উপমহাদেশের প্রখ্যাত মুসলিম কবি ও দার্শনিক আল্লামা ইকবাল। যিনি তার অসামান্য রচনার মাধ্যমে ইংরেজ অপশাসনে স্থবির ও হতাশাগ্রস্থ ভারতীয় মুসলিম জাতিকে জাগিয়ে তোলেন এবং স্বাধীন সার্বভৌম মুসলিম ভারতের স্বপ্ন দেখান।
কালজয়ী এ মুসলিম মনীষীকে কাছ থেকে দেখেছেন, মিঞা আলি বখশ। যিনি দীর্ঘদিন আল্লামা ইকবালের গৃহপরিচারক ছিলেন। পাকিস্তানি সাংবাদিক মোমতাজ হাসান ২৩ সেপ্চেম্বর ১৯৫৭ সালে তার একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। যা ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হয়।
দীর্ঘদিন পর পাকিস্তানের অপর সাংবাদিক এম মোয়েজুদ্দিন সংগ্রহ করেন এবং তা পুনর্প্রকাশ করেন। আওয়ার ইসলামের পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি বাংলা ভাষায় তুলে ধরা হলো।
প্রশ্ন : আল্লামা ইকবার কখন ঘুম থেকে উঠতেন?
উত্তর : তিনি খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি খুব সামান্যই ঘুমাতেন। খুব গুরুত্বের সঙ্গে ফজরের নামাজ আদায় করতেন। নামাজের পর কুরআন তেলাওয়াত করতেন।
প্রশ্ন : তিনি কোন ঢঙ্গে কুরআন তেলওয়াত করতেন?
উত্তর : অসুস্থ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি উচ্চ আওয়াজে সুললীত কণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াত করতেন। কণ্ঠবসে যাওয়ার পরও তিনি কুরআন তেলাওয়াত করতেন, তবে নিচু আওয়াজে।
প্রশ্ন : নামাজ ও তেলাওয়াত শেষ করে কি করতেন?
উত্তর : নামাজ ও তেলাওয়াত শেষে তিনি আরাম কেদারায় গা এলিয়ে দিতেন। আমি হুক্কা রেডি করে দিতাম। তিনি হুক্কা নিতেন এবং আদালতে তার প্রতিদিনের কেসগুলোর উপর চোখ বুলিয়ে নিতেন। কখনো কখনো এ সময় কবিতার ভাব আসতো এবং কবিতা লিখতেন তিনি।
প্রশ্ন : তার কবিতার ভাব এসেছে কিভাবে বুঝতেন?
উত্তর : তিনি আমাকে ডাকতেন বা তালি বাজাতেন। বলতেন, আমার খাতা ও কলমদানি নিয়ে এসো। নিয়ে আসলে তিনি কবিতা লিখতেন। পছন্দ না হলে খুব অস্থির হয়ে যেতেন। কবিতা রচনার সময় প্রায় কুরআন শরিফ নিয়ে আসতে বলতেন।
কবিতা আবৃত্তি ছাড়াও তিনি দিনে কয়েকবার আমাকে দিয়ে কুরআন শরিফ আনাতেন।
প্রশ্ন : কোর্টে যাওয়ার সময় কি করতেন?
উত্তর : আদালত শুরু হওয়ার দশ-পনের মিনিট পূর্বে রওনা হতেন। তার বাড়ি ছিলো কোর্টর কাছেই লাহোর নিউ মার্টেক এলাকায়। প্রথম দিকে ঘোড়ায় যেতেন এবং শেষ জীবনে গাড়িতে যেতেন।
প্রশ্ন : ওকালাত পেশায় কতোটুকু সময় দিতেন?
উত্তর : ওকালতি পেশায় তিনি নির্ধারিত পরিমাণের বেশি দিতেন না। সাধারণত তার হাতে যদি ৫০০ রুপি পারিশ্রমিকের কোনো কেস থাকতো, তবে নতুন কেস গ্রহণ করতেন না।পরবর্তী মাসে দেখা করার পরামর্শ দিতেন। মাসের শুরুতে ৪০০-৫০০ রুপি পারিশ্রমিকের কোনো কেস পেয়ে গেলে বাকি মাসে নতুন কেস গ্রহণ করতেন না।
প্রশ্ন : ৫০০ রুপিতে পরিতৃপ্ত থাকতেন কেনো?
