আশির দশকের শেষের দিকের কথা। আমি তখন হিফজখানায় পড়ি। শৈশবের কচি মনে মজা করে শিশুতোষ গল্পের বই পড়তাম। এখন যেমন ছোটদের বেশ ইসলামি বইপত্র পাওয়া যায়, আমাদের সময় তেমন কোনো শিশুতোষ ইসলামি বই ছিল না। মজার বই বলতে ছিল ঠাকুরমার ঝুলি, গোপালভাঁড়ের গল্প, ঈশপের গল্প প্রভৃতি। তখন কয়েক দিন ধরে লাগাতার বৃষ্টি হতো। আমরা বলতাম, আকাশ ফুটো হয়ে গেছে।
সেই বৃষ্টিভেজা দিনগুলোতে অলস বিকেলে মাদরাসায় ঘরের এক কোণায় বসে সহপাঠীদের গল্পগুলো শোনাতাম। সবাই হা করে গল্পগুলো গিলত। ওই সময় ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে ছোটদের জন্য বেশ কিছু বই প্রকাশ করা হয়। মাদরাসার বার্ষিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রকাশ করা বইগুলো থেকে একটি বই উপহার পেলাম। সেই সুবাদে জানলাম, তাদের প্রকাশনায় আরও বই আছে। কিছু বই কিনলাম, কিছু বই মসজিদের পাঠাগার থেকে নিয়ে এনে পড়লাম।
একদিন শখের বশে একটি কবিতা লিখে ফেললাম। সাহিত্যের কিছুই বুঝতাম না তখন। এখনও যে বুঝি, তা কিন্তু নয়। তখন শুধু বুঝতাম বাক্যের শেষে ছন্দের মিল হলেই কবিতা হয়ে যায়। অনেকেই মনে করে এভাবে লিখলেই কবিতা হয়ে যায়। তাই লেখালেখির ক্ষেত্রে কবিতাটাই খুব সহজ। আমিও তাই মনে করতাম। এখন অবশ্য এতোটুকু বুঝি, সাহিত্যের সবচেয়ে কঠিন শাখা হচ্ছে কবিতা লেখা। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বইগুলোর মাঝে মাঝে ছোট ছোট কবিতা থাকত। তা দেখে আমিও কবিতা লেখার কসরত করতাম। যেমন হজরত সুলায়মান আ.-এর একটি ঘটনা পড়ার পর গল্পটির শেষে লিখলাম-
সুবিচার করলেন
বালক সুলাইমান,
তাঁরই তৈরি বায়তুল মোকাদ্দাস
আজও আছে বিদ্যমান।
ঝোঁকের বশে কবিতাটি লেখার পর পত্রিকায় প্রকাশের তাগিদ অনুভব করলাম। একটি কাগজে লিখে স্থানীয় একটি পত্রিকার অফিসে গিয়ে তা জমা দিয়ে এলাম। তারা ছাপালো না। এরপর আরেকটি পত্রিকার অফিসে গিয়ে কবিতাটি জমা দিয়ে এলাম। তারাও ছাপালো না। এরই মধ্যে আরও কয়েকটি কবিতা লিখে ফেললাম। (এগুলোর একটিও সংরক্ষণ করা হয়নি।) স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে কবিতাগুলো পাঠালাম। ওগুলো কোথাও ছাপা হলো না। মনে জেদ চাপল, পত্রিকায় লেখা আসতেই হবে। এভাবে হিফজ শেষ হওয়ার পর যখন কিতাব বিভাগে ভর্তি হলাম, তখন একটি কবিতা লিখলাম। তারিখটা ছিল ১৯৮৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। কবিতাটি রাজশাহীর স্থানীয় পত্রিকা ‘সোনার দেশ’-এর অফিসে গিয়ে জমা দিয়ে এলাম এবং অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
মাদরাসার আশেপাশে বেশ কয়েকটি পত্রিকার স্টল ছিল। নিয়মিত সেখানে গিয়ে পত্রিকার পাতা উল্টিয়ে দেখতাম। বহু আশা নিয়ে ছাপানো কবিতাগুলোর দিকে নজর বুলাতাম। না, আমার কবিতা ছাপানো হয়নি।
মাসখানেক পর ভেবে নিলাম, আগের মতো এটিও ছাপানো হবে না। তারপরও নিয়মিত সাহিত্যপাতা পড়তাম। পড়তাম মানে, মনে মনে খুঁজতাম, এই বোধহয় দেখব, সেখানে আমার কবিতা ছাপানো হয়েছে। এভাবে তিন মাস পর একদিন আনমনে পত্রিকার পাতা উল্টাচ্ছি। হঠাৎ একটি কবিতার ওপর চোখ আটকে গেল। আরে, এ যে, আমার কবিতা! পত্রিকার পাতায় আমার কবিতা ছাপা হয়েছে! বুকভরা আশা নিয়ে পত্রিকার পাতায় নিজের লেখা নিয়মিত খুঁজলেও ওই সময় আমার বিশ্বাসই হচ্ছিল না, পত্রিকার পাতায় আমার কবিতা ছাপা হয়েছে। ছাপার অক্ষরে প্রথমবারের মতো নিজের নাম দেখে সারা শরীরে এমন এক আনন্দানুভূতি ছেয়ে গেল, তা শুধুই অনুভব করা যায়, ব্যক্ত করা যায় না।
১৯৮৯ সালের ২২ মে ‘সোনার দেশ’ পত্রিকায় আমার জীবনের প্রথম লেখা ছাপা হলো। আমি পত্রিকার বেশ কয়েকটি কপি কিনলাম। পরিচিত কয়েকজনকে তা দিয়ে বললাম, আমার কবিতা ছাপা হয়েছে। এভাবে নিজের আনন্দ ছড়িয়ে দিতে গিয়ে আরও আনন্দ উপভোগ করলাম।
কবিতার নাম ছিল ‘লেখাপড়া’। আমার নাম ছাপা হয়েছিল ‘হাফেজ ইমতিয়াজ আহমদ’। মানের দিক দিয়ে সেই কবিতাটি কোনোভাবেই জাতের নয়, তবে শৈশবের এ কবিতাটি পত্রিকার পাতায় ছাপা হওয়ায় আমার মনের মধ্যে এক ধরনের উৎসাহের ঢেউ জেগে ওঠে। এভাবেই আস্তে আস্তে আজ এতোদূর।
ড. ইমতিয়াজ বিন মাহতাব : লেখক ও শিক্ষাবিদ, রাজশাহী
[লেখা ও লেখকের কথা নিয়ে প্রকাশিত সাময়িকী ‘লেখকপত্র’ এর সৌজন্যে]