আব্দুল্লাহ আল মুকতাদির।
মানুষের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত যত বিধান রয়েছে এর কোনটিই উপকার থেকে খালি নয়৷ পৃথিবীর শুরুলগ্ন থেকে অদ্যাবধি কোন মানুষ আল্লাহ প্রদত্ত বিধানের গ্রহনীয় ক্ষতি দেখাতে পারেনি৷ প্রাচীন যুগ তো বটেই বর্তমানের আধুনিক বিজ্ঞান শত চেষ্টা করেও আল্লাহ প্রদত্ত বিধানের ক্ষতিকারক কোন দিক বের করতে পারেনি৷ কেননা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন- لَا يُكَلِّفُ ٱللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا
অর্থ: আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কোন কাজের ভার দেন না৷ (সূরা বাকারা, আয়াত: ২৮৬)
অপর আয়াতে আল্লাহ বলেন, إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَظْلِمُ ٱلنَّاسَ شَيْـًٔا وَلَٰكِنَّ ٱلنَّاسَ أَنفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ
অর্থ: আল্লাহ মানুষের উপর জুলুম করেন না, বরং মানুষ নিজেই নিজের উপর জুলুম করে। (সূরা ইউনুস-৪৪)
চলছে রমজান মাস৷ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ মাসে রোজাকে ফরজ করেছেন৷ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত উপবাস থাকার নির্দেশ দিয়েছেন৷ আল্লাহর প্রতিটি বিধানই মানব জাতির জন্যে কল্যাণকর। গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে রোজার মধ্যে প্রভূত কল্যাণ নিহিত রয়েছে। এই উপবাস থাকা বা রোজা রাখার উপকারিতা সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন, وَأَن تَصُومُوا۟ خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ
অর্থ: যদি তোমরা রোজা রাখ, তবে তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা তা বুঝতে পার। (সূরা আল বাকারা-১৮৪)
বস্তুত এ আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন রোজা পালনের নানাবিধ কল্যাণের প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান গবেষণা করে উপরোক্ত আয়াতে সত্যতা প্রমাণ করেছেন। রোজার প্রায় সকল হুকুম আহকাম স্বাস্থ্যরক্ষার দিকে লক্ষ্য রেখেই করা হয়েছে। যেমন- শিশু ও অতিবৃদ্ধের জন্য রোজা ফরজ নয়। সফরে ও অসুস্থ অবস্থায় রোজা না রাখার অনুমতি রয়েছে। ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় বেশি কষ্ট না পাওয়ার জন্যে সাহরীর ব্যবস্থা ইত্যাদি।
পাকিস্তানের প্রখ্যাত প্রবীণ চিকিৎসক ডা. মুহাম্মদ হোসেন বলেছেন, যারা নিয়মিত রোজা পালনে অভ্যস্ত সাধারণত তারা বাতরোগ, বহুমূত্র, অজীর্ণ, হৃদরোগ ও রক্তচাপজনিত ব্যাধিতে আক্রান্ত কম হোন৷
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রখ্যাত জার্মান চিকিৎসাবিদ ড. হেলমুট লুটজানার এর The Secret of Successful Fasting (উপবাসের গোপন রহস্য) বইটিতে মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গঠন ও কার্যপ্রণালী বিশ্লেষণ করা হয়েছে৷ এবং নিরোগ, দীর্ঘজীবী ও কর্মক্ষম স্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হলে বছরের কতিপয় দিন উপবাসের পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
