ওয়াজ মাহফিল মানুষকে সদুপোদেশ দেয়া। তাদের কল্যাণের পথে ডাকার পথ এ মাধ্যম। নবী-রাসুল আ. সাধারণ মানুষকে সত্যের পথে যে আহবান জানাতেন তারই প্রচলিত রূপ। আলেমগণ সে পদ্ধতিকে অবলম্বন করে সাধারণ মানুষকে অপরাধমুক্ত রাখার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন যুগের পর যুগ।
তবে বর্তমানে ওয়াজ মাহফিল নিয়ে শ্রোতা মহলের অভিযোগ অনেক। প্রথমেই তারা অভিযোগের তীর ছুঁড়ছেন বক্তার দিকে। বক্তার নানা অসঙ্গতির কথা উঠে আসছে তাদের অভিযোগে।
সেইসব অসঙ্গতি ও অভিযোগের নিয়ে কথা বললেন দেশের প্রখ্যাত ওয়ায়েজ ও রাজধানীর নিউ এলিফ্যান্ট রোডে অবস্থিত বায়তুল মামুর জামে মসজিদের খতিব ও দারুল উলুম রহমানিয়া মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা হাসান জামিল।
কথা বলেছেন আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকমের বার্তা সম্পাদক রকিব মুহাম্মদ।
আওয়ার ইসলাম: বাংলাদেশে ওয়াজ-মাহফিলের বিশাল ময়দান তৈরি হয়েছে। ওয়াজ-মাহফিলের আলোচক-ওয়ায়েজ বা বক্তাদের কেমন মনমানসিকতা থাকা উচিৎ বলে আপনি মনে করেন?
মাওলানা হাসান জামিল: ওয়ায়েজ বা বক্তা দাওয়াত ও তাবলিগের নিয়তে ওয়াজ করবে। মানুষের হৃদয়ে ঈমানজাগানিয়া আহ্বান পৌঁছে দেওয়ার নিয়ত থাকতে হবে। ওয়াজের মাধ্যমে যেন শ্রোতা আখেরাতমুখী হয় এমন মাননসিকতা নিয়ে কুরআন-হাদিসের আলোকে বয়ান করতে হবে।
অবশ্যই বাড়তি কোন কথা ওয়াজ থেকে পরিহার করতে হবে। আর শ্রোতাদের মধ্যে এমন মানসিকতা থাকবে যে আমি এমন ওয়াজ শুনব যে ওয়াজে আমার মধ্যে ঈমানী চেতনা জাগবে, আমার দিল আখিরাতমুখী হবে।
আওয়ার ইসলাম: বর্তমানে ওয়াজীনদের সম্পর্কে একটি অভিযোগ শোনা যাচ্ছে, অধিকাংশ ওয়ায়েজের মধ্যে ইখলাস নেই। আপনিও কি তাই মনে করেন?
মাওলানা হাসান জামিল: ইখলাস নেই, ব্যাপকহারে এ কথা বলব না, আমার দেখা অনেকে আছে তারা ইখলাসের সাথেই ওয়াজ করে থাকেন। তবে ব্যতিক্রম যে নেই, একথা অস্বীকার করার মতো না।
আওয়ার ইসিলাম: ওয়াজ-মাহফিলের মাধ্যমে শ্রোতাদের মধ্যে কতটুকু পরিবর্তন আসছে বলে আপনি মনে করেন?
মাওলানা হাসান জামিল: আমি খুব কাছ থেকে অনেকের পরিবর্তন দেখেছি। অনেকে এসে, ওয়াদা করেছেন যে তারা ঠিকমতো নামাজ আদায় করবে, দাড়ি রাখবে। তবে কিছু ওয়াজের মাধ্যমে শ্রোতাদের মধ্যে বিরুপ মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছে। এগুলো নিয়ে ইউটিউবে ট্রল হচ্ছে।
মজমা জমানোর জন্য অনেকে অশালীন বক্তব্য দিয়ে থাকেন যার মাধ্যমে শ্রোতাদের মধ্যে একটা বিরুপ মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছে। এ সমস্ত ওয়াজ করা আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক।
আওয়ার ইসলাম: আমরা লক্ষ্য করছি, বর্তমানে ওয়াজের মাঠে এখন আলেমদের মধ্যে কোয়ালিটি এসেছে, তারা গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও সুন্দর উপস্থাপনের মাধ্যমে ওয়াজ করছেন। শ্রোতাদের মধ্যে এমন কোন পরিবর্তন এসেছে কিনা?
মাওলানা হাসান জামিল: সাধারণ শ্রোতা যেমন আছে, শিক্ষিত শ্রোতাও তেমন আছে। কুরআন-হাদিসের আলোকে তাত্বিক আলোচনা করলে সে কথা শ্রোতারা গ্রহণ করেন না, এমনটি এখনো আমি পাইনি। আসলে সব শ্রেণির শ্রোতাই আলেমদের ওয়াজ শুনে থাকেন। ভালো আলোচনা হলে তারা শুনতে রাজি।
আওয়ার ইসলাম: কুরআন-হাদিসের আলোকে আমাদের ওয়াজের ভাব-ভাষা এবং কণ্ঠ কেমন হওয়া উচিৎ বলে আপনি করেন?
