বশির ইবনে জাফর
মালয়েশিয়া থেকে
সাহরির সময় শেষ হতে তখনো দুই ঘণ্টা। ঐতিহাসিক শহিদি মসজিদ থেকে ভেসে আসতো সাইরেন এর আওয়াজ। আশপাশের সব মসজিদের মাইক থেকে মুয়াজ্জিন এর কণ্ঠে ধ্বণিত হতো হামদ নাতের নানান সুমধুর সুর।
‘সাহরির সময় হয়েছে, নিজে জাগুন অন্যকে জাগান’ এ আহ্ববানে ঘুম ঘুম চোখে শোনা যায় রান্নাঘর থেকে আসা খাবার তৈরির শব্দ। সাহরির শেষ সময়ে খাবার যখন পুরোপুরি তৈরি তখন আম্মু ডেকে দিতো সবাইকে। সাহরির সময় শেষ হবার আগে মসজিদের মাইক থেকে আবারও শোনা যেতো শতর্কতামূলক নানান আহ্ববান।
এ ছিলো বাংলাদেশের সাহরির সময়কার চিত্র। আবার ইফতার বুট-মুড়ি, বেগুনি-পেয়াজোসহ নানান রকমের বাহারি সব আইটেম।
সবই আজ সুদূর অতিতের খাতায় স্মৃতি হয়ে ঠাঁই নিয়েছে। চাইলেও আজ সে চিত্রের কোন চরিত্র আমি হতে পারছি না। কারণ আমি এখন প্রবাসে। হাজারো মাইল দূরের এ মালয়েশিয়ায়। যেখানে রোজার চিত্রগুলো আমার দেশ থেকে একদমই ভিন্ন। তবে প্রশান্তিময়।
ইফতারের ঘণ্টাখানেক আগ থেকেই স্থানীয় মুসলিমরা স্বপরিবারে গাড়ি নিয়ে মসজিদের দিকে ছুটতে থাকে। সবারই হাতে থাকে নানান রকমের খাবারের প্যাকেট। কোলের ছোট বাচ্চাগুলোকেও ধর্মীয় পোষাকে সাজিয়ে ঈদের আনন্দের মতো করে দলে দলে চলে আসে মসজিদে। ইফতারের আগেই মসজিদ ভরে যায় তাদের উপস্থিতিতে।
বিশাল বিশাল দস্তরখানে এক দিকে বাচ্চারা, একদিকে মুরব্বি এবং অন্য দিকে মহিলারা নিজেদের আসন নিয়ে বসে যায়। মসজিদ থেকে সবার জন্য ইফতারের আয়োজন রাখা হয়। এ আয়োজন শুধুমাত্র স্থানীদের জন্যই নয় বরং সবার জন্য উম্মুক্ত রাখা হয় বিধায় মালয়েশিয়াতে বাইরের যেসব দেশ থেকেই লোকেরা এসে বসবাস করছে পড়াশোনা কাজ বা ব্যবসার কারণে, সকলেই শরিক হয়।
সবার মুখে মুখে জিকিরের আওয়াজ আর নানাবিধ দোয়া-দুরুদের গুঞ্জরন শুনে মনে হয় যেন জান্নাতি এক মেহমানদারির আয়োজন শুরু হতে চলেছে। দু'হাত তুলে মাগরিবের আজান পর্যন্ত চলে মুনাজাত। এর পরই শুরু হয় ইফতারের খাওয়াদাওয়া পর্ব।
খাবারের মেনুতে থাকে একেকদিন একেক রকমের আয়োজন। ভাত, বিরিয়ানি, খিচুড়ি, গোশত, কুরমা, পোলাও সহ নানান রকমের পিঠা, পানীয়। ফল ফ্রুটের সাথে শেষে থাকে বিভিন্ন পদের চা। মোটকথা সারাদিন রোজার পর মানসম্মত ও শ্রেষ্ঠ কোন খাবার থাকলে সেটাই রাখা হয় এ আয়োজনে।
এখানে খাবারের পদ্ধতিটাও ভিন্ন। সবাইকে প্লেটে প্লেটে করে সব পদ সাজিয়ে দেয়া হয় না বরং যার যেটা খুশি এবং যতো খুশি নিজে নিয়ে খাবে। এজন্যই দেখা যায় খাবার নষ্ট কম হয়। কারণ যে যেই খাবার খায় না তাকে সে খাবার চাপিয়ে দেয়া হয় না যেটা আমাদের দেশের দাওয়াতগুলোতে সাধারণত হয়ে থাকে।
ইফতারের পর নামাজ শেষে সবাই বাড়ি ফিরে সবার কর্মে ব্যস্ত হয়ে যায় খানিকটা সময়। একটু পরই যখন ইশার আজান হয় তখন ফের দলে দলে ছুটে আসে মসজিদে।
যেন এটিই সবার সম্মিলনস্থল। মসজিদই যেন সবার সবচেয়ে আপন ঘর। এবাদত করতে এসে পারস্পরিক কুশল বিনিময়টাও যেন ‘আল মুসলিমু কাজাসাদিন ওয়াহিদিন, তথা মুসলিম সব এক দেহের ন্যায়’ এ হাদিসাংশের বাস্তবায়িত রূপ বলে মনে হয়।
এখানে সাহরিতে আমার দেশের মতো মসজিদ থেকে কোন আহ্বান শোনা যায় না। ভেসে আসে না হামদ-নাতের কোন মনকাড়া সুরের আওয়াজ। তবু সবাই নিজ নিজ দায়িত্বে উঠে যায়। সাহরি শেষ করে মসজিদে এসে ফজর আদায়ের মাধ্যমে নতুন দিনের সূচনা করে।
তারপর কর্মব্যাস্ততার মাঝেই নামাজের বিরতিতে একটু আগে ভাগেই সকলে চলে আসে জোহর আদায়ের জন্য। হাতে কুরআন নিয়ে বসে যায় ছোটবড় সকল মুসল্লি। নামাজ শেষে ফের কর্মব্যস্ত জীবন যেখানে যার যেভাবে চলছে তা চলতে শুরু করে।
এখানে রমজান এলে পরিবেশটা খুব আলাদা কিছু মনে হয় না যদিও, তবু দ্রব্যমূল্যে ছাড়, ইফতারে মেহমানদারি, রাতে তারাবিহের নামাজ এসব মিলিয়ে কিছুটা হলেও বুঝা যায় পবিত্র মাহে রমজান চলছে।
তাছাড়া মসজিদগুলোতে ইবাদতের চিত্র সারা বছরই বেশ সরব থাকে। ইবাদতে মানুষের একাগ্রতা ও ধীরতা-স্থিরতা দেখে ঈর্ষা হয়। মসজিদ ভিত্তিক সমাজ বলে মনে হওয়া যে চিত্র প্রতিটি মসজিদে বিরাজ করে তাতে প্রশান্তি ছুয়ে যায় মন থেকে মনে প্রতিটি হৃদয়ে। মনে হবে সারা বিশ্বের মুসলিমরা যদি এভাবেই চলে তবে সমাজে তৈরি হবে ভালোবাসা ও সম্প্রীতির এক অনন্য মেলবন্ধন।
-এটি