উত্তর : তার হিসেব ছিলো, মাসে তার ৫০০ রুপির বেশি খরচ হবে না। সে যুগে এ টাকায় তার বাড়িভাড়া, কর্মচারী বেতন, পেশকারের মাসোহারা ও গৃহস্থালী প্রয়োজন পূরণ হয়ে যেতো। আল্লামা ইকবাল তখন আনারকলি ও মিকলোড রোডে বাস করতেন।
প্রশ্ন : তিনি কতোদিন পর্যন্ত ওকালতি করেন?
উত্তর : গলার রোগে আক্রান্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি ওকালতি করেন। সম্ভবত তিনি ১৯৩২-৩৩ সালে গলার রোগে আক্রান্ত হন।
প্রশ্ন : গলার রোগ কিভাবে শুরু হয়?
উত্তর : তখন শীতকাল। তিনি ঈদের নামাজ পড়তে গেলেন। ঘরে ফিরে প্রচুর পরিমাণ ‘ডালকর’ (বিশেষ পানীয়) পান করলেন। এটা তিনি খুব পছন্দ করতেন। আগের দিনই গলায় ব্যথা করছিলো। সেদিন গভীর রাত পর্যন্ত তিনি কেশেছিলেন। পরের দিন তার কণ্ঠ বসে যায়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার কণ্ঠ আর ভালো হয় নি।
প্রশ্ন : আদালত থেকে ফিরে কি করতেন আল্লামা ইকবাল?
উত্তর : ফিরেই বলতেন, কাপড় পাল্টানোর ব্যবস্থা কর। অফিসিয়াল পোশাক তিনি পছন্দ করতেন না। আদালতে যাওয়ার সময় বাধ্য হয়ে পরতেন এবং ফিরেই তা থেকে মুক্তি পেতে চাইতেন।
যদি তার কবিতা লেখার ইচ্ছে হতো, তবে আমাকে খাতা-কলম দিতে বলতেন।
প্রশ্ন : মামলার জন্য বিশেষ কোনো প্রস্তুতি কি তিনি নিতেন?
উত্তর : পরবর্তী দিনে কোনো মামলা থাকলে তিনি তার দৃষ্টান্ত দেখে নিতেন। নতুবা ওকালতির জন্য তার বিশেষ কোনো সময় বরাদ্দ ছিলো না।
প্রশ্ন : আর কিছুই করতেন না?
উত্তর : পরবর্তী দিন যে মামলা থাকতো তার কাগজপত্র দেখে নিতেন। তাছাড়া আর কিছুই করতেন না।
প্রশ্ন : দিনে ঘুমানোর অভ্যেস ছিলো?
উত্তর : মনে হয়, ছিলো না। তবে কখনো কখনো ঘুমাতেন।
প্রশ্ন : তার ঘুম কেমন ছিলো?
উত্তর : খুব হালকা। সামান্য আওয়াজে ভেঙ্গে যেতো?
প্রশ্ন : রোগ, বালাই ও কষ্ট সহ্য করতে পারতেন?
উত্তর : কোমল হৃদয়ের মানুষ ছিলেন। কষ্ট সহ্য করতে পারতেন না। অন্য কারো কষ্টও সহ্য করতে পারতেন না। রক্ত দেখতে পারতেন না। একবার তার পায়ে বিড়াল কামড় দেয়। তিনি এতোটা ভেঙ্গে পড়েন যে, নড়াচড়া করতেও আমার সহযোগিতা নিতেন। একবার আঘাতে তার ঘরের একজনের সামান্য রক্ত বের হয়। রক্ত দেখে তার মূর্ছা যাওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হয়।
প্রশ্ন : খাবার কখন খেতেন?
উত্তর : ১২টা থেকে ১টার মাঝে। রাতের খাবারে নির্ধারিত সময় ছিলো না।
প্রশ্ন : আল্লামা ইকবার কি খেতে পছন্দ করতেন?