মাওলানা হাসান জামিল: পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, সুন্দর নসিহত ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহর রাস্তায় আহ্বান করতে হবে। সুতরাং, ওয়াজ নসিহতমূলক এবং প্রজ্ঞাপূর্ণ হবে। হেকমত বলতে আমি মনে করি, শ্রোতারা গ্রহণ করে এমন সঙ্গতিপূর্ণ সুন্দর ও মাধুর্যপূর্ণ ভাষায় ওয়াজ করা।
একটু সুর দিলে যদি শ্রোতারা আকর্ষিত হয় তবে সুর দিলেও কোন ক্ষতি হবে বলে আমি মনে করি না। আবার একটু উঁচু কণ্ঠে ওয়াজ করলে শ্রোতারা যদি উজ্জিবীত হয় সেক্ষেত্রেও কোনকরম ক্ষতি আছে বলে আমার মনে হয় না। কুরআন-হাদিসের বাইরে না গেলেই হলো।
আওয়ার ইসলাম: বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ায় উঁচু কণ্ঠের ওয়াজ নিয়ে একটি বিতর্ক শুরু হয়েছে। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
মাওলানা হাসান জামিল: আগে জানতাম, উঁচু কণ্ঠের ওয়াজে বাম ঘরানার লোকদের অন্তর জ্বলে, এখন আমাদের ঘরানার মানুষরাও কেন এ ব্যাপারে উপহাস করছেন তা আমি বুঝতে পারছি না। তারা কি হাদিস পড়ে নাই?
বক্তব্য প্রদানকালে মাঝেমাঝে আল্লাহর রাসুলকে কমান্ডার বলে মনে হতো, তিনি সৈনিকদের কমান্ড করছেন বলে মনে হতো। হাদিসে এ শব্দও এসেছে যে মাঝে মাঝে তাঁর চোখ লাল হয়ে যেত, গলার রগ ফুলে উঠত।
আল্লাহর রাসুল সা. এর বক্তব্যের ক্ষেত্রে এরকম পরিস্থিতি আসতে পারলে, আমাদের কেউ যদি উঁচু কণ্ঠে ওয়াজ করে তো এখানে কোন সমস্যা তো আমি দেখছি না। শ্রোতাদের উজ্জিবীত করতে এগুলো কোন সমস্যা না।
আবার অনেকে ‘আমেরিকা নিপাত যাবে’ এরকম একটা বক্তব্যের জের ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রল করছে। আমি বলব, আল্লাহর রাসুল সা. এর ভবিষ্যৎবাণী, একদিন দুনিয়ার সমস্ত কাঁচাপাকা ঘরে ইসলাম পৌঁছে যাবে। তাহলে এখানে বসে, আমেরিকা নিপাতের স্বপ্ন দেখলে সমস্যা কোথায়? নবিজীর ভবিষ্যৎবাণী থাকলে আমরা কেন স্বপ্ন দেখতে পারব না?
কেউ গরম বয়ান করবে মানুষকে উজ্জিবীত করার জন্য, কেউ নরম বয়ান করবে মানুষের দিল নরম করার জন্য। যে যার কাজ করতে চাই, তাকে তার কাজ করতে দেওয়া উচিৎ।
আপনার নরম বয়ান ভালো লাগে আপনি সেটা শোনেন কিন্তু যদি কেউ গরম বয়ান করে তাকে কেন সমালোচনার পাত্র বানাবেন? তাছাড়া, ইসলামের একটি মৌলিক বিষয় হলো- প্রতিবাদী হওয়া, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। কেউ যদি প্রতিবাদী বক্তব্য দেয়, তাহলে তো কোন সমস্যা দেখছি না।
আওয়ার ইসলাম: ওয়াজ-মাহফিলগুলো মানুষের অর্থায়নে আয়োজন করা হয়ে থাকে। মানুষের দিল জাগানোর জন্য করা হয়ে থাকে, রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক বক্তব্যের জন্য তো ভিন্ন মঞ্চ রয়েছে। ওয়াজের মাহফিলগুলো যদি রাজনীতির মঞ্চে পরিণত হয় তবে কোন ক্ষতি হবে কিনা?
মাওলানা হাসান জামিল: এটা একটা ভুল ধারণা। রাজনীতির ময়দান একটা আর দীনি বিষয়াদি আরেক বিষয়। কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে আপনি মাহফিলে বলবেন না, এটা তো রাজনৈতিক বক্তব্য না। ভ্রান্তদলগুলোর বিরুদ্ধে আপনি বলবেন না? বাতিলের বিরুদ্ধে নরম করে কথা বললে হবে? এটা আমাদের ভুল ধারণা।
আওয়ার ইসলাম: আমাদের সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
মাওলানা হাসান জামিল: আপনাকেও ধন্যবাদ।