রকিব মুহাম্মদ
সাংবাদিক
যতদূর জানতে পেরেছি, একজন দীনদার মানুষ ছিলেন তিনি। একটু উন্নত জীবনের আশায় দেশ ছেড়ে পাড়ি জমান প্রবাসে। স্ত্রী ও সাত সন্তানকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ডেট্রয়েটে থাকতেন। পরিবারের ভরণ-পোষণ আদায়ের জন্য ট্যাক্সি চালাতেন তিনি।
বিগত শুক্রবার (স্থানীয় সময়) দিনগত রাত সোয়া ১টার দিকে ভাড়াজনিত বিবাদকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানের ডেট্রয়েটে জয়নুল ইসলাম নামের এক বাংলাদেশি ট্যাক্সিচালককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, রাতে ট্যাক্সি চালাচ্ছিল জয়নুল। এ সময় এক যাত্রী তাকে ট্যাক্সির ভাড়া দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ওই যাত্রীর সঙ্গে জয়নুলের কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে জয়নুলকে গুলি করা হয়।
গুলিবিদ্ধ জয়নুল চলন্ত গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। এরপর গাড়িটি গাছের সঙ্গে ধাক্কা খায় এবং ঘটনাস্থলে তার মৃত্যু হয়। অতিতুচ্ছ একটি ঘটনার জেরে জয়নুল মারা গেল।
পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে জয়নুলের স্বজনরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে। জয়নুল একজন ভালো, পরিশ্রমী ও ধার্মিক মানুষ ছিলেন।তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছে স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়। পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষ তার জানাজায় অংশ নেন।
এ হত্যাকাণ্ডের তদন্তে এখনও খুব একটা অগ্রগতি হয়নি। কতদূর কী তদন্ত হবে সেটাও আপেক্ষিক একটি বিষয়। প্রতিবছর হাজারো প্রবাসী বিদেশের মাটিতে প্রাণ হারাচ্ছেন। আমরা গণমাধ্যমের বরাতে অল্পবিস্তর জানতে পারলেও অনেক খবর অজানা থেকে যায়।
আমার সেজখালুকে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে গুলি করে হত্যা করা হয়। তাঁর নামও জয়নুল। খালুর মৃত্যুর কারণ হিসেবে আমার খালাকে জানানো হয়, মালিকপক্ষের লোকদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছিল, তাই তারা গুলি করে মেরে ফেলেছে তাঁকে। এরকম তুচ্ছ একটি কারণে মেরে ফেলা হয় তাঁকে! ভাবতেও অবাক লাগে!
খালুর মৃত্যুর পর কফিনে তাঁর লাশ পাঠিয়ে দেওয়া হয় দেশে। সেই কফিনটা এখনও খালার বাসায় যত্ম করে তুলে রেখেছেন তিনি। কিন্তু পরিবারের একমাত্র উপার্জনের ব্যক্তির অকাল মৃত্যুতে তার জীবনে অন্ধকার নেমে আসে। খালুর মৃত্যুর পর চার মেয়েকে নিয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন আমার খালা।
একটি তথ্য দেই, সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে কয়েক বছরের বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। সরকারি হিসেবেই ২০১৩ সালে ৩০৭৫ জন বিদেশে কর্মরত শ্রমিক মারা গেছে। এদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সৌদি আরবে। এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং মালয়েশিয়াতেও অনেক কর্মরত শ্রমিক মারা গেছে। (বিবিসি)
বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত সমস্যা ছাড়াও অনেকে মারা যাচ্ছেন সড়ক দূর্ঘটনা কিংবা অগ্নিকান্ডে। আবার হত্যা করে মেরে ফেলার ঘটনাও কম না। যা বলছিলাম, বিদেশের মাটিতে বেশিরভাগ হত্যাকাণ্ডের সঠিক তদন্ত হয় না। আবার কোন ধরনের সমস্যায় পড়ে বাংলাদেশী দূতাবাসের দ্বারস্থ হলে বেশিরভাগ সময় কর্মকর্তাদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত সাড়া পাওয়া যায় না।
অথচ, বছরে ৩০ হাজার কোটি টাকা রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। বর্তমানে বিশ্বের ১৬৫টি দেশে ১ কোটিরও বেশি বাংলাদেশি কর্মী কর্মরত আছেন। তাদের পাঠানো টাকায় দেশের উন্নয়ন দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কিন্তু, তাদের নিরাপদ কর্মসংস্থান তৈরিতে সরকারের তৎপরতা চোকে পড়ার মতো নয়। আমরা চাই, সরকার প্রবাসীদের কদর করুক, জয়নুলদের স্বজনদের চোখের পানির কদরা করা হোক। দেশের পররাষ্ট্রবিভাগ শক্তিশালী পদক্ষেপ গ্রহণ করুক।
বি:দ্র: জয়নুলের পরিবারকে আর্থিকভাবে সহায়তা দিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রচারণা চালাচ্ছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান তরুণ তাজ চৌধুরী। এতে অনেকেই সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০ হাজার ডলার আর্থিক অনুদান উঠেছে বলে তিনি জানিয়েছেন। অসহায় পরিবারটিকে সহায়তার জন্য ১ লাখ ডলার অনুদান সংগ্রহ করতে চাইছেন তারা। আপনিও এ মহত কাজে শরিক হতে এগিয়ে আসুন।
আরএম/