবার মধ্যে এই গুণটি আছে।
মাওলানা রিয়াসত আলী বিজনুরি। কত বড় ব্যক্তিত্ব! তাঁর তারানায়ে দেওবন্দ সারা বিশ্বে সমাদৃত। তাঁকে ‘মুফাক্কিরে ইসলাম’ বলা হয়। কিন্তু তিনি এতটাই সহজ-সরল যে, আমাদের দেশে ছোটখাট একটি মাদরাসার ভালো একজন শিক্ষকের সঙ্গে এতটা সহজভাবে সাক্ষাৎ করা যাবে না যতটা সহজে রিয়াসত আলী বিজনুরির সঙ্গে সাক্ষাৎ করা যাবে। তাঁর সম্বোধনই হলো ‘আজিজ বেটে’ (প্রিয় ছেলে)!
মাওলানা নেয়ামতুল্লাহ আজমি যাঁকে ‘বাহরুল উলুম’ বলা হয়, তিনি হাতে লাঠি নিয়ে বিকালবেলা একা একা হাঁটতে বের হন, সঙ্গে কোনো খাদেম নেই। কেউ পেছনে পেছনে খাদেম হতে চাচ্ছেন এমনটা টের পেলে তিনি ধমক দেন।
তেমনি আনজার শাহ কাশ্মিরি রহ.কেও এমনটাও দেখেছি। আসরের নামাজের পর হাঁটতে বের হতেন। গায়ের সাদা জামায় চমৎকার রঙিন কাজ। মাথায় ফুল করা কিস্তি টুপি। প্রথম যেদিন দেখলাম আমি ভাবলাম আমাদের চকবাজারের কোনো বড় ব্যবসায়ী ধরনের কেউ হবে। আমাদের সাথী ছিলেন মাওলানা এমদাদুল্লাহ কাসেমি। তিনি আমাকে বললেন, আরে! তিনিই তো আনজার শাহ কাশ্মিরি!
প্রথম পর্ব: মেঘনা-গোমতির চরের দুরন্ত সেই শৈশব
চলবে...
[লেখা ও লেখকের কথা নিয়ে প্রকাশিত লেখকপত্রের সৌজন্যে। জুলাই ২০১৯ সংখ্যায় প্রকাশিত আত্মজৈবনিক সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন: জহির উদ্দিন বাবর]