তানভীর সিরাজ
ইতিকাফ মাদানি জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। রাসূল সা. মদিনা শরিফ হিজরত করে প্রতিবছরই ইতিকাফ করতেন। ইমাম যুহরি বলেন, ‘ইতিকাফের মতন গুরুত্বপূর্ণ আমলকে লোকদের ছেড়ে দেয়া দেখলে আমি অবাক করি, অথচ আল্লাহর রাসূল সা. মাঝেমধ্যে অন্যান্য আমল বাদ দিলেও, মদিনা শরিফ হিজরতের পর আজীবন মসজিদে নববিতে ইতিকাফ করেন।’ (শামেলা)
এমনকি এক বছর তিনি ইতিকাফ নিতে না পারলে পরবর্তী বছর ২০দিন ইতিকাফ করেন। এমনটাও সিরাতের কিতাবে পাওয়া যায়। আর যেই বছর নবি সা. দুনিয়া থেকে বিদায় নিবেন সেই বছর ২০দিন ইতিকাফ করেন। হযরত আবু হুরাইরা র. বলেন, ‘আল্লাহর নবি সা. প্রত্যেক রমজানে দশদিন এতেকাফ করতেন, সুতরাং যে বছর তাঁর ওয়াফাত সে বছর তিনি ২০দিন ইতিকাফ করেন।’ (বুখারি শরিফ,হাদিস-২০৪৪)
ইতিকাফে করণীয়
১। নিয়ত: নিয়ত করা। নিয়ত ছাড়া কোনো আমলই শুদ্ধ হয় না। নিয়ত মুখে উচ্চারণ করা জরুরী নয়, করলেও কোনো সমস্যা নেই। তবে মনে মনে করা ভালো।
নিয়তঃ 'আমি আল্লাহর ওয়াস্তে ১০দিন সুন্নতে মুয়াক্কাদা কেফায়া ইতিকাফের নিয়তে মসজিদে/ মহিলা হলে কক্ষে অবস্থান করছি', অথবা যদি এমন নিয়ত না করেন তাহলে আবাসনের পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে মসজিদে /কক্ষে ইতিকাফ ব্যক্তির প্রবেশটাই নিয়তের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে।
২। নফল নামায: যত পারা যায় নফল নামায পড়া। যেমন ইশরাক, চাশত, আওয়াবীন, তালাতুত তাওবা ইত্যাদি। কারণ রমজানে এক একটি নফলের জন্যে তো এক একটি ফরজের ছোয়াব দেয়া হয়। তাই তার প্রতি গুরুত্ব দেয়া দরকার। এখনই তার সময়। সামনে কোথায় থাকি তার ঠিকঠিকানা নেই। মাটির উপরে, নাকি তার নীচে।
৩। ওমরি কাযা: ফরজ ও ওয়াজিব নামায যাদের অনেক কাযা রয়েছে তারা সেইসব নামাযের কাযা আদায় করতে পারেন এই ইতিকাফে। এটি তাদের জন্য সুবর্ণ সুযোগ।
৪। কুরআন তেলাওয়াত: রমজান কুরআনের মাস। কুরআন তেলাওয়াত এই মাসের দাবি। প্রতিদিন ১পারা, ১০ পৃষ্টা। যারা হাফিজ তারা ১খতম বা ১৫ পারা এভাবে আমল করতে পারেন। তবে যারা তেলাওয়াত করতে পারেন না, তারা অন্তত বিজ্ঞ কারো কাছে বসে পূর্ণমনোযোগিতার সাথে কুরআন শ্রবণ করতে পারেন। প্রতি অক্ষরে ১০ নেকি। আর রমজানে ৭.১০=৭০ নেকি! তাহলে অগণিত নেকির ভাগি হচ্ছেন ইতিকাফ ব্যক্তি। আ'লা হযরত শাহ আবদুর রহীম সাহেব রায়পুরী র. প্রায় পুরোরাত তিলাওয়াতে অতিবাহিত করতেন। এমনকি তিনি রামাদ্বানে ২৪ ঘণ্টায় ১ ঘণ্টার বেশি ঘুমাতেন না। (আকাবির কা রমজান, পৃ.২৯)
৫। যিকির: যারা তেলাওয়াত পারেন না, শ্রবণের মতো তেমন কোনো ব্যক্তিও যদি না পাওয়া যায়, তা হলে শুধু কুরআন শরিফের প্রতি লাইনে লাইনে হাত বুলিয়ে যাবেন তিনি, আর পরিতাপের সাথে মনে মনে বলবেন 'আমি কতইনা হতভাগা, আল্লাহ্, আমাকে মাফ করেন!'
