আবদুল্লাহ তামিম
২৫ জুন মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) ফিলিস্তিনকে পর্যবেক্ষক সদস্য হিসেবে এ সংস্থায় যোগ দেয়ার অনুমতি দিয়েছে। আর এর মাধ্যমে সংস্থাটি কার্যত পরোক্ষে ফিলিস্তিনকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে বলে ধরে নেয়া হচ্ছে। এটার বাস্তব না গুজব এটি নিয়ে বিতর্ক থকালেও এ বিষয়ে প্রচণ্ড ক্ষোভ প্রকাশ করেছে ইসরায়েল।
এ নিয়ে মঙ্গলবার আইএইএ’র মহাপরিচালক ইউকিয়া আমানো ও ভিয়েনায় নিযুক্ত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত সালাহ আবদুশ শাফি একটি চুক্তিতে সই করেন। ইসরায়েলের ক্ষোভ যখন প্রকাশ করেছে তখন বিষয়টিকে অনেকে সত্য হিসেবেই মেনে নিচ্ছে।
আইএইএ’র অনেক লাভ আছে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন ঘোষণা দিয়ে। ফিলিস্তিনে তেজস্ক্রিয় পদার্থ ও ইউরেনিয়ামের মতো বিস্ফোরক পদার্থের মজুদ ও নিরাপত্তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারবে আইএইএ।
ফিলিস্তিনে কোনো পরমাণু চুল্লি নেই; কিন্তু কিছু হাসপাতাল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে পরমাণু দ্রব্য রয়েছে। এদিকে আইএইএ’র এই পদক্ষেপকে ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইমানুয়েল নাহশোন ‘আন্তর্জাতিক কনভেনশনের লঙ্ঘন’ বলে মন্তব্য করেছেন।
বিষয়টিকে একটু পিছনে নিয়ে ভাবলে দেখা যায়, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়ার পক্ষে ইতোমধ্যেই ৩৪টি দেশ তাদের অভিমত জানিয়ে দিয়েছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গত ২৯ নবেম্বর ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়ার পক্ষে বিপুল সংখ্যক ভোট পড়ার মধ্য দিয়ে এবং ৩ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আববাসের জারি করা ডিক্রি বলে সাবেক ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অঙ্গীভূত ঘোষণা করার মধ্যদিয়ে ফিলিস্তিন ভূ-খন্ডে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা সম্পন্ন হয়ে গেছে পর্যবেক্ষক ও বিশেষজ্ঞ মহল এমন দাবি করে থাকেন।
তাদের মতে ফিলিস্তনী রাষ্ট্র বর্তমানে পরিণত হয়েছে একটি আইনসম্মত সরেজমিন বাস্তবতায়। এ বাস্তবতাকে এরা বলেন, উপেক্ষা করার উপায় নেই।
মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার দ্বিরাষ্ট্রিক সমাধানের কথা এত বেশি দিন ধরে শুনতে শুনতে মানুষের মনে এমন বদ্ধমূল ধারণা সৃষ্টি হয়ে গেছে যে, দু'টি দেশের অস্তিত্ব যেন অবিচ্ছেদ্য এবং একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি যেন অস্তিত্বে থাকতে পারবে না।
মার্কিনী ও ইসরাইলীরাতো লাগাতার বলে যাচ্ছেন যে, ইসরাইলের কাছে মান্য সংলাপ নির্ভর একটি মীমাংসায় পৌঁছার মাধ্যমেই ফিলিস্তিনী রাষ্ট্রের টিকে থাকা সম্ভব-অন্যথায় নয়।
এ বক্তব্যের অর্থ হলো ফিলিস্তনী রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব ও মর্যাদা রক্ষার পথে ইসরাইলের সর্বময় ও নির্ণায়ক ক্ষমতাকে সবসময় স্বীকার করতে বাধ্য থাকবে ফিলিস্তিন। কুয়েতকে ৭ মাস নিজের দখলে রেখেছিল ইরাক। কিন্তু ইরাকী দখলে ছিল বলেই কুয়েতের রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব সে সময় অস্বীকৃত হয়ে যায়নি। একই মন্তব্য মার্কিন দখলে থাকা ইরাকের বেলায়ও প্রযোজ্য হয়।