উত্তর : পোলাও, মাশকালাইয়ের ডাল, কিমা ও খুশকা। তবে হ্যা, তিনি একসাথে বেশি খেতেন না। কম খেতেন কিন্তু ভালো খেতেন।
প্রশ্ন : অপছন্দ করতেন কি?
উত্তর : মিষ্টি পায়া ও ঠাণ্ডা গোশত।
প্রশ্ন : শরীর চর্চা করতেন?
উত্তর : আনারকলিতে যতোদিন ছিলেন শরীরচর্চা করতেন। ঘাম ছোটা পর্যন্ত পরে তা ছুটে যায়।
প্রশ্ন : কোনো খেলার প্রতি আসক্তি ছিলো?
উত্তর : নৌকা বাইচ আগ্রহ ভরে দেখতেন।
প্রশ্ন : আর কিসের প্রতি তার আগ্রহ ছিলো?
উত্তর : প্রথম দিকে কবুতর পালার শখ ছিলো। মাঝে মাঝে তাসও খেলতেন।
প্রশ্ন : বিকেলে ঘুরতে বের হতেন?
উত্তর : বিকেলে ঘুরতে বের হওয়া তার জন্য প্রায় অসম্ভব ছিলো। তখন তিনি খ্যাতির শীর্ষে। ভক্তরা ঘরে বাইরে ভিড় করে থাকতো। অধিকাংশ দিন হাকিম শাহবাজুদ্দিনের বাড়ির আঙিনায় আড্ডা দিতেন। কখনো কখনো স্যার জুলফিকার আলি তার মোটর গাড়ি নিয়ে আসতেন এবং তাকে ঘুরতে নিয়ে যেতেন।
প্রশ্ন : রাতে কখন ঘুমাতেন?
উত্তর : সন্ধ্যায় বন্ধুদের আড্ডা হতো। সবশেষে বিদায় নিতেন চৌধুরী মুহাম্মদ হুসাইন। সাধারণত রাত ১০টায় আড্ডা ভাঙ্গতো। এরপর চৌধুরী মুহাম্মদ হুসাইনকে তার নতুন লেখা কবিতা পড়ে শোনাতেন। চৌধুরী সাহেব রাত ১টা পর্যন্ত থাকতেন।
এরপর আল্লামা ইকবাল ঘুমাতে যেতেন। ২-৩ ঘণ্টা ঘুমিয়ে তাহাজ্জুদের জন্য উঠে যেতেন তিনি। কখনো তার তাহাজ্জুদ কাজা হতো না।
প্রশ্ন : তাহাজ্জুদের পর কি করতেন?
উত্তর : তাহাজ্জুদের পর তিনি শুয়ে বিশ্রাম করতেন। আজানের সাথে উঠে যেতেন এবং জামাতে অংশগ্রহণ শরিক হতেন। এ সময় তিনি কবিতাও লিখতেন।
প্রশ্ন : সাধারণত তার কবিতার ভাবোদয় কখন হতো?
উত্তর : সাধারণত রাতের বেলায় তার কবিতার ভাবোদয় হতো। রাতের দুইটা আড়াইটার দিকে। যখনই কবিতা লেখার ইচ্ছে করতেন খাতা-কলম ও কুরআন চেয়ে নিতেন।
প্রশ্ন : কখনো রাগ হতেন?
উত্তর : নরম স্বভাবের ও কোমল হৃদয়ের মানুষ ছিলেন। সাধারণত রাগ হতেন না। আবার কখনো রাগ হলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন না।
তার হৃদয়ের কোমলতা বোঝা যায় একটি ঘটনা থেকে। একবার ঘরে চোর প্রবেশ করলো। আমাদের একজন ধরে পিটাতে লাগলো। আল্লামা এসে মারতে নিষেধ করলেন। তারপর নিজে চোরকে খাবার খাওয়ালেন এবং তাকে মুক্ত করে দিলেন।
(বাংলায় ভাষান্তর করেছেন আতাউর রহমান খসরু)
আরএম/