মোহাম্মদ ইমরান
লেখক ও শিক্ষার্থী
দারুল উলূম দেওবন্দ চার দেয়ালকেন্দ্রিক কোনো চর্চার নাম নয়। এর পেছনে রয়েছে বিপ্লব, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের ইতিহাস। যে ইতিহাস কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে একটি আদর্শ। এ আদর্শের রয়েছে ঐতিহাসিক মর্যাদা, ঐতিহ্য। যাকে অনুসরণ করে চলছে বিভিন্ন জনপদের হাজারো মানুষ।
দেওবন্দ তার আদর্শিক স্থান থেকে যুগ-যুগ ধরে এ দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। এ নেতৃত্ব ইট, বালু আর সিমেন্টে তৈরি ফাউন্ডেশনের উপর দাঁড়ানো চার দেয়ালকেন্দ্রিক নয়। তার পেছনে রয়েছে মহাপুরুষদের বৈপ্লবিক অবদান, মহামানবদের আত্মদান, চিন্তাশীল ব্যক্তিদের জাগরণের আওয়াজ।
কারা সেই মহামানব? আমরা তাদের চিনি? তাদের বৈপ্লবিক অবদান, আত্মদান ও বুদ্ধিবৃত্তিক গণজাগরণ কি আমাদের মনে আছে? নাকি তাদের রেখে যাওয়া উত্তরসূরীদের নেতৃত্বের আসনে সমাসীন করে সমীহ করতে শুরু করেছি ? হয়ত বিষয়টা অনেকটা এমনই।
কারণ ইতিহাস আপনাআপনি বিকৃত হয় না। যখন একটি জাতি চেতনাহীন হয়ে শুধুমাত্র ভাবাবেগের উপর আদর্শের ভিত্তি তৈরি করে তখনই পূর্বসূরীদের ইতিহাসের ওপর বিকৃতির ধূলো পড়ে।
দারুল উলুম দেওবন্দ, যার আদর্শিক ভিত্তি মুজাদ্দেদে আলফে সানী, হযরত শাহ ওলীউল্যাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী, হযরত শাহ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভী, হযরত সায়্যিদ আহমদ আহমদ শহীদ ও শাহ ইসমাঈল শহীদ প্রমুখ মনীষীদের চিন্তাধারার ওপর গড়ে উঠেছে।
মুজাদ্দিদে আলফে সানি ও হযরত শাহ ওলীওল্লাহর পর শাহ আব্দুল আজিজ নেতৃত্বে আসেন এবং তার আস্থাভাজন ছাত্র সায়্যিদ আহমদ শহীদ ভারতের ভিন্ন প্রদেশে শিখ ও জমিদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন।
সায়্যিদ আহমদ শহীদের নেতৃত্বে এ সংগ্রাম দিন দিন ত্বরান্বিত হতে থাকে। তার একনিষ্ঠ ছাত্র শাহ ইসমাঈল শহীদ অক্লান্ত পরিশ্রম করে এ সংগ্রাম ও যুদ্ধের জন্য সৈন্য যোগাড় করতে শুরু করেন।
তিনি ওয়াজ, নসিহত ও বাইআতের মাধ্যমে পথভোলা মানুষদের দীনের পথে আনেন। এতে করে দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন তার হাতে বাইআত হতে শুরু করে এবং এবং সায়্যিদ আহমদ শহীদের চেতনা ও সংগ্রামের জন্য নিজেরদের প্রস্তুত করে তোলে।
সেই ধারাবাহিকতায় সায়্যিদ আহমদ শহীদ চেতনায় বাংলাদেশেও জেগে ওঠে হাজী শরীয়তুল্লাহ, মহসিন উদ্দিন দুদু মিয়া ও নেসার আলী ওরপে তিতুমীর, মাওলানা নূর মুহাম্মদ নিযামপুরী (১৮৫৫) মাওলানা ইমামউদ্দিন হাজিপুরী (নোয়াখালী মৃত্যু ১৮৫৫) প্রমুখ।
হাজি শরীয়তুল্লাহ শাহ আব্দুল আজিজের ফতোয়া অনুসারে বাংলাদেশকে দারুল হারব (শত্রু কবলিত দেশ) ঘোষণা করেন। শত্রু কবলিত দেশে ঈদের নামাজ ও জুম্মার নামাজ পড়া বিধি সম্মত নয়। এ কারণে তিনি ঈদের নামাজ ও জুম্মার নামাজ পড়া যাবে না বলে ফতোয়া জারি করেন।
পরিতাপের বিষয় হলো, হিন্দুস্থানে শাহ আব্দুল আজিজ, সায়্যিদ আহমদ শহীদ প্রমুখের হাতে বাইআত গ্রহণকারী সকলেই বাংলাদেশের জন্য পূর্বসূরী ও অনুরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্থান পেয়েছেন।
কিন্তু হাজী শরীয়তুল্লাহ, মহসিন উদ্দিন দুদু মিয়া, নেসার আলী ওর তিতুমীর, শামছুল হুদা পাঁচবাগী এবং ফকীর শাহ মজনু বাংলাদেশের জন্য আদর্শিক ও অনুসরণীয় তো দূরের কথা পূর্বসূরী হিসেবেও খ্যাতি পাননি।
আসলে বাংলার মানুষ ধার করা সংস্কৃতি ও আদর্শ দিয়ে চলতে অভ্যস্ত। স্বদেশের মহামানবরা তাদের কাছে মূল্যায়ন পায়নি। যদি আমরা নিজ দেশের আদর্শিক পুরুষদের চেতনায় জ্বলে উঠতে পারতাম, তাহলে এ দেশের মাটি ও মানুষ হাজার বছর এগিয়ে যেতে পারত।
কারণ, তাদের চিন্তা-চেতনা এ দেশের মাটি ও মানুষের উপযোগী ও উর্বর ছিল। শুধু দেখতে ভালো এমন, বিদেশী আদর্শ স্বদেশের জন্য কখনো পুরোপুরি উপকারী প্রমাণিত হয় না। বরং তা একধরণের সাম্রাজ্যবাদ।
হাজি এমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী, কাসেম নানূতবী, রশীদ আহমদ গাঙ্গুহির সংগ্রাম হিন্দুস্তানের জন্য উপযোগি হলেও বাংলাদেশের জন্য নয়। কারণ তার চেয়ে বেশী নিরেট হাজি শরীয়তুল্লাহর মতো বীরদের চিন্তা, মহসিন উদ্দিন দুদু মিয়াঁর লাঠিয়াল বাহিনী ও তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা এবং মাওলানা নূর মুহাম্মদ, ইমাম উদ্দিনের দাওয়াতি মেহনত। এদেশের উর্বর মাটিতে তাদের জন্ম।
তারা বাঙালীর ধর্মচিন্তা সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকেফহাল। তারা এদেশের সার্বভৌমত্বকে বুকে ধারণ করে ইসলামকে সমুন্নত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন এবং বিট্রিশ পৌষ্য নীলকর ও জামিদারের কষাঘাত থেকে আমাদের রক্ষা করেছেন।
হিন্দুবাদি রুসম রেওয়াজের পরিবর্তে সমাজ সংস্কার ও নিরেট দীনি বিধান সমাজে বাস্তবায়ন করেন। তাই এরাই আমাদের জন্য বেশি অনুসরণযোগ্য ছিল। অথচ তারা আজ আমাদের কাছে বিস্মৃত...
লেখক : শিক্ষার্থী, জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া, যাত্রাবাড়ি, ঢাকা।
আরএম/