ফিলিস্তিন ভূ-ভাগ ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং বিভিন্ন মাত্রায় সেখানে চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে ইসরাইলী খবরদারী। কিন্তু এর ফলে ফিলিস্তিনী রাষ্ট্র অস্তিত্বহীন হয়ে গেছে বলার উপায় নেই। কিন্তু এত সব কথা বলার অর্থ এই নয় যে, মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার নিত্তি হয়ে গেছে এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রশ্নাতীতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।
ফিলিস্তিনী রাষ্ট্রীয় অস্তিত্বের প্রতি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ইদানীং প্রায় সর্বজনীন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। এই বক্তব্যের সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায় ২৯ নবেম্বর ভোটের মাধ্যমে ফিলিস্তিনী রাষ্ট্রকে দেয়া আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির মধ্যে। ভোট অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্যের মধ্যে ১৩১টি দেশের কূটনৈতিক স্বীকৃতি ইসরাইলের হস্তগত ছিল।
পরবর্তীতে আরো ২৮টি দেশকে ফিলিস্তিনী রাষ্ট্রকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিতে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। ফিলিস্তিনের পক্ষে নিজেদের অবস্থান এখনো ব্যক্ত করেনি মাত্র ৩৪টি দেশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউকে এবং জার্মানি ও অস্ট্রেলিয়ার মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ দেশ এদের মধ্যে শামিল থাকলেও বাকি অন্যরা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে না। ৩৪টির মধ্যে মাত্র ১২টি দেশ হচ্ছে এমন যেখানে ৫০ লাখের বেশি লোকের বসবাস পাওয়া যায়।
৯টি দেশের প্রত্যেকটির জনসংখ্যা হচ্ছে ১ লাখ ২০ হাজারের কম। বিশ্বের ২০টি জনবহুল দেশের ১৬টিই ইতোমধ্যে ফিলিস্তিনকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি জানিয়েছে এবং জাপান ও মেক্সিকো ভোট দিয়েছে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রের মর্যাদা দেয়ার পক্ষে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র কবে ও কিভাবে অস্তিত্বে আসবে এবং আদৌ অস্তিত্বে আসতে পারবে কিনা-এইসব প্রশ্ন তোলার অবকাশ বর্তমানে আর নেই।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্র বর্তমানে পরিণত রয়েছে একটি সরেজমিন বাস্তবতায়। ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে ইসরাইলী নিয়ন্ত্রণ থেকে কখন ও কিভাবে মুক্ত করা যাবে এখনকার বড় প্রশ্ন হচ্ছে এটিই।
নিয়ন্ত্রিত ফিলিস্তিনী ভূ-খন্ডে লাগাতার অবৈধ বসতি নির্মাণের মধ্য দিয়ে সমস্যা সমাধানের বিরোধিতায় এমন চরম ও বিপজ্জনক প্রান্তে ইসরাইল নিজেকে স্থাপিত করেছে সে অবস্থান থেকে ফিরে আসার কাজ কিভাবে ইসরাইল সম্ভব করতে পারবে-ভেবে ওঠা যায় না। অথচ তাকে এ কাজ করতেই হবে। মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার সমাধানের দায়িত্ব ফিলিস্তিনী ও ইসরাইলীদের ওপর যেমন বর্তায় তেমনি বর্তায় মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠাকামী সুহৃদজনদের ওপরও।
স্থিতাবস্থায় পরিবর্তন ঘটিয়ে সমস্যাগ্রস্ত পক্ষ দু'টোকে পারস্পরিক আস্থা ও সম্মানের ভিত্তিতে পরস্পরের দিকে এগিয়ে নেয়ার সুকঠিন কাজটি সম্পন্ন করতে হবে এদের এবং একই সঙ্গে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গড়ার মধ্যদিয়ে বিরোধে জড়িত বিভিন্ন পক্ষসহ সারাবিশ্বে জানিয়ে তুলতে হবে কল্যাণকর বিশ্ব গড়ার লক্ষ্যে আশাবাদী মানসিকতা।
-এটি