তানভীর সিরাজ
গীবত একটি সামাজিক ব্যাধি। আমরা গীবত বা পরনিন্দার গোনাহ থেকে মুক্ত হতে চাইলেও না পারার অপারগতা বারংবার প্রকাশ করতেই হয়।
দুনিয়াতে এমন একটা কাজ আছে, যাকে কাজের কাতারেও রাখা অমানবিক, কারণ তা আমার কষ্টসহিষ্ণু সব নেক আমলকে মাটি করে দেয়, তবে শুধু বাকি থাকে নামের কষ্টটুকু।
মহিলাদের একটা বদ্ধমূল ধারণা, ‘সত্য প্রকাশ করতে গিয়ে কিছু একটা বললে তা গীবত হয় না।’ তারা আরো বলেন, ‘আমরা কি মিথ্যা বলছি, যে গীবত হবে?’
ইমাম নববি রহ. বলেন, ‘এ কথা মনে রাখা আবশ্যক যে, গীবত করা যেমন হারাম, তা শোনা এবং একে সত্যায়ন করাও হারাম। অতএব যখনই কেউ কারও গীবত শুরু করে তখন কোনোরূপ ক্ষয়-ক্ষতির আশঙ্কা না থাকলে তৎক্ষণাৎ তাকে বাধা দেয়া উচিত। আর যদি কোনোরূপ আশঙ্কা থাকে তবে অন্তর থেকে তা অস্বীকার করা চাই। সেই সাথে সম্ভব হলে এ ধরনের বৈঠক ত্যাগ করা উচিত।
তেমনিভাবে মৌখিকভাবে গীবতে বাধা দেওয়ার সামর্থ্য থাকলে বা কোনোভাবে আলোচনার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার সুযোগ থাকলে তা করা আবশ্যক। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও বাধা না দিলে গুনাহগার হবেন।’ (জবানের হেফাজত, ইমাম নববি রহ.)
তাহলে গীবত কাকে বলে? ‘মানুষের মধ্যে বিদ্যমান দোষ বা দূষণীয় এমন কোনো বিষয় তার অবর্তমানে আলোচনা করা, যার উল্লেখ তার অপছন্দনীয়, একেই গীবত বলা হয়।’ (জবানের হেফাজত, ইমাম নববি র.)
আবু হোরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা কি জান গীবত কী? তারা বললেন, আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলই অধিক অবগত। তিনি বললেন, (গীবত হলো) তোমার ভাই সম্পর্কে তোমার এমন আলোচনা যা সে অপছন্দ করে। বলা হল, কি মনে করেন, যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে তা থাকে যা আমি বলেছি? তিনি বললেন, যদি তার মধ্যে ঐ দোষ থাকে যা তুমি বলছ তবে তো তুমি তার গীবত করেছো, আর যদি তার মধ্যে তা না থাকে যা তুমি বলছ তবে তো তুমি তার তাকে অপবাদ দিলে। (মুসলিম-২৫৮৯)
দুঃখের সাথে বলতে হয়, ঘরেবাইরে যে পরিমাণ গীবতী বাতাস বয়ছে আজ, তার জন্য দায়ী একমাত্র আমাদের অসচেতনতা। আমল করি নিজের জন্যে, নীরবে নিয়ে যায় অন্যে !
কে কাকে বোঝাবো? বাবা ছেলের, ছেলে তার বাবার! মা ছেলের আর ছেলে তার দুঃখিনী মায়ের, ভাই বোনের আর বোন তার ভাইয়ের, বৌ শাশুড়ির আর শাশুড়ি ছেলে বৌয়ের, ছাত্র শিক্ষকের আর শিক্ষক তার ছাত্রের! প্রতিবেশী তার প্রতিবেশির, রাজা প্রজার, প্রজা রাজার গীবত করেই চলছে!
এভাবে প্রতিটা ঘর, জনপথ, পাড়া, এলাকা আর দেশ, এককথায় দেশের প্রত্যেকটি কোণা গীবতের আগুনে প্রজ্বলিত কোণঠাসা হয়ে আছে। এই প্রজ্বলন থেকে কে কাকে বাঁচাবে!?
