জুবায়ের রশীদ
তরুণ আলেম ও লেখক
আমাদের দুয়ারে কড়া নেড়েছে মহিমান্বিত মাস রমজান। রমজান রহমতের মাস। বরকতের মাস। নাজাতের মাস। রাশি রাশি পুণ্যের মাস। কল্যাণ লাভের অনুপম উপলক্ষের মাস। জীবনের অতীত গোনাহ মোচনের মাস। মহান রবের নৈকট্য অর্জনের মাস।
এই মাস প্রাপ্ত প্রতিটি মুমিন নর নারীর জন্য মহান প্রভুর দরবারে অগণন শুকরিয়া আদায় করা উচিত। এই মাস প্রাপ্তি একটি বিরাট সৌভাগ্য। হযরত নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান মাস পাওয়ার জন্য দুয়া করতেন আল্লাহর নিকট। বছর ঘুরে আমাদের জীবনে এসেছে পরম আকাঙ্ক্ষিত সেই মাস। তাই রমজান মাসের পরিপূর্ণ হক আদায় করা আবশ্যিক কর্তব্য।
আল্লাহ তায়ালা কিছু ইবাদত সর্বকালে সকল উম্মতকেই দিয়েছেন। তন্মধ্যে বিশেষ একটি হলো রোজা। দয়াবান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন, হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর, যাতে তোমরা মুত্তাকী-সংযমী হতে পার।-(সূরা বাকারা, আয়াত : ১৮৪)
রোজার গুরুত্বের কথা বলতে গিয়ে আল্লাহর রাসুল বলেন, হযরত আবু উমামা রা. বর্ণনা করেন, আমি বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমাকে কোনো আমলের আদেশ করুন। তিনি বললেন, তুমি রোজা রাখ, কেননা এর সমতুল্য কিছু নেই। আমি পুনরায় বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে কোনো নেক আমলের কথাবলুন, তিনি বললেন, তুমি রোজা রাখ, কেননা এরকোনো সমতুল্য কিছু নেই। মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ২২১৪০। সুনানে নাসায়ী কুবরা, হাদীস : ২৫৩৩।
হযরত আবু উমামা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমাকে এমন কোনো আমলের আদেশ করুন, যার দ্বারা আল্লাহ তায়ালা আমাকে উপকৃত করবেন। তিনি বললেন, তুমি রোজা রাখ, কেননা তার তুলনা হয় না।-সুনানে নাসায়ী, হাদীস : ২৫৩১। বাইহাকী, শুয়াবুল ঈমান ৩৮৯৩।
হাদীসে রোজার প্রভূত ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। যার দ্বারা আল্লাহর নিকট রোজাদারদের সম্মান ও বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়।
হযরত সাহল ইবনে সা’দ রা. হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, জান্নাতে একটি দরজা আছে, যার নাম রাইয়ান। কিয়ামতের দিন এ দরজা দিয়ে কেবল রোজদার ব্যক্তিরাই প্রবেশ করবে। অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারবে না।
ঘোষণা করা হবে- কোথায় সেই সৌভাগ্যবান রোজাদারগণ? তখন তারা উঠে দাঁড়াবে। তারা ব্যতীত কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। অতঃপর রোজাদারগণ যখন প্রবেশ করবে, তখন তা বন্ধ করে দেওয়া হবে। ফলে কেউ ঐ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। -সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৮৯৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১১৫২
হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রমযান মাসের রোজা রাখবে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।- সহীহ বুখারী, হাদীস : ৩৮, ২০১৪।
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, মানুষের প্রত্যেক আমলের প্রতিদান বৃদ্ধি করা হয় একটি নেকীর সওয়াব দশ গুণ থেকে সাতাশ গুণ পর্যন্ত। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, কিন্তু রোজা আলাদা। কেননা তা একমাত্র আমার জন্য এবং আমি নিজেই এর বিনিময় প্রদান করব। বান্দা একমাত্র আমার জন্য নিজের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং পানাহার পরিত্যাগ করেছে।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১১৫১। সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ১৬৩৮।
রোজার ফজিলত যেমন রয়েছে তেমনি কোন মুসলমান রোজা ফরজ হওয়া সত্ত্বেও যদি রোজা না রাখে তার জন্য রয়েছে কঠিনতর শাস্তির ঘোষণা।
হাদীসে বর্ণিত আছে, হযরত আবু উমামা রা. বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। স্বপ্নে দেখলাম আমার নিকট দুই ব্যক্তি আগমন করল। তারা আমার বাহুদ্বয় ধরে আমাকে এক দুর্গম পাহাড়ে নিয়ে এল। তারপর আমাকে বলল, আপনি পাহাড়ের উপর উঠুন। আমি বললাম, আমি তো উঠতে পারব না। তারা বলল, আমরা আপনাকে সহজ করে দিব। আমি উপরে উঠলাম। যখন পাহাড়ের সমতলে পৌঁছালাম, হঠাৎ ভয়ঙ্কর আওয়াজ শুনতে পেলাম।
আমি বললাম, এসব কিসের আওয়াজ? তারা বলল, এটা জাহান্নামীদের আর্তনাদ। তারপর তারা আমাকে নিয়ে এগিয়ে চলল। হঠাৎ কিছু লোক দেখতে পেলাম, যাদেরকে তাদের পায়ের মাংসপেশী দ্বারা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এবং তাদের মুখের দুই প্রান্তছিড়ে ফেলা হয়েছে এবং তাথেকে রক্ত ঝরছে। আমি বললাম, এরা কারা? তারা বলল, যারা ইফতারের সময় হওয়ার আগেই রোজা ভেঙ্গে ফেলে।-সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৭৪৪৮। সুনানে নাসায়ী কুবরা, হাদীস : ৩২৮৬।
রমজান মাস সর্বদিকেই একটি ব্যাপক ও ব্যাপৃত মাস। রোজার ইবাদত পূর্বেকার সকল উম্মতের উপর ফরজ ছিল। এর গুরুত্ব সীমাহীন। এর ফজীলত অগাধ, অসীম। এবং কেউ যদি অবাধ্যতা করে তাহলে রবের তরফ থেকে তার আযাবও খুব কঠোর। আল্লাহ আমাদেরকে এ মাসের যথাযথ সম্মান রক্ষা করার তৌফিক দিন। অতীত গোনাহ থেকে নিষ্কলুষ হয়ে প্রকৃত মুমিন এবং আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করে নিন।
আরএম/