মুফতী খন্দকার আজিজুল হক ইয়াকুবী
আলেম ও শিক্ষক
শিশু জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ। শিশুরা স্বর্গীয় ফুল। শিশুদের ভাল করতে হলে তাদের সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হলে আদর্শ ও দীনি শিক্ষার বিকল্প নাই । শিশুর ধারণ ক্ষমতা অনুসারে আদর্শ শিক্ষা দিলে সে একদিন কালজয়ী আদর্শবান মানুষ হতে পারবে। আর সেই আদর্শ শিক্ষা হলো দীনি শিক্ষা।
আনন্দের মাঝেই শিশুর শিক্ষা জীবনের অবস্থান। কঠোর শাসন, নিয়ন্ত্রন, প্রতিকুল পরিবেশ, শিশুর শিক্ষা জীবনকে অনিশ্চয়তার পথে ঠেলে দেয়। শিশুর মনের আনন্দই তার দেহ মনের শক্তির মূল উৎস।
আনন্দ ও শিশু বান্ধব পরিবেশ ছাড়া তার সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ অসম্ভব। শিশুকে আদর যত্নের মাধ্যমে পরিপূর্ণ ইসলামি জীবন যাপনের জন্য সক্ষমতা ও দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করার নামই হলো শিক্ষা বা শাসন করা।
শিশুর ওপর জোর করে বিদ্যা চাপিয়ে দেয়ার নাম শিক্ষা নয়। শিশু শিক্ষা বিষয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ থমসন বলেন, “শিক্ষা হলো শিশুর ওপর পরিবেশের প্রভাব, যে প্রভাবের দ্বারা শিশুর বাহ্যিক আচরণ, চিন্তাধারা এবং দৃষ্টিভঙ্গির স্থায়ী পরিবর্তন হয়।”
শিশুরা কোমল মনের অধিকারী। আনন্দঘন পরিবেশে থাকতেই শিশুরা স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। শাসন, নিয়ন্ত্রণ, ভীতিকর ও বিষাদময় পরিবেশ শিশুর শিক্ষা লাভকে বাধাগ্রস্থ করে।
শিশু শিক্ষা ও আনন্দ ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। আনন্দ ছাড়া কোমলমতি শিশুরা শিক্ষা লাভে উৎসাহিত হবে না। শিশুরা শিখবে আনন্দের মাধ্যমে, নিজেদের ইচ্ছামতো, ঘুরে-ফিরে, কল্পনার ফানুস উড়িয়ে।
শিশুরা শিখবে খেলাধূলার মাধ্যমে, তাদের মনের অজান্তে। শিশুরা শিখবে মাদরাসা, বিদ্যালয়, পরিবার ও সমাজ থেকে, একান্ত নিজেদের মতো করে। শিশুরা অজানাকে জানার সাথে করবে মিতালী। শিশুরা জানবে সহজভাবে, আনন্দের সাথে। আনন্দ ছাড়া শিশুর বিদ্যা অর্জনে আগ্রহী হবে না।
শিশুর জীবন দলছুট হরিণের মতো। তারা সবসময় গতিবদ্ধ জীবন হতে বেরিয়ে আসতে চায়। শিশুরা সবসময় বাঁধার প্রাচীর ভাঙতে চায়। তারা চায় নীল আকাশের নিচে উন্মুক্ত জীবন, যেখানে কোন ধরাবাধা নিয়ম শৃঙ্খলা থাকবে না।
শিশুরা ছুটতে চায়, খোলা আকাশের নিচে, নিজের মতো করে। তাই শিশুর রুচি ও মানসিক চাহিদা অনুযায়ী কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। ইবাদতের বেলায়ও তাই করা হবে। আমরা অনেকেই শিশুদের মসজিদে নিয়ে যাই। বিশেষ করে জুমার দিনে শিশুরাও আনন্দ ও আগ্রহ বোধ করে।
প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই শিশুদের আল্লাহর ঘরের সঙ্গে পরিচয় করানো ও নামাজের জন্য অভ্যস্ত বানানো একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কেননা শিশুকালে যে জিনিসে অভ্যাস হয়, পরে তা করা সহজ হয়, নচেৎ তা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