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- বলেন, ‘কোন ব্যক্তির ওপর তার অপর ভাইয়ের যদি কোন দাবী থাকে, তা যদি তার মান- ইজ্জতের ওপর অথবা অন্য কিছুর ওপর যুলুম সম্পর্কিত হয়, তবে সে যেন আজই কপর্দকহীন নিঃস্ব হওয়ার পূর্বে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়।
অন্যথায় (কিয়ামতের দিন) তার যুলুমের সমপরিমাণ নেকী তার কাছ থেকে নিয়ে নেয়া হবে। যদি তার কোন নেকী না থাকে তবে তার প্রতিপক্ষের গীনাহ থেকে (যুলুমের সমপরিমাণ) তার হিসাবের অন্তর্ভুক্ত করে দেয়া হবে’ (বুখারি, রিয়াদুস সলিহিন:২১০)
প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার 'ইসলামী শিক্ষা' বইয়ের একটি অনুচ্ছেদ যদি গীবত বা পরনিন্দা নির্ভর হতো, কতই না ভালো হত। তবেই তো আপামর জনতা জানতে পারতো 'আমরা কি ধানের চাল', আর 'কত ধানে কত চাল'।
গীবিতের শাস্তি সম্পর্কে হযরত আনাস ইবনে মালিক রা. থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যখন আমাকে মি'রাজে নেওয়া হল তখন আমি এমন একদল লোকের নিকট দিয়ে অতিক্রম করলাম যাদের নখ ছিল তামার। তা দ্বারা তারা নিজেদের চেহারা ও বুক খামচাচ্ছিলো। তখন আমি বললাম, হে জিবরীল, এরা কারা? তিনি বললেন, এরা ঐসমস্ত লোক যারা মানুষের গোশত খেত এবং মানুষের ইজ্জত-আবরুতে হাত দিত। (আবুদাউদ,৪৮৭৮, মুসনাদে আহমদ, ৬/১৮৮)
মূলত আমরা পরনিন্দায় মেতে উঠি মতের খিলাফ অঘটন কিছু একটা ঘটলে। এই যে দেখুন, বস তার চাকুরীজীবীর, পরিচালক পরিচালিতদের, প্রিন্সিপাল শিক্ষক-শিক্ষিকার, মুহতামীম প্রতিষ্ঠানের উস্তাদদের ঠিকসময়ে যখন তাদের কষ্টের পাওনা আদায় না করেন, সেইসময় থেকে মূলত ইঞ্চি ইঞ্চি করে চাপাকষ্টের আকাশে পরনিন্দার ভারি বাতাস বইতে থাকে। বর্ষণ হতে থাকে গোম ধরে থাকা মনোকষ্টের সব বৃষ্টি এবং সপ্রকাশ্য হয় অমিলের সব গোপ্ত দোষগুণ!
এখন দেখা যায় সামর্থবান পরিচালক বা মালিক বলি, আর বেচারা পরিচালকদের কথা বলি, প্রায় সবার দীলিহালাত একই! তবে ভিন্নদের কথা সবসময় অভিন্নদের কাতারেই থাকে না।
সামাজিক জীবন আসলে এভাবে চলবে কি বলেন? সামাজিক জীবন চলে না এরকমভাবে। আমরা যারা খেদমত / চাকুরী করি সবার কাছে আবদার এই অধমের, আসুন, আমরা একটু ছবরের সাথে সুন্দর সোরাহার ফরিয়াদ করি বিশ্ব প্রতিপালকের দোয়ারে, যেন তিনি অধিকারী আর অধিকার-বঞ্চিতদের যথাযোগ্য বোঝ দান করেন আর দক্ষিণা দোয়ার রুদ্ধ করে দেন।
অধিকারী আর পাওনা-বঞ্চিতরা যখন ধৈর্য্যচ্যুত হয় তখন আপন আপন অভিনব কায়দায় দোষারোপ করে থাকে এক পক্ষ আরেক পক্ষকে, আর তখনই বিস্ফোরণ হতে শুরু করে, শুরু হতে থাকে আপনত্বের নামে দূরত্ব। যদি এক পক্ষ পরনিন্দা না করে গোপন করতো সব দোষা-প্রয়োগ, তাহলে কত ভালো হতো! কারণ "যে মানুষের দোষ-ত্রুটি গোপন করবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার দোষ-ত্রুটি ঢেকে রাখবেন।’ (বুখারি)
প্রতিটি ঘর, অফিস আদালত আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং মাদরাসা গীবতের বাতাসে আজ বেশ ভারি হয়ে আছে! গীবত না করে একে অপরকে বুঝার চেষ্টা করুন। গীবত করে তো সবাই চলতি রহমত, মাগফিরাত আর নাজাতের মাসেও জাহান্নাম মুখী হচ্ছি, তাই না ?