আল্লাহ তাকে নেকি থেকে বঞ্চিত করবেন না, ইনশাআল্লাহ।
৬। দরূদ পাঠ: শয়নে আর হাটতে বসতে দরূদ পাঠ করতে পারি। প্রতিবার দরূদে আমার নাম নবীর তরফে পেশ করা হয়, আল্লাহর রহমত ১০গুণ করে আমার পক্ষে হয় আর ফেরেশতারাও আমায় দোআর ভাগি করেন। যে ব্যক্তি যতবেশি দরূদ পড়বে, সে ব্যক্তি ততবেশি হাশরের মাঠে আমার কাছে থাকবে। হাদীসের কথা।
অন্য স্থানে আছে যে ব্যক্তি ১০০বার দরূদ পড়বে, তার দু'চোখের মাঝে লিখে দেয়া হবে, সে জাহান্নাম ও মুনাফেকি থেকে মুক্ত! আপনি যেকোনো দরূদ পড়তে পারেন। ছোট আঁকারে বলছি,
صلى الله عليه وسلم ، 'সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।' اللهم صل عليه ،
'আল্লাহুম্ম ছল্লি আ'লা মুহাম্মদিন' جزا الله عنا محمد 'জাযাল্লাহু আন্না মুহাম্মাদিন'
৭। লাইলাতুল কদর: শবেকদরকে বেজোড়া (২১,২৩,২৫,২৭,২৯ তারিখ) রাতে তালাশ করা। পারলে এই রাতসমূহে জেগে ইবাদত করা। সহীহ হাদীসে এই রাতগুলোতে শবেকদরকে তালাশ করতে বলা হয়েছে। সহজে শবেকদর, শবেবরাত ইত্যাদি বড়বড় রাতের ফযিলত যদি কেউ লাভ করতে চান তাহলে অবশ্যই সেদিনের মাগরিব, এশা আর ফজরের নামায জামাতের সাথে আদায় করা। অসুস্থ হলে ঘরে বা থাকেন যেখানে, এসব নামাযের প্রতি যত্নবান হওয়া সেখানে।
৮। তালীম: ইতিকাফে ব্যক্তিদেত মধ্যে ভালো আলিম থাকলে হাদীসের তালীম করা যায়। যার সহজ মাধ্যম হল শায়খুল হাদীস আল্লামা যাকারিয়া র. -এর 'ফাযায়েলে আ'মাল' পাঠ। মুফতি আযম আল্লামা মুফতি ফয়জুল্লাহ র.-এর 'ফয়জুল কালাম'ও তালিমের তালিকায় রাখতে পারি। তার সূচিপত্রটি বেশ উপকারী, মা শা আল্লাহ্।
৯। জীবন্তিকা জীবনী পাঠ: ওলি আল্লাহদের জীবনী পাঠ করা। তাঁরা কীভাবে আল্লাহ্ তা'আলার ইবাদত করেছেন, কীভাবে দোআ আর মুনাজাত করেছেন আর কীভাবে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করেছেন এবং রাত জেগেছেন, তা ভালোভাবে শ্রবণ করে করে নিজের জীবনকে তাঁদের সাথে মিলানো।
১০। নামাযের প্রস্তুতি: আযানের অন্তত ১০মিনিট আগে পাকপবিত্র হয়ে মসজিদে অবস্থান করা, নবাগত মুছল্লিদের যেন কোনো সমস্যা না হয়। যাতে ইতিকাফকারীর দিলও প্রশান্তি পায়। নামাযের অপেক্ষমাণ মুছল্লিদের জন্য ফিরিশতাগণ রহমতের ও মাগফিরাতের দোআ করেন এবং যদি নামাযের পর আরও বেশিক্ষণ থেকে আমলে মশগুল থাকেন মুছল্লি তাহলে 'তার তাওবা যেন আল্লাহ পাক কবুল করেন' সেই দোআও করেন। ফিরিশতাদের দোআ আল্লাহ কবুল করেন।
১১। তাহাজ্জুদ ও তাসবীহ: রহমতের আশা আর আযাবের ভয় দিলে রেখে তাহাজ্জুদ ও সালাতুত তাসবীহ যতো পারা যায় পড়া। কারণ এসব নামায সবসময় পড়া হয় না ইতিকাফে এর গুরুত্ব দেয়া খুব দরকার। উক্ত দুই নামায পড়ে বান্দা যা-ই করে, আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত তাই দান করেন।
১২। ঈদের রাত: ঈদের রাতে ইবাদত বন্দেগীর অনেক বেশি ফজিলত। তিরমিযী ও সুনানে ইবনে মাজাহসহ অসংখ্য হাদীসের কিতাবে উল্লেখ আছে, যে ব্যক্তি দুই ঈদের রাত্রে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ইবাদত করবে কিয়ামতের দিন ঐ ব্যক্তির অন্তরকে আল্লাহ জীবিত রাখবেন (প্রশান্তি দান করবেন), যেদিন সমস্ত অন্তর মৃত্যুবরণ করবে। তাই ইতিকাফ ব্যক্তিদের কাছে আমার অনুরোধ তারা যেন ঈদের দিন সকালে মসজিদ থেকে বের হন।
-এটি