এ জন্যই হাদিস শরিফে এসেছে, ‘তোমরা তোমাদের বাচ্চাদের সাত বছর বয়স থেকেই নামাজের নির্দেশ দাও। আর যখন ১০ বছর বয়সে উপনীত হবে, তখন তাদের নামাজে অবহেলায় শাস্তি প্রদান করো। ’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯৫)
তবে শিশুদের মসজিদে নেওয়ার বিষয়ে শরয়ী কিছু নিয়ম-নীতি আছে , সেগুলো রক্ষার মাধ্যমে এ বিষয়ে কিছু অনিয়ম থেকে আমরা রক্ষা পেতে পারি।
একেবারে অবুঝ শিশুকে মসজিদে আনা নিষেধ
একেবারে ছোট ও অবুঝ শিশু, যারা মসজিদের সম্মান ও নামাজের গুরুত্বের জ্ঞান রাখে না, তাদের মসজিদে আনার অনুমতি নেই। কেননা এতে সাধারণত মুসল্লিদের নামাজে বিঘ্ন ঘটে।
এ জন্যই হাদিস শরিফে এসেছে, হজরত ওয়াসিলা রা. সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন, ‘তোমরা তোমাদের মসজিদকে অবুঝ শিশু ও পাগলদের থেকে দূরে রাখো, তদ্রূপ ক্রয়-বিক্রয়, বিচার-আচার, উচ্চস্বর, দণ্ডদান ও তরবারি কোষমুক্ত করা থেকে বিরত থাকো। ’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৭৫০)
অনেক সময় দেখা যায়, শিশুরা না বুঝে মসজিদের ভেতরে আদববহির্ভূত উচ্চৈঃস্বরে কথাবার্তা ও হৈ-হুল্লোড় করে থাকে, যা মসজিদের আদবপরিপন্থী কাজ। একটি হাদিসে মসজিদে উচ্চ আওয়াজ ও চেঁচামেচিকে কিয়ামতের নিদর্শন হিসেবে উল্লিখিত হয়েছে। এমনকি কিছু বাচ্চা মসজিদে এসে প্রস্রাব-পায়খানাও করে দিতে দেখা যায়।
এর দ্বারা প্রমাণিত হয়, যদিও বুঝদার শিশুদের মসজিদে আনা একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ; কিন্তু অবুঝ শিশুদের আনা নিষিদ্ধ।
বুঝমান নাবালেগ শিশুর নামাজের কাতারে দাঁড়ানোর বুঝ হয়েছে, এমন নাবালেগ শিশুদের ব্যাপারে বিধান হলো, যদি শিশু একজন হয়, তাহলে তাকে বড়দের কাতারেই সমানভাবে দাঁড় করাবে।
এ ক্ষেত্রে বড়দের নামাজের কোনো অসুবিধা হবে না। একাধিক শিশু হলে সাবালকদের পেছনে পৃথক কাতারে দাঁড় করানো সুন্নাত। তবে হারিয়ে যাওয়া বা দুষ্টুমি করার আশঙ্কা হলে, বড়দের কাতারেও দাঁড়াতে পারবে।
শিশুরা বড়দের কাতারে দাঁড়ালেও নামাজ হবে। তবে অনেকের এ ধারণা রয়েছে যে নাবালেগ শিশুদের বড়দের কাতারের মধ্যে দাঁড় করালে পেছনের মুসল্লিদের নামাজ হয় না এরকম ধারনা করা ভুল। তাই আসুন শিশুদের অবহেলা না করে তাদের প্রতি যত্নবান হই। তাদেরকে ইসলামের প্রাথমিক শিক্ষা দিয়ে ইবাদতের ব্যাপারে উৎসাহী করে তুলি।
আমরা যদি শিশুদের কে মসজিদে আনা নিষেধ করে দেয় তাহলে তারা মসজিদ ও নামাজ সম্পর্কে বেখেয়াল হয়ে যাবে। তাতে হিতে বিপরিত হতে পারে। রাসুল সাঃ এর প্রিয় দৌহিত্রদ্বয় ইমাম হাসান ও হোসাইন রা. প্রিয় নবীজীর নামাজ আদায়কালীন তাঁর পিঠে উঠতেন, দাড়ি মুবারকে হাত লাগাতেন আরো কত দুষ্টুমি করতেন যা সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমানিত।
অতএব, সুস্থ ও বুঝমান শিশুদেরকে মসজিদে নিয়ে আসা সুন্নাহ দ্বারা প্রমানিত অবুঝ শিশুদের নয়। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে দ্বীনের সহীহ বুঝ দান করুন। আমিন!!
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা মোহতামীম, মাদরাসায়ে মুহাম্মাদ সাঃ মাতুয়াইল, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা।
আরএম/