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন : তোমরা অপরের গীবত করা থেকে সর্বদা নিজেকে বাঁচাতে চেষ্টা করো। কারণ, গীবতের ভেতর তিনটি মারাত্মক আপদ রয়েছে, (এক) গীবতকারী ব্যক্তির দোয়া কবুল হয় না।
(দুই) তার কোনো নেক আমল আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। (তিন) তাকে অসংখ্য অকল্পনীয় পাপের বোঝা বহন করতে হয়। (মুকাশাফাতুল কুলুব)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- যদি জানতেন আজকাল প্রায় বৈঠকে গীবত হয়, তাহলে অবশ্যই তিনি বৈঠকের দোআর সাথে গীবতের দোআটিও পড়তে বলতেন। মনে হয় আগে গীবতের দোআটিই পড়তে বলতেন।
এমনকি রমজান মাসেও আমরা গীবতের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাচ্ছি না, পাই কি!
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- বলেছেন, ‘দুনিয়াতে যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের মাংস ভক্ষণ করবে অর্থাৎ গীবত করবে, কিয়ামতের দিন গীবতকারীর সামনে গীবতকৃত ব্যক্তিকে মৃত অবস্থায় উপস্থিত করা হবে এবং বলা হবে তুমি মৃত অবস্থায় তার গোশত ভক্ষণ কর যেমনভাবে জীবিত অবস্থায় তার মাংস ভক্ষণ করতে।’
হযরত আবু মূসা রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- বলেছেন, ‘প্রতিটি মুসলিমের ওপর সদাকা ওয়াজিব। জনৈক সাহাবী বললেন, ‘কিন্তু সে যদি কোনো কিছু না পায়? তিনি বললেন, ‘তাহলে সে নিজ হাতে কাজ করে নিজেকে লাভবান করবে এবং সদাকাও দেবে। সাহাবী বললেন, ‘আর সে যদি তাও না পরে? তিনি বললেন, ‘তাহলে সে দুস্থ ও অভাবী লোকদের সাহায্য করবে। সাহাবি বললেন, ‘সে যদি তাও না পারে? তিনি বললেন, ‘তাহলে সে ভালো কাজের আদেশ করবে। সাহাবী বললেন, ‘যদি সে এটাও করতে না পারে? তিনি বললেন, ‘তাহলে সে অন্তত নিজেকে মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখবে। কেননা, এটাও তার জন্যে সদাকা।’ (বুখারি-১৪৪৫, মুসলিম-১০০৮)
তাহালে কারো অনুপস্থিতিতে কিছু বললেই কি গীবত হবে? তার জবাব- শরিয়তসম্মত উদ্দেশ্যে দোষ আলোচনা করা গীবত নয়। যেমন যালিমের বিরুদ্ধে মাযলুম, শাসকের নিকটে বা যার পক্ষে সাহায্য করা সম্ভব তার নিকটে অভিযোগ করা। তদ্রূপ কারো কাছে কারো সম্পর্কে পরামর্শ চাওয়া হয় যে, অমুকের নিকট আমি আমানত রাখতে চাই, বা অমুকের জন্য বিবাহের প্রস্তাব করতে চাই, তুমি কী বল? তখন পরামর্শ একটি আমানত হিসাবে সত্য বলতে হবে। ( হাদীসের আলো জীবনের পাথেয়, সম্পাদনা: মাওলানা আবু তাহের মেছবাহ, পৃ. ১৮৩)
গীবতের কাফফারা হলো, যে গীবত করেছে সে নিজের জন্য এবং যার গীবত করেছে তার জন্য আল্লাহর কাছে মাফ চাবে। বলবে, হে আল্লাহ্, আমাকে এবং যার গীবত করলাম তাকে মাফ করে দেন। রমজানে গীবত করলে তার পরিণতি সম্পর্কে আশাকরি এতটুকুই যথেষ্ট।
আসুন, গীবত মুক্ত সিয়াম সাধনা করি।
-এটি