ড. লুটজানারের মতে, খাবারের উপাদান থেকে সারাবছর ধরে মানুষের শরীরে জমে থাকা কতিপয় বিষাক্ত পদার্থ (টকসিন), চর্বি ও আবর্জনা থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র সহজ ও স্বাভাবিক উপায় হচ্ছে উপবাস। উপবাসের ফলে শরীরের অভ্যন্তরে দহনের সৃষ্টি হয়৷ এর ফলে শরীরের ভিতর জমে থাকা বিষাক্ত পদার্থসমূহ ধ্বংস হয়ে যায়।
এভাবে ধ্বংস না হলে, ঐসব বিষাক্ত পদার্থ শরীরের রক্তচাপ, একজিমা, অন্ত্র ও পেটের পীড়া বিভিন্ন রোগব্যাধির জন্ম দেয়। এছাড়াও উপবাস কিডনি ও লিভারের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং শরীরে নতুন জীবনীশক্তি ও মনে সজীবতার অনুভূতি এনে দেয়।
প্রখ্যাত স্বাস্থ্যবিজ্ঞানী ডা. শেলটন তার ‘সুপিরিয়র নিউট্রিশন’ গ্রন্থে বলেছেন- উপবাসকালে শরীরের মধ্যস্থিত, প্রোটিন, ফ্যাট ও শর্করা জাতীয় পদার্থসমূহ স্বয়ং পাচিত হয়। ফলে গুরুত্বপূর্ণ কোষগুলোতে পুষ্টি বিধান হয়। এই পদ্ধতিকে ‘এ্যান্টো লিসিস’ বলা হয়। এর ফলে শরীরে উৎপন্ন উৎসেচকগুলো বিভিন্ন কোষে ছড়িয়ে পড়ে। এটি হচ্ছে শরীর বিক্রিয়ার এক স্বাভাবিক পদ্ধতি। রোজা এই পদ্ধতিকে সহজ, সাবলীল ও গতিময় করে।
ডা. জুয়েলস এমডি বলেছেন, ‘যখনই একবেলা খাওয়া বন্ধ থাকে, তখনই দেহ রোগমুক্তির সাধনায় নিয়োজিত থাকে।’
রোজা একই সাথে দেহে রোগ প্রতিষেধক ও প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। রোজা পালনের ফলে দেহে রোগ জীবাণুবর্ধক জীর্ণ অন্ত্রগুলো ধ্বংস হয়, ইউরিক এসিড বাধাপ্রাপ্ত হয়। দেহে ইউরিক এসিডের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে বিভিন্ন প্রকার নার্ভ সংক্রান্ত রোগ বেড়ে যায়। রোজাদারের শরীরের পানির পরিমাণ হ্রাস পাওয়ার ফলে চর্মরোগ বৃদ্ধি পায় না।
ডা. আলেক্স হেইগ বলেছেন, ‘রোজা হতে মানুষের মানসিক শক্তি এবং বিশেষ বিশেষ অনুভূতিগুলো উপকৃত হয়। স্মরণশক্তি বাড়ে, মনোসংযোগ ও যুক্তিশক্তি পরিবর্ধিত হয়। প্রীতি, ভালোবাসা, সহানুভূতি, অতীন্দ্রিয় এবং আধ্যাত্মিক শক্তির উন্মেষ ঘটে। ঘ্রাণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি প্রভৃতি বেড়ে যায়। এটা খাদ্যে অরুচি ও অনিচ্ছা দূর করে। রোজা শরীরের রক্তের প্রধান পরিশোধক। রক্তের পরিশোধন এবং বিশুদ্ধি সাধন দ্বারা দেহ প্রকৃতপক্ষে জীবনীশক্তি লাভ করে। যারা রুগ্ন তাদেরকেও আমি রোজা পালন করতে বলি।’
জার্মানির এক স্বাস্থ্য ক্লিনিকের গেইটে লেখা রয়েছে, ‘রোজা রাখো স্বাস্থ্যবান হও। এর নিচে লেখা আছে ‘মোহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ।’
সুতরাং বুঝা গেল, রোজার দ্বারা রক্তের যে পটাসিয়াম কমে তা অতি সামান্য এবং স্বাভাবিক সীমারেখার মধ্যে। তবে রোজা দ্বারা কোন কোন মানুষ কিছুটা খিট খিটে মেজাজী হয়। এর কারণ সামান্য রক্ত শর্করা কমে যায় যা স্বাস্থ্যের পক্ষে মোটেই ক্ষতিকর নয়। অন্য কোন সময় ক্ষিধে পেলেও এরুপ হয়ে থাকে।
রোজা কম খাওয়ার প্রশিক্ষণ। কিন্তু রোজা ছাড়াও ইসলাম কম খাওয়াকে উৎসাহিত করে। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ‘পেট ভর্তি করে খাওয়া অপেক্ষা মানুষের জন্য মন্দ দ্বিতীয় কোনো কাজ নেই। আদম সন্তানের বেঁচে থাকার জন্য কয়েক লোকমা খাবারই যথেষ্ট। যদি তা না করে (অর্থাৎ বেশি খেতে চায়) তাহলে পেটের এক তৃতীয় অংশ খাবার, এক তৃতীয় অংশ পানি এবং অপর তৃতীয় অংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য খালি রাখা দরকার।’ (আহমদ, ইবনে মাজাহ, হাকেম)
এমডব্